দাসত্ত্ব নয় স্বাধীনতা
অনেক ভোরে বাড়ির কলিং বেল বেজেছিল দুবার। প্রথমবার বাজার সাথে সাথেই বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ৬ অক্টোবর, ১৯৭৫। সেই ভোর রাতে নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। দরজার বাইরে তখন কিঞ্চিত বেসামাল কাশিপুর থানার বড় বাবু। সঙ্গে দুজন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার। এঁদেরকে গৌরকিশোর চেনেন। এর আগেও তাঁরা এসেছেন। জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। যদি ভাবা যায় এঁরাই শুধু এসেছেন তাহলে ভুল ভাবা হবে। এই দলটির সাথে আনা হয়েছে চুনীবাবুর বাজারের সামনে থেকে রাতের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে সাক্ষী দেবার জন্য কয়েকজন মজুরকেও। বাইরে মোতায়েন আছে এক বিশাল পুলিশ ফোর্স। বাড়ি তল্লাশির হুকুম আছে। দুজন অফিসার খুবই ভদ্রভাবে বলেছিলেন, “আপনাকে যেতে হবে।” একটুও কথা না বাড়িয়ে তৈরী হয়েছিলেন তিনি। বাড়ি তল্লাশি সেদিন অফিসারদের করতে হয়নি। যে ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে লেখক ঘুরতেন, আগের দিন বর্ধমানে একটা মিটিং সারতে যে ঝোলাটা নিয়ে বেরিয়েছিলেন সেটাতেই আগে টান পড়লো। খুলে দেখা গেল তারমধ্যে আছে ‘কলকাতা’ পত্রিকার নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংখ্যা। ঝোলাটি বাজেয়াপ্ত হল। কাগজটিও। সিজার লিস্ট তৈরী হল। টিপ সই দেওয়া হল। লেখক চললেন পুলিশের সাথে জিপে উঠতে। পরের দিন যখন তাঁকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গৌরকিশোর ঘোষের নামে কি অভিযোগ ছিল তার একটা লিস্ট দেওয়া যেতে পারে। বোমাবাজি, হুলিগানিজম, ইভটিজিং। ম্যাজিসট্রেট হেসে ছিলেন এবং মামলা খারিজ করে দিয়ে ছিলেন। পুলিশ জানতে চেয়েছিল “কী করবেন?” লেখক বলেছিলেন “অপেক্ষা করি”। দিল্লী থেকে ‘মিসা’য় বন্দীর ফরমান এলো অনেক পরে। তিনি জেলে গেলেন।
কেন জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে? কেন জেলে যেতে হয় এখনও লেখকদের? সাংবাদিককে? সমাজ সংগঠকদের? সরকারের উলটো দিকের কন্ঠস্বরদের? সে নিয়ে এক বিস্তৃত লেখার জায়গা প্রস্তুত করা যায়। ফিরে দেখা যায় আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে। অবশ্যই। যেখানে বেশ কয়েকশো মানুষ শুধু রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার জন্য জেলে আছেন। অন্তসত্ত্বা স্টুডেন্ট থেকে সত্তর পেরোনো এক কবি। কেউ বাদ যায়নি। আমরা শুধু তাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি।
সেদিন গৌরকিশোর ঘোষকে জেলে যেতে হয়েছিল কারণ তিনি জরুরী অবস্থায়ও সরকারের বিরুদ্ধে লেখা থামাননি। ২৫ জুন, ১৯৭৫ তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করলেন। জনগনের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতা খর্ব হল। প্রেস সেন্সরশিপ চালু হল। ৩০ জুন, ১৯৭৫ রূপদর্শীর [যে নামে লিখতেন] লেখা ‘ছেঁটে ফেলা’ হল। বাতিল হল আনন্দবাজার পত্রিকার জন্য লেখাও। লেখক প্রতিবাদ জানালেন এক অভিনব পন্থায়। তিনি মাথা মুড়িয়ে ফেললেন। লোকে অবাক হল। প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন, “আমি লেখক। আমার কলমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। আমার মাতৃবিয়োগের থেকে তা কোন অংশে কম?” অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন “এতোও কিছু না হলে?” গৌরকিশোর ঘোষ বলেছিলেন, “গলায় কুকুরের বকলস বেঁধে ঘুরবো।”
দেশের এই ব্যবস্থার ওপর রাগ
জন্মাচ্ছিল অনেকেরই। ‘কলকাতা’ পত্রিকা এক ‘বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা’ প্রকাশের
ব্যবস্থা করলো। এই সংখ্যায় গৌরকিশোরের দুটি বাতিল লেখার সাথে প্রকাশিত হল বিখ্যাত
সেই চিঠি ‘পিতার পত্র’। নিজের ছেলেকে লিখেছিলেন, “ আমি মনে করি আমার লেখার অধিকার,
আমার মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ আমার অস্তিত্ত্বকে হত্যা করা। এই কারণে
আমি বর্তমান সেন্সর ব্যবস্থাকে মানবিক ন্যায়-নীতিবিরোধী, গনতন্ত্র বিরোধী এবং
স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করি”। ঠিক হয়েছিল এই পত্রিকা প্রকাশিত হবে সরকারী
সেন্সর বোর্ড ছাড়াই। পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধও। গৌরকিশোরকে
বন্দী করা হল।
এক ঠান্ডা হিম শীতল স্যাঁতস্যাঁতে সেলে তাকে রাখা হয়েছিল। জীবনের তৃতীয়বারের হার্ট এ্যাটাক এখানেই হয়। তারমধ্যেও তিনি লিখে গেছেন। অসংখ্য। সেইসব লেখা গুছিয়ে। এদিক ওদিক থেকে জড়ো করে প্রকাশিত হয়েছে ‘দাসত্ত্ব নয় স্বাধীনতা’। আছে খুব উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। চিঠি। পড়লে বোঝা যায় ঠিক এই সময়েই কি বসে লিখছেন না কথা গুলো লেখক?
গৌরকিশোর ঘোষ কে ছিলেন? কেমন ছিলেন? তাঁর লেখাপত্র। তাঁর কাজ গুলোকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে ভূমধ্যসাগর। তাঁর প্রিয়জন যাঁরা ছিলেন কলম ধরেছেন তাঁরা। যাঁরা দূর থেকে দেখেছেন তাঁরাও। আমি অনেক বয়সে এসে আবিষ্কার করেছি গৌরকিশোর ঘোষকে। যত পড়েছি তাঁর লেখা অবাক হয়েছি। আজ যখন গোটা দেশে সবাই এক সুরে রা কাড়ছি। অন্যস্বরের যখন বন্দী দশা তখন আবার একবার এমন সব মানুষদের ফিরে দেখতে চাই। মনে করতে চাই যাঁরা বলেছিলেন কথা না শুনলে “কুকুরের বকলস” পরে ঘুরে বেড়াবো। ভাবতে চাই শুধু আজকের পরিস্থিতিটাই প্রথম নয়। এর আগেও এমন সময় এসেছিল। এবং অনেকেই একসাথে গর্জে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো লেখা। তলিয়ে যাওয়ার আগে তাই হয়তো শেষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইলাম।
[তথ্য সূত্র- দাসত্ত্ব নয় স্বাধীনতা/গৌরকিশোর ঘোষ/ আনন্দ]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন