বাড়ির অন্দর ও বাহির
খুব
সম্প্রতি দুটো ছবি দেখলাম। এই দুটো ছবির কেন্দ্রে রয়েছে একটি বাড়ি। দুটো ছবিই এক
মাসের ব্যবধানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে। প্রথমটি অচল মিশ্রের ‘গামক ঘর’
(মুবি)। দ্বিতীয়টি সুজিত সরকারের ‘গুলাবো সিতাবো’ (প্রাইম ভিডিও)।
প্রথম ছবিটিতে বাড়িটিই প্রধান এবং মুখ্য চরিত্র। সেখানে যারা চার পাশ থেকে আসছে, বংশপরম্পরায় থাকছে আবার কালের প্রবাহে চলেও যাচ্ছে। কিন্তু বাড়িটি স্থির, অবিচল, জড়বৎ এক ‘দৃষ্টির’ মতো অবলোকন করছে আখ্যানের পটভূমি। পরিচালক যে ভঙ্গিমায় গল্প বলতে চাইছেন তাকে এমনকি তার নিরীক্ষাটিকেও বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অচল নিজেই আর্থিক ভাবে ছবিটির উদ্যোগ নিয়েছেন। পরিচালকের নিজের গ্রামের বাড়িটি তার পটভূমি এবং মুখ্য চরিত্র। আর যাঁরা ভিড় করে থাকছেন অতীত আর বর্তমানকে সময়ের ভাষ্কর্যে রূপায়িত করার জন্য তাঁরা এর আগে বেশিরভাগ কেউ অভিনয় করেননি। জীবনে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। অভিনয় করলেন। মিশে গেলেন বাড়িটার উঠোন, তুলসী মঞ্চ, রান্নাঘর, পড়শির গল্পে সকাল সন্ধ্যে। তারফলে অচল তাঁর গামক ঘর নির্মাণে আনতে পারলেন মৈথিলী সংস্কৃতির নিজস্ব সুর এবং ভঙ্গিমা। তাঁর ছবির দেহ জুড়ে থাকলো পরিচালকের ব্যক্তিগত পরীক্ষা নিরীক্ষার ছাপ। তাঁর ক্যামেরা স্থির থাকলো বাড়ির উঠোনে। ঘরের কোনে। আম বাগানের শীতল ছায়ায়। ছট পুজোর সকালে কুয়াশা ভরা নদীর ঘাটে। কিম্বা একা বাড়ির সম্পূর্ণ আত্ম মগ্নতায়।
এর ঠিক উলটো দিকে এই মাত্র কয়েকদিন আগে এসে দাঁড়ালো আরও একটা ছবি। সে তার জাঁক জমকে, স্টার সিস্টেমে, আচার আচরণে বুঝিয়ে দিল হিন্দি ছবির আঙিনায় মূল ধারায় গল্প বলতে বিশ্বাসী। ছবিটির আগে প্রচার মাধ্যম এবং নানা সামাজিক মাধ্যম গুলোতে তাকে নিয়ে যে আলোচনা হল। হাওয়া উঠলো। আমরা আঁচ করতে থাকলাম তার দৃশ্যগত আখ্যান পর্বটিকে। কিন্তু এতে তো আমরা অভ্যস্ত। দীর্ঘদিনের চলচ্চিত্র দর্শক হিসেবে এটা তো আমাদের আর এক ধরনের চর্চা। আর সেই চর্চার আধারে আবার সেই আখ্যানে ‘অবলোকন’ করতে গিয়ে আমরা কি খুঁজে পেলাম?
হাজার বছরের পুরনো শহর। দুশো বছরের পুরনো একটা বাড়ি। সত্তর পেরোনো মির্জা। তার থেকে আরও বছর সতেরোর বয়সে বড় বেগম। একদল ভাড়াটে। শহর জুড়ে নানা বিচিত্র মানুষজন। আর একটা পুতুল নাচের প্রচলিত গল্প। হ্যাঁ। ‘গুলাবো সিতাবো’। এখানেও একটা বাড়ি। সেই বাড়ি বুকে আগলে রাখা মির্জা। সেই কবেকার পার্সি আয়নায় মুখ দেখা তাঁর বেগম। কথায় বার্তায় উর্দু ঠাঁট। নবাবি হালচাল। আর গোটা শরীরে দারিদ্রের ভগ্নাবশেষ। বাড়ি এখানে কেন্দ্রে উপস্থিত। কিন্তু অচলের ছবির মতো কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়। উপাদান মাত্র। বলা যেতে পারে মির্জার মায়া। যে মায়ায় সে তার চেয়েও বছর সতেরোর বেগমকে বিয়ে করে নিয়েছিল কোন কালে। ঘর জামাই হয়েছিল। এখন যার মরার অপেক্ষায় সে দিন গোনে। শহরের রাস্তায় বাড়ি থেকে এটা সেটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে বিকিয়ে দেয় বাজারে। কুলফি মালাই খায়। এমনকি সে বড় চতুর নয়। হিসেবের মার প্যাঁচ তার আসে না। আড়াইশো টাকায় সে খুশি। এক বিশাল ঐতিহাসিক অট্টালিকা বিক্রির পাঁচ লাখ টাকা শুনলেই তার ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। তাহলে মির্জার খোয়াব কি? মির্জার খোয়াব এই বাড়িটার মালিকানা। মির্জার খোয়াব তকতে বসবে সে একদিন তার বেগমকে সরিয়ে। বেগমের মৃত্যু কামনায় সে দিন গোনে। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে লোক আসে। প্রমোটার আসে। ভাড়াটের দল জোট বদ্ধ হয়। আর কোথায় যেন মির্জা আরও এই বাড়িটার মতো একা হয়ে পড়তে থাকে। আর ঠিক এইখানেই গুলাবো সিতাবো আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই কবেকার এক বাঞ্ছারামের বাগানকে। বাঞ্ছা যেমন মরে না। বেগমও বেঁচে থাকেন। তারঁ বড় বাড়ি আগলে। আর মির্জার কি হয়? সেটা বললে গল্প বলা হয়। আমার উদ্দেশ্যটা সেটা নয়। অনেক দিন পর অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরায় পুরনো লক্ষ্ণৌ দেখতে ভালো লাগে। মির্জার মতো সেও অবলোকন করে বাড়ির সিঁড়ি। পলেস্তারা খসা দেওয়াল। আলো আর অন্ধকার। একটা হাজার বছরের প্রাচীন শহরকে। তার মানুষজনকে। নিজস্ব রঙ আর নির্যাসকে। এই ছবি ভালো না খারাপ। দীর্ঘ না শ্লথ। আরও কি কি থাকতে পারতো। কোথায় শেষ করা যেত। কিম্বা যেত না। সেসব অন্য আলোচনার প্রেক্ষিত।
আমার মন ভালো হয়েছে দুই মাসের পিঠোপিঠি এমন এক বিষয় নিয়ে দুই ভিন্ন মেরুর দুই পরিচালকের কাজ দেখে। ছবির নিবিড় পাঠকে এইভাবে পাশাপাশি রেখে দেখার হালফিলের সুযোগ এবং সময় খুব কম। আশা করি কোন এক সময়ে কেউ না কেউ আলোচনা করবেন। স্মৃতির ফলকে উঁকি দেবে আরও অনেক ছবি। প্রিয়দর্শনের ‘ইয়ে তেরা ঘর মেরা ঘর’ এর মুম্বাইকেও না হয় ফিরিয়ে আনা যাবে।
এইসব ছাপিয়ে আমার চোখে আপাতত ভাসছে মির্জার হেঁটে যাওয়া। ভাঙা চশমার ভেতর থেকে তার দৃষ্টি। সময়ের দিকে এবং আমাদের দিকেও। স্যার অমিতাভ বচ্চন যত দিন যাচ্ছে আপনি আমাদের উজাড় করে দিচ্ছেন। আরও অনেক দিন আপনাকে আমরা যেন এইভাবেই পাই।
সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন