ভুলিনি তোমায় সুলু...



সুলু, আজ তোমাকে দেখলাম। চোখ বড় বড় করে। হ্যাঁ পুরোটা। এর আগে তোমাকে দেখাটা তো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি সেই অক্টোবর থেকে। ছবিতে, ট্রেলারে, পোষ্টারে, গানে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলে তুমি মাঝে মাঝেই। আর আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল একটা এক্কা দোক্কার ছক। মনে পড়ে যাচ্ছিল কবাডির খালি কোর্ট। সেই ফোন না থাকা নব্বইয়ের দশক। কারেন্ট অফ হওয়া পুরনো সরকারী আবাসন। সারাদিনের ঘরের কাজে ক্লান্ত তুমি বিকেলের বারান্দায়। স্বামীর অফিস থেকে ফেরার জন্য ওয়েট করছো। পড়ন্ত রোদের আলো এসে পড়েছে তোমার টোল খাওয়া হাসি গালে।

ঠিক এই কথা গুলো আমার ছিল না কোনদিন। থাকবার কথাও না। স্কুল ফেরতা পথ ছিল না যে আমার তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে। নাড়ুর মতো আমি যে অনেক গুলো রঙীন কাগজে লেখা ভালোবাসার চিঠি গন্ধ ওয়ালা খামে ভরে ঘুরতাম না কোনদিন। যাকে প্রথম দেখা হল তারজন্য একরকম। যার সাথে একবার দেখা হয়েছিল তারজন্য অন্যরকম। যে চিঠির উত্তর দিয়েছিল তার জন্য আরেকরকম। পকেট ফুলে থাকতো নাড়ুর। চিঠিগুলো শুধু হাত বদল হতো। উত্তর আসতো না। নাড়ু তবু নাছোড় ছিল। অতো অতো চিঠি সারা রাত হ্যারিকেন আর জ্যোৎস্নার আলোয় লিখে গোটা দিন বিলি করে বেড়াতো। তোমার সাথে তো পরিচয় হতো না আমাদের যদি না একদিন সত্যি সত্যি নাড়ু তার চিঠির উত্তর পেতো। যদি না সে আবিষ্কার করতো একটা একলা বউয়ের একলা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তরা তাকে চিঠি দিয়েছে আর অন্য কেউ নয়। যদি না আমরা স্কুল ফেরতা পথে বট গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তোমার কারো জন্য প্রতীক্ষা করা। যদি না তোমার চিঠিটা মির্চা এলিয়াদের মতো কন্ঠস্থ হয়ে যেতো আমাদের। ন হন্যতের পাতার ফাঁকে একটা লম্বা চিঠি। সেদিন স্কুল বাড়ির চিলেকোঠায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ক্লাস নাইনের সবে গোঁফ ওঠা ছেলে গুলো। 

কী লিখেছিলে তুমি চিঠিতে? হাতড়াই। মনে পড়ে না। শুধু তোমাকে দেখবে বলে এক স্কুল ছেলে জড়ো হয়। তোমার লেখার ওপর হাত বোলায়। অনেক রাতে সবে কৈশোরে পড়া নাড়ু একটা খোলা চিঠি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে চাঁদের আলোয়। গঙ্গার ধারে। ফিসফিস করে বাতাস বলে তুমি যেন লিখছো... লিখে চলেছো, তুমি হাসতে ভালোবাসো। তুমি খেলতে ভালোবাসো। স্কুলের একশো মিটার দৌড়ে তুমি ফাস্ট হতে। কুলের আচার একবার চুরী করেছিলে বলে ঠাম্মা তোমায় গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছিল হাতে। সেই দাগ এখনো ট্যাটুর মতো রয়ে গেছে শরীরে। ভাইকে নতুন বই কিনে দিলেও তোমাকে পড়তো হতো আগের ক্লাসের কোন মেয়ের কাছ থেকে কম দামে কেনা পুরনো বই থেকে। উচ্চমাধ্যমিকে যে ছেলেটা কলেজে রোজ পাশে বসতো তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যেদিন বাড়ি ছেড়ে স্টেশনে এসে দাঁড়ালে সেদিন তাকে কোথাও খুঁজে পেলে না। পাড়াতে ঢি ঢি পড়লো। বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো আরও বছর দশেকের বয়সে বড় কোন এক সরকারী অফিসের কেরানীর সাথে। সত্যি লিখেছিলে কী সুলু এই কথা গুলো সেদিন নাড়ুর ওই লম্বা চিঠিতে

মনে পড়ে না আজ। কিন্তু যে গুলো লেখোনি। যেগুলো তুমি এই দুহাজার আঠারোতে লিখতে সে গুলো সব ছবির আকারে পর পর সাজিয়ে গেছেন লেখক, পরিচালক সুরেশ ত্রিবেনী তাঁর প্রথম ছবি তুমাহারি সুলুতে। বিশ্বাস করো প্রায় দুঘন্টার বেশী তুমি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে এক রূপকথার জগতে। যেখানে তোমার সাথে হাসলাম। কাঁদলাম। ছুটে বেড়ালাম কিছু পাওয়ার জন্য। শুধু তাই নয় অবাক হয়ে দেখলাম ছবির শেষে তোমার স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তোমার সেই টোল খাওয়া গালে জয়ের হাসিটা। কিন্তু বিশ্বাস করো আমাদের কৈশোরের সেই বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে থাকা সুলু তোমার মতো জয়ের হাসিটা রেখে যেতে পারেনি আমাদের মনে সেলফি হয়ে। অনেক ভোরে সরকারী আবাসনের অনেক পুরনো বটগাছে পাওয়া গিয়েছিল তাকে। শাড়ির আঁচল গলায় সাপের মতো জড়িয়ে ছিল। আর সে যেন দুলছিল হাওয়ায় তার চিঠির মতোই। যে চিঠিতে ছড়ানো ছিল তার স্বপ্ন। স্বামী, সন্তান নিয়ে ঘর করার বাসনা। তারপর থেকে নাড়ুকেও খুঁজে পাইনা আমরা কেউ। কৈশোরকেও। আজ অনেক দিন পরে সেই কবেকার সুলোচনা রাতের সুলু হয়ে রঙীন প্রজাপতির মতো উড়লো সৌরভ গোস্বামীর ক্যামেরায়। সুরেশের লেখায়। এ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর ছোট্ট স্ক্রিনে । উইকিপিডিয়া বললো একা হয়ে যাওয়া এক মেয়ের গল্প ব্যবসা করেছে প্রচুর। ভালোবাসা বেচবো বলেই না তোমাকে ভালো বেসেছিলাম আমরা। ভালো থেকো। আর মনে রেখো, ভুলিনি তোমায় সুলু।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি