নব্বই- এক ঘোরালো হাওয়া...



সময়টা ছিল বেশ ঘোরালো। মারাত্মক বৈপ্লবিক কিছু ঘটে যাচ্ছে তেমনটা নয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পট পরিবর্তনের ধারাটা যে দ্রুত চলেছে সেটা আমাদের কারো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। আমরা এক ধাক্কায় পরিবর্তিত হতে থাকছিলাম। সেই পরিবর্তনের শর্ত আধুনিকতা কিনা সে নিয়ে বিতর্ক এখনও জারি আছে। আমরা যারা আশির দশকে শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে নব্বইয়ে যৌবনের দোড় গোড়ায় দাঁড়ালাম তাঁরা এক সাথে অনেক গুলো ধাপ পেরোলাম আধুনিকতার চিহ্নের রকম ফেরে। সেখানে যেমন জুড়ে থাকলো অর্থনীতির খোলা এবং বন্ধ দরজা তেমনি থাকলো ভারত নামক এক রাষ্ট্রের নতুন নির্মাণের তোড়জোড়। সেখানে দেশের সাধারণ জন মানুষের দুবেলা পেট ভরছে কিনা খবর নেওয়াটার থেকেও জরুরী হয়ে পড়লো মন্দির থাকবে না মসজিদ। ঠিক তার কয়েক বছর আগেই দূরদর্শনের কল্যাণে আমরা একটা বাইকের বিজ্ঞাপণে জুড়ে দিতে পেরেছি একটা গোটা ভারতের সুখী দৃষ্টিকোণ। মিলে সুর মেরা তুমাহারায় বলেছি আসলেই অখন্ড এক সুরে মিলে যাওয়া ভারতবাসীর ভ্রমের কথা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দোকানে, জানালায় ঝুলছে গদা, চক্র, তীর ধনুক। আমাদের দৃশ্য জগৎ কাঁপাচ্ছে রামায়ণ ও মহাভারত। খালি হয়ে যাচ্ছে রবিবারের রাস্তা। রচনার শস্তা বইয়ে যেমন মুখস্থ করা চলছে “কমপিউটার আশীর্বাদ না অভিশাপ” ঠিক তেমনি ভাব সম্প্রসারণ বলছে যারে তুমি ফেলিবে নীচে...ইত্যাদি প্রভৃতি। বাড়ির কোণে রাখা ছোট বাক্সটা আগে যেখানে পাড়ায় একটা বা দুটো বাড়িতে থাকতো সেখানে অগুন্তি হতে শুরু করছে সংখ্যায়। এখন শুধু আর একটা সিরিয়ায়ল বা দুটো সিরিয়ালে আটকে থাকছে না কিছু। তার পরি সংখ্যান গেরস্থকে ভাবিয়ে তুলেছে বেশ। সংবাদ পরিবেশনায় আসছে এক বিপুল পরিবর্তন। সপ্তাহের এক দিন ওয়ার্ল্ড দিজ উইকের জন্য মুখিয়ে থাকছি সবাই। সুরভি জানিয়ে দিচ্ছে গুজরাটের কোনও এক ছোট্ট গ্রামে হাতের কাজ করা মেয়েটির কথা। জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত ছবির বন্যা বইছে দূরদর্শনে। ঠিক তার সাথে সাথেই কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে নন্টে ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা, অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক, বাহাদুরেরা। এটা আক্ষেপ নয়। দৃশ্যমালা জুড়ে তখন চলমান ছবির প্রসারিত ধুম্রজাল। আমরা মজে আছি ঘটমান বর্তমানের দৃশ্যকল্পে। ঠিক এইসব নিয়ে আশির দশক দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর নির্মম মৃত্যুর সাক্ষী থেকে যখন হঠাৎই নিভে যাচ্ছে ঠিক তখনই নব্বইয়ের দশকের আকাশে দেখা যাচ্ছে ঘনায়মান কালো পোড়া ধোঁওয়া। শুরুটা কারোর কাছেই ভালো ছিল না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিয়ে ভয়ে সিঁটকে ছিল সবাই। 


চিন্তায় ছিলেন অনেকে। চিন্তায় ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রকে যাঁরা নতুন ভাষায় পরিচিত করেছিলেন তাঁদের অন্যতম কারিগর সত্যজিত রায়ও। সেই সময় অনেক দিন ছবির বিরতির পর শুরু করেছেন জীবনের শেষ পর্যায়ের কাজ গুলি। চারিদিকের মেকি দেশপ্রেম, কন্ঠরোধ করে দেওয়া ধর্মীয় আবেগ অশিক্ষা, আধুনিকতার বাগাড়ম্বর তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। কলকাতার এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকলো একটা ছবির পোষ্টার। একজন পঞ্চাশ পেরোনো মানুষের মুখ। তার দিকে ছুড়ির ফলার মতো বিভিন্ন দিক থেকে ধেয়ে আসছে আঙুল। তলায় বড় করে লেখা গণশত্রু। এক ডাক্তার মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া রোগ আটকাতে চেয়েছিলেন। বারণ করেছিলেন বিখ্যাত মন্দিরের চরণামৃত না পান করার জন্য। কারণ সেই জলে আছে বিষ। ডাক্তারকে আমরা গণশত্রু করেছিলাম। ইবসেনের নাটককে নিজের ভাব প্রকাশের হাতিয়ার করেছিলেন সত্যজিৎ এক্কেবারে নব্বইয়ের গোড়ায়। ঠিক তার পর যে ছবি দুটি তিনি নির্মাণ করবেন সেখানেও কি আগাম রাতের আঁধারের কথা টের পাচ্ছিলেন না? শাখা প্রশাখায় বাঙালী পরিবারের মুল্যবোধ কোন তলানীতে এসে ঠেকেছে আর আগন্তুকে আসলেই আধুনকিতা কী তার যেন যথার্থ সংজ্ঞা নিজের মতো করে দিয়ে চির বিদায় নিলেন সত্যজিত ছবির জগত থেকে। চলে গেলেন এপ্রিলে আর ঠিক আট মাস পরে আমরা ধর্মের নামে রাজনীতির পতাকা পুঁতে দিলাম এক মসজিদ ভেঙে চুরমার করে। আমরা মিথকে করলাম ইতিহাস। আর ইতিহাসকে পরিহাস করে দূরে সরিয়ে রাখলাম। ঠিক সেই সময়ে অনেকের মুখে শুনেছিলাম আর নাই বা করতে পারতেন  মানিক বাবু ছবি। এইগুলো কী হলো? এক মামা অনেক দিন পর বাড়িতে এলো আর তাকে নিয়ে এই এতো তত্ত্ব কথার আলোচনা? আজ যখন আবার ছবিটি দেখতে বসি মনে হয় আগাম সেই কালো ধোঁওয়াটা কি দেখতে পেয়েছিলেন পরিচালক?


 অন্যদিকে আর একজনও তাঁর কাজ গোটনোর আগে দুটো গুরুত্ত্বপূর্ণ ছবি করছেন। মহাপৃথিবীতে মৃণাল সেন ধাক্কা দিতে চাইছেন চলে আসা প্রচলিত ভাবনা গুলোর কাছে। এতোদিনের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে যেন এক ঘোরালো হাওয়ায়। বিশ্ব রাজনীতি, সোভিয়েত রাশিয়ার পতন যেন বাঙালী গেরস্থ বাড়ির বাবা আর ছেলের সামনে রাত দুপুরে দরজায় কড়া নাড়ছে। মায়ের অপঘাতে মৃত্যু, তার বিশ্বাস, পড়াশুনো সব যেন এক প্রশ্ন চিহ্নের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে দাঁড়িয়ে সম সময় তার আদর্শ চিন্তা ভাবনা গুলো আরও ছড়িয়ে পড়বে মুক্ত অর্থনীতির জাঁতাকলে অন্তরীণ আর আমার ভুবনে। 


এক ডক্টর কি মউত, হুইলচেয়ার এই ছবিতেও কী তপন সিনহা শবব্যবচ্ছেদ করছেন না সমাজ ব্যবস্থার? এক অসহায় ডাক্তার আর এক হুইলচেয়ারে বসা মেয়ের জীবন কেন ধাক্কা দিচ্ছে কলকাতার চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক পরিসরকে? নব্বইয়ের গোড়ায় বিদায় নিচ্ছেন অনেকেই। যাঁরা চব্বিশটা ফ্রেমের আলো আর আঁধারের গল্পকে এক আন্তর্জাতিক ভাষায় উন্নীত করতে পেরেছিলেন। যাঁদের হাত ধরে বাঙলা তথা ভারতীয় ছবি পৌঁছে যেতে পেরেছিল বিশ্বের দরবারে। বিদায় তো নিচ্ছেন কিন্তু রেখে যাচ্ছেন নিজস্ব সাক্ষর। এক দীর্ঘ সময়ের ফেলে আসা ইতিহাসকে।


এই নব্বইয়ের দশকেই বাংলার মূল ধারার ছবিতে আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে থেকেছেন এক সময়ের ডুবন্ত ইণ্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে তোলা অঞ্জন চৌধুরীরা। নিজস্ব গল্পের বদলে সেখানে পর্দা জুড়ে দখল করছে রি-মেক ছবি। সিনেমা হল গুলো পরিত্যক্ত হতে থাকছে শহুরে দর্শকের মুখ ফেরানো মানসিকতায়। ঠিক এমনই সময়ে তরুণ পরিচালক হিসেবে স্বাক্ষর রাখলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর হীরের আংটি এবং একটু পরেই ঊনিশে এপ্রিলে। হীরের আংটি মুক্তি পায়নি সেইভাবে সাধারণ প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু ঊনিশে এপ্রিলে শূন্য প্রেক্ষাগৃহ ভরে উঠলো দর্শকে। একই বাড়ির মধ্যে একই দিনে ঘটনার ঘন ঘটা মা আর মেয়েকে নতুন সম্পর্কের বন্ধনে জুড়ে দিল। মা আর মেয়ের দুই বিপরীত সময়ের আলেখ্য একই পরিসরে নিয়ে এসে সম সময়ের কথা যতটা না বললেন ঋতুপর্ণ তার চেয়ে বেশী বাঙালীর অন্দরমহল উন্মোচিত হল অন্যভাবে। দহনে তাই নায়িকা বাইরে যতটা লাঞ্ছিত হলেন ঘরের মধ্যে নিজের স্বামীর কাছে হলেন তার থেকেও বেশী। প্রতিবাদ করে এগিয়ে আসা মেয়েটিকেও কম লাঞ্ছনা সহ্য করতে হল না। আবারও তাঁর তৃতীয় ছবিতে একই সময়ের দুই মেয়ের কাহিনী বলতে বসলেন ঋতুপর্ণ। ঠিক এর পরেই বাড়িওয়ালীতে একা করে দিলেন নায়িকাকে। যে পুরোনো বাড়ির আসবাবপত্র, সেকেলে জীবনের অবশেষের মতো বাঁচে মেয়েটি। এক নিস্পন্দ জীবনে যার একমাত্র সঙ্গী একটা বৃদ্ধ চাকর আর এক মুখ ঝামটা দেওয়া অশিক্ষিত কাজের মেয়ে। সেই নারীর জীবনে, তার বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হবে এক শ্যুটিং পার্টি। পরকে আপন ভাবার এক ভ্রমের মধ্যে হারিয়ে যাবে বাড়িওয়ালীর প্রেম। তার বেঁচে থাকার লাঞ্ছনাটুকু। 


এই একাকিত্ত্বের অতল গভীরে হারিয়ে যাওয়ার গল্পই কি একের পর এক ছবিতে বলে যাননি ঋতুপর্ণ? এই একা হয়ে যাওয়ার চিহ্নই কি বাংলা ছবিকে অন্য এক পরিসরে বসিয়ে দিল না? না হলে কি অসম্ভব সাহস আর দক্ষতায় নির্মাণ করলেন চিত্রাঙ্গদা? হীরের আংটিতে যার শুরু চিত্রাঙ্গদায় কেমন যেন তার পরিপূর্ণতার ইঙ্গিত। তবে এই যে চলন, এই যে একা হয়ে যাওয়ার বাসনা...তার কষ্ট...এই মুহূর্তে বাঁচা নিজের শরীরের মতো সিনেমার শরীরকে কাঁটা ছেঁড়া করা। লাউ আলু পোস্ত কুমড়ো খাওয়া বাঙালীকে ঘাড় ধরে দেখানো যেভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম এই সমাজ সেইভাবে বাঁচতে দিল কি? না হলে বাবা, মায়ের কাছে আস্তে আস্তে রুপান্তরকামী ছেলের আর্তি কেন পাশে থাকার? যখন একের পর এক ছেড়ে চলে যাচ্ছে সবাই। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খুব কম আলোচিত, অথচ অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ছবি বলে মনে হয় আমার চিত্রাঙ্গদা। যার পূর্ব প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ওই নব্বই দশকেই। 


মাঝখানে অবশ্য খুব ধূমধাম করে পালন হল চলচ্চিত্রের শতবর্ষ। গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু, অপর্ণা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁরা নিজের পরিসরে কাজ করে যেতে থাকলেন। আর কয়েক বছর পর এক গল্পহীন কাহিনীকে আমাদের সামনে খুব দক্ষতায় নিয়ে এলেন মলয় ভট্টাচার্য তাঁর প্রথম ছবি কাহিনীতে। কলকাতাকে অন্যভাবে দেখার যে চিত্র কৌশল তা যেন প্রতিস্থাপিত হল। এক হারানো শৈশবকে কয়েকজন বন্দী করে নিয়ে চললো কলকাতা থেকে বহুদূর কোনো এক নির্জনে। আর অন্যদিকে অশোক বিশ্বনাথনের হাত ধরে দীর্ঘদিন জেলের অন্ধকারে কাটানোর পর বাড়ি ফিরলেন এক রাজনৈতিক বন্দী পরিচালকের প্রথম ছবি শূন্য থেকে শুরুতে। ফিরে তো এলেন। কিন্তু কাটাতে পারলেন কি সম সময়কে? পালটে যাওয়া চারপাশের মানুষ, রাজনৈতিক আদর্শ কেমন যেন স্থান কালের নীরিখে ঘেঁটে দিতে থাকলো মানুষটাকে। শহর...শহর থেকে দূরে...আরও দূরে কোথাও কি পাওয়া যাবে আসলে তিনি যা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন?
এক ঘোরালো সময়ের দিক দর্শন শুধু এইভাবে নাও হতে পারতো। তারমধ্যে খুলে গিয়েছিল হাজারটা নতুন টেলিভিশন চ্যানেলের দ্বার। প্রসারভারতীর নতুন আনা বিলে তখন আর বাঙালী তথা ভারতবাসী একটা হামলোগ, নুক্কড় আর ভারত এক খোঁজে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। তারও বহু আগে মাঠে মারা গেছে দূরদর্শনের শিক্ষকের ভূমিকা। ঘরে ঘরে ঢুকে পড়লো মেগাসিরিয়াল নামক এক আঙ্গিক। বাঙালী মজে উঠলো। তার দৃষ্টি শক্তি এবং শ্রবণ বহুজাগতিক ঠান্ডা কোলারা, ডিও-রা, নতুন নতুন টিভি ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন এসে দখল করলো। বাঙালী সত্যিই জানতে পারলো তাদের বগলের ঘামে গন্ধ আছে। আর সেই গন্ধ নিবারণের জন্য দরকার সুগন্ধির। বাড়ি গুলো ভাঙতে শুরু করলো। গজিয়ে উঠতে থাকলো ফ্ল্যাট বাড়ি। পাড়ার চরিত্রগুলো বদলাতে শুরু করলো। রাতে খাবার প্লেট এর হাত থেকে ওর হাতে যাওয়ার মুহূর্তে এক দেশ থেকে আর এক দেশে মিশাইল হানা হল। টেলিভিশনে চলতি খবরের সংস্থা জানালো মৃতের সংখ্যা হাজার। আমরা নির্বিকার থাকলাম। রাতের খাবার খেলাম। ঘুমোলাম। আমরা অভ্যস্থ হয়ে পড়লাম ঘটমান বর্তমানের প্রদর্শনীতে। যে দৃশ্য মাধ্যম তারও অনেক পরে প্রচন্ড ভাবে প্রভাব ফেলবে আমাদের দেখার দর্শনে। চিন্তায়। এমনকি তার পরের বাংলা ছবিতেও। যে ঘোরালো ঝড়ে এ্যান্টেনা ঠিক করতাম সেই ঘোরালো ঝড় অন্যরকম ভাবে আষ্টেপৃষ্টে পরিবর্তন করে দিল সব কিছুর।
  
প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র, ২০১৭, সিনে গিল্ড বালীর মুখপত্রে প্রকাশিত 
 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি