বৈশাখের চিঠি
সিরাজুল,
সকালের নরম
রোদটা এই মাত্র চাঁপা ফুলের ডালটায় এসে পড়লো। আর তিনটে ছ্যাতারে পাখি মনের সুখে সেখানে
বসে বসে দোল খেতে লাগলো দেখে খানিকটা ঘুম বাঁকি রেখেই উঠে পড়লাম। মনে পড়ে গেলো একটা বড় চিঠি লিখতে হবে তোমাকে। হাওয়ার সাথে
ভেসে এলো তোমার পাখিরালার কাঠ চাঁপার গন্ধ।
আমার
চারপাশটা যে খুব সবুজের সমারোহ তেমনটা নয়। নববর্ষের জন্য উত্তরপাড়া যে রানীর মতো
সেজেছে সেটাও বলবো না। তবে সকালে প্রভাত ফেরীতে শ্রী গান গেয়েছে। “আলোকের এই ঝরণা
ধারায় ধুইয়ে দাও”। জানো সিরাজুল প্রভাত ফেরীতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল বেশ কয়েক
বছর আগে ঢাকার রাস্তায় প্রভাত ফেরীতে হাঁটার কথা। সেই বর্ণময় শোভাযাত্রা তুমি যদি
দেখতে সিরাজুল...আমার মনে হয় তুমিও সবার সাথে গলা মেলাতে গানে...কবিতায়...সঙ্গীতের
ছন্দে।
এই ছবিটি গুগুল
ইমেজের সৌজন্যে।
বছরের শুরুর
আগের দিন সারা রাত ধরে ঢাকার শিল্প-কলা আকাদেমির ছেলে মেয়েরা কত রকমের নক্সা করা
পুতুল গড়ে। তাদের সুন্দর করে সাজায়। ফুল লতা পাতা ঘর কন্নার সাজে রঙ-চঙে হয়ে ওঠে
শোভা যাত্রা। কলকল করে ওঠে বাংলা ভাষা তার মুখের বোলে...খুশির ঝরনায়। মনে হলো
তোমার সাথে একটু ভাগ বাটোয়ারা করে নিই আনন্দ। আর কে না জানে আনন্দ ভাগ করে নিলে
বেড়ে যায় শত শত গুণ। ও...যেটা ভুলেই যাচ্ছিলাম বলতে শোভাযাত্রার শেষে সবার বাড়িতে
সবার নেমনতন্ন থাকে পাত পেড়ে পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ খাওয়ার। সে এক এলাহি ব্যাপার
স্যাপার...লিখে তোমায় কিছুতেই বোঝাতে পারবো না সিরাজুল। তুমি যখন অনেক বড় হয়ে ঢাকায়
বেড়াতে যাবে তখন দেখো সব। আমাদের দেশেও নতুন বছরকে নানাভাবে পালন করার এক রীতি আছে
নানান রাজ্যে, নানান সংস্কৃতির মধ্যে। কিন্তু সেতো একটা বিশাল বড় লেখার বিষয়। কোনো
একবার আমরা সেগুলো নিশ্চই আলোচনা করবো। ও ভালো কথা বেড়িয়ে আসলেই সবচেয়ে ভালো হবে
তাই না?
ওই দেখো ঢাকার
কথা বলতেই কোথা থেকে যেন মনে আমার পড়ে গেল শান্তিনিকেতনের কথা। কেন মনে পড়লো বলো
তো...? এইসব শোভাযাত্রা...বর্ণময় পরিবেশ যখন কিছুই ছিল না তখন কিন্তু বিশ্বকবি
একমাত্র শান্তিনিকেতনেই পুরোনো বছরকে গানে কবিতায় নাটকে বিদায় জানানো আর নতুনকে
বরণ করার উৎসবের সূচনা করেছিলেন। নতুন বছরের শুরুতে এই অনুষ্ঠান এখনও
শান্তিনিকেতনে হয়ে আসছে সেই কবে থেকে। সেখানে শিশু ভবনের একদম কচি-কাঁচারা গান গায়
যেমন তেমনি আবার অনেক বড় মানুষেরাও থাকেন। নতুন বছরকে অভিনন্দন জানিয়ে, বিশ্বকবির
জন্মদিন পালন করে সেই সময় শান্তিনিকেতন ছুটি পড়ে যেত। কারণ বীরভূমের প্রচন্ড গরমে
প্রাণ থাকতো ওষ্ঠাগত। তুমি যদি এখনও শান্তিনিকেতনে আসো, তাহলে দেখবে কাঁচঘরে জড়ো
হয়েছেন সবাই। নতুন বছরকে আমন্ত্রণ করাটাও দেখার মতো সিরাজুল।
আমি জানি
তুমি উসখুশ করছো। তুমি আমাকে এক্ষুনি বলতে চাইছো তোমার পাখিরালা গ্রামের কথা। বলতে
চাইছো কিছুদিন আগে বনের মৌমাছি গুলো কেমন করে আকাশে মেঘ ঘনিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো খলসি
ফুলের দিকে। যে ফুলের মধ্যে লুকোনো আছে গলানো সোনা রঙের মধু। বলতে চাইছো সেই
সুন্দর রঙ করা নৌকার কথা। মা বনবিবি আর বাবা বসন্ত রায়ের নাম করে যারা ছুটে যাচ্ছে
জঙ্গলের দিকে। আর শিঙা বাজিয়ে সতর্ক করছে আশে পাশের নৌকাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচার
জন্য। এই মধু সংগ্রহ...এই প্রকৃতির উদযাপনও তো গোটা চৈত্র বৈশাখ মাস জুড়ে হয়। তুমি
ছবি না পাঠালে আমি জানতামই না সিরাজুল।
তোমার যে
একটা নতুন ক্যামেরা সমেত ফোন হয়েছে সে কথা একবারও তো আমাকে জানাওনি সিরাজুল। তুমি
যে এক্ষুনি ইচ্ছে করলেই সরাসরি আমাকে ছবি পাঠিয়ে দিতে পারবে সে কথাও লুকিয়ে
রেখেছিলে বেমালুম। ভাগ্যিস আনন্দী আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি লিখলো আর বললো
সারাক্ষণ তুমি স্মার্ট ফোন নিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছো। মাধ্যমিকের পরে একটুও বই নিয়ে
বসোনি। উদাস উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো সাইকেল নিয়ে। আর নাকি ফাঁক পেলেই ফোনের ওয়ার্ড
প্যাডে কবিতা লিখছো? থাক থাক...ওমন করে তোমার ওই গোল গোল চোখ নিয়ে তাকিও না সিরাজুল।
ভয় পেয়ে যাই বড়। এখন তো তুমি আর ছোট্টটি নেই। আর আমিও বুড়ো হচ্ছি। বুঝতেই পারছি কত
ভালো ক্যামেরাম্যান তুমি হবে। না হলে অমন করে মৌমাছির জল খাওয়ার ছবি কেউ তুলতে
পারে? বিশ্বাস করো সিরাজুল আমিও এই প্রথম দেখলাম মৌমাছিরা সারি বেঁধে এমন করে জল
খায়। মধু নিয়ে আসার ঝক্কি তো কম নয়। তাই বেচারাদের বড়ই তেষ্টায় ছাতি ফাটে।
কিন্তু যাই
বলো না কেন সিরাজুল। ভারী রাগ হয়েছে তোমার ওপর আমার আর আনন্দীর দুজনেরই। আর সেই
রাগ কিছুতেই যাচ্ছে না। কেন তুমি আমাকে তোমার কবিতা পড়াওনি? আর আনন্দীকে একটুও
খেলতে দাও নি গেম? এটা কিন্তু ভারী অন্যায় সিরাজুল। আনন্দীরও তো ইচ্ছে করে গফুর
চাচাকে নতুন ফোনে একটু খেলাটা দেখাক। কিম্বা মহেশ তলার রমজান মাঝি কাঁকড়া ধরে নিয়ে
এলে তার সাথে কয়েকটা সেলফি তুলুক।
ওহ...ওই
দেখো ভুলেই যাচ্ছিলাম আজকাল নাকি তুমি তোমার ফোন থেকেই সদ্য ওঠা গোঁফের পরিচর্যা
করছো? লুকিয়ে লুকিয়ে মোবাইলের ক্যামেরায় তা দিচ্ছো গোঁফের। আরে আরে রাগ কোরো না সিরাজুল।
থোড়াই বলছি নাকি আমি এইসব কথা? নানি জানালো সেদিন। তুমি নাকি তাকে বনবিবির পালা
দেখতে দাওনি ফোনে। সত্যপীরের পাঁচালীটাও নাকি শুনতে না দিয়ে ফুটবল খেলা দেখেছো?
মুখ ফিরিয়ে নিও না সিরাজুল। মাধ্যমিকের পরে তোমার হাতে একটা নতুন ফোন দেখে শুধু
আমি আনন্দে হইচই করছি তাই ভেবো না কিন্তু। চাঁদের বুড়িও যে কি পরিমাণে লাফালাফি
শুরু করেছে তা বলে বোঝাতে পারবো না তোমাকে। কুমীরের ছবি দেখে তার ধারণা হয়েছে এবার
তুমি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে সেলফি তুলে তাকে পাঠাবে।
আরে
আরে...ওই দেখো...চললে কোথা? দাঁড়াও। লম্বা চিঠির এখনও অনেকটা পড়া বাঁকি। আমি জানি সিরাজুল
ইচ্ছামতীর বন্ধুরা এবার প্রশ্ন করবে এই যে তোমার কাছে অত্যাধুনিক যন্ত্র। আমার
হাতে একটা যন্ত্র যা দিয়ে আমরা আমাদের মাঝের যোজন দূরত্ত্বের সীমা কমিয়ে আনছি
মুহূর্তে, সেখানে এই চিঠির প্রয়োজনীয়তা কী? খুব সুন্দর লিখেছো সিরাজুল তুমি আমাকে।
“যেখানে কথার শেষ, সেখানেই তো লেখার শুরু।” ইচ্ছে হচ্ছে তোমার মাথার ঝাঁকড়া চুলটা
একটু হাত দিয়ে ঘেঁটে দিই। আরেকবার বলে দিই মাথাটা কেবল চুল আঁচড়াবার জন্যেই
ব্যবহার করছে না ছেলেটা। ভাবছেও কিছু কিছু। সেটা যে এখন করতে পারছি না সেটা বিলক্ষণ জানি। কারণ
এই চিঠিটা যখন তুমি তোমার ইনবক্স থেকে পড়বে তখন হয়তো পাখিরালার সব দোকান গুলো সেজে
উঠেছে হালখাতার জন্য। তুমি আর আনন্দী নতুন জামা পড়ে রেডি। বলাই এসেছে...টোকোন
এসেছে...ওদিক থেকে এবারে টেস্টে তোমার থেকে দু-নাম্বার বেশী পেয়ে প্রথম হওয়া
সুদীপ্ত এসেছে। তোমরা সবাই মিলে যাচ্ছো নবকুমার মুদির দোকান। সেখান থেকে মিঠাই বরফ
কিনে গদাধরের কাপড়ের আড়ত। আর সেখান থেকে নিশ্চই গফুর চাচার নৌকায় বৈশাখের প্রথম
রোদ মাথায় নিয়ে পাশের গ্রামের চড়কের মেলায়। তাই তো?
আমি জানি সব
সিরাজুল। চোখের সামনে সব ভাসতে দেখি যে ডিঙির মতো। কারণ আমিও যে একটা সময় তুমি
ছিলাম সিরাজুল।
হ্যাঁ...তখন
হয়তো তোমার মতন আমার হাতে ছিল না স্মার্ট ফোন। ভাবতেও পারিনি কোনোদিন হাঁটতে
হাঁটতে কথা বলতে পারবো খুব কাছের বন্ধুর সাথে। মন কেমন করলে মাকে দেখতে পাবো ফোনের
জানলায়। অনেক রাতে উত্তরপাড়া থেকে পাখিরালা গ্রামের ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে পাবো তোমার
কথার সাথে। এইসব তখন কিছুই ছিল না সিরাজুল। কিন্তু চড়কের রঙীণ মেলা ছিল। গাজনের সঙ
ছিল। মিঠাই বরফ ছিল। হাসান চাচার তাল পাটালি ছিল। দিদার হাতে বেলের পানা ছিল। আর
ছিল অনেক অনেক জোনাকি ভরা রাত। দেখতাম যে স্বপন পোড়েল, বেচা মুৎসুদ্দি, কালী বাগদী
যারা কিছুদিন আগেই সন্ন্যাস নিয়ে “বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে...মহাদেব” বলে
নিজেদের একবেলার হবিষ্যি ভিক্ষে করতো তারাই দোকান দিয়েছে মেলায় চপের... তিলের
নাড়ুর... জিভে গজা...জিলিপির। তার পাশেই তালপাখার হরেক রকম পশরা নিয়ে বসেছে
আমিনুদ্দিন। তাল পাটালি আর তাল পাখার হাওয়া দুটোই যে বড় মিষ্টি।
সেই মিষ্টি
মিষ্টি স্মৃতি...কথার মালা...ছবি দিয়ে গাঁথা থাকলো তোমার আর আমার বৈশাখের চিঠি।
নতুন বছর আমাদের সবার জন্য খুব ভালো হয়ে উঠুক সিরাজুল। অনেক অনেক ছবি তুলো তোমার
নতুন ফোনে। আর আনন্দীকে মাঝে মাঝে খেলতে দিও কেমন? রেজাল্ট বেরোনোর আগেই একবার পোঁ
করে ঘুরে যেও উত্তরপাড়া। যে দুটো চড়াই আমার চিলেকোঠাতে বাসা বেঁধেছিল তাদের একটা
ছানা হয়েছে যে। তার উড়তে শেখাটা তুমি আর আমি দুজনে একসাথে দেখবো সিরাজুল। আর তুমি
চট পট করে তোমার নতুন ফোনের ক্যামেরায় সেই ওড়ার ছবি তুলবে কেমন? তারপর আমরা সেই
ছবি পাঠাবো চাঁদের বুড়িকে। কি মজাটাই হবে তাই না সিরাজুল? খুব ভালো থেকো। অনেক
অনেক আদর আর ভালোবাসা।
কল্লোল
উত্তরপাড়া,
হুগলী।
ইচ্ছামতীর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত। ২০১৭।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন