মন্টু অমিতাভ সরকার
মন্টু ছুটছিল।
যেভাবে সাধারণ মানুষ বাস ধরার জন্যে ছোটে তেমনটা নয়।
মন্টু ছুটছিল।
যেভাবে ফাস্ট বোলার নিমেষে ছুটে আসে সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষের পেছনের তিনটে উইকেটকে ফেলে দিতে তেমনটা নয়।
মন্টু ছুটছিল।
যেভাবে সাইকেল চালানো মেয়েটার হাতে প্রথম প্রেমের চিঠিটা ধরিয়ে দিতে হয় তেমনটা নয়।
মন্টু ছুটছিল।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে সিরিয়াস পেশেন্টকে ভর্তি করানোর জন্য যেভাবে ডাক্তারের সন্ধানে দৌড় দিতে হয় তেমটা নয়।
আসলে মন্টু ছুটছিল পেছন থেকে ঠিক পিঠ বরাবার এগিয়ে আসা বুলেটটাকে এড়াতে। হৃৎপিন্ডটাকে এফাল ওফাল করার আগে পর্যন্ত মন্টু ছুটছিল। আর তার মনে পড়ে যাচ্ছিল...
আদিগন্ত একটা ধান ক্ষেত।
তালগাছে একটা হুতুম পেঁচার বাসা।
বিশ্বকর্মা পুজোয় একতে ঘুড়ির মার কাট্টা প্যাঁচ।
চ্যাটচেটে ঘেমো দুপুরে নুন শোয়ের দুটো টিকিট।
বাবার হাত ধরে প্রথম সমুদ্রের জলের নোনা স্বাদ।
নীল জলে মাখামাখি।
মন্টু নীল জলের ঢেউয়ে স্নান করছিল। তার চার পাশে ভরে উঠছিল লাল রঙের একটা নিশান। আসলে মন্টু একটা সুইমিং পুলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার চারপাশের স্বছ স্ফটিক নীল সাদা জল লাল হয়ে উঠছিল তারই ফুসফুস বিদীর্ন রক্তে।
ঠিক সেই সময় মন্টু স্বপ্ন দেখতে চাইছিল বাঁচার। ঘ্রাণ নিচ্ছিল রক্তের। শ্বাস নালী ভর্তি হয়ে উঠছিল গর্ভস্থ থাকার সময়ে মুখের মধ্যে জমে থাকা নবজাতকের শ্লেষায়। আসলে মন্টু জন্ম নিচ্ছিল একটা পেয়ারা গাছের নীচে। ধাত্রী মা চেপে ধরেছিল কিছুটা বেরিয়ে আসা তার মাথার অংশটা। আর সেই কবেকার, কোন যুগের পৃথিবীর গভীর রক্তের উচাটন থেকে...গর্ভের অন্তর্লীন অন্ধকার জগত থেকে আস্তে আস্তে একটু একটু করে মন্টুর সামনে উঁকি দিচ্ছিল রাতের আঁধারে তারায় ভরা এক আকাশ। মন্টু চমৎকার একটা চিৎকার করেছিল।
বুলেটটা ঠিক তার পিঠ বরাবর গেঁথে যাওয়ার পর।
প্রথম প্রেমের চিঠির উত্তর আসার পর...।
জীবনে প্রথম ব্ল্যাক টিকিটে সিনেমা দেখার আনন্দে...।
শরীরে প্রথম যৌন অনুভূতি আবিষ্কারের মুহূর্তে।
একটা শহরের রাজা হওয়ার পর।
সেই চিৎকারের রেশ ছড়িয়ে পড়ছিল এক দামী সংবাদ পত্রের অফিসে। পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণায়মান স্যাটেলাইটের মধ্যস্থতায়। আরো জটিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক দৃশ্য ও শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে ছোট্ট একটা ভিডিয়ো টেপে...এক সাংবাদিকের ক্যামেরা থেকে।
“নীলাভ আপনি শুনতে পাচ্ছেন কী? আমি দাঁড়িয়ে আছি শহরের এক ফাইভস্টার হোটেলের চোদ্দ তলার সুইমিং পুলের ধারে...। নীলাভ আপনি দেখতে পাচ্ছেন কি? আমার সামনে জলের ওপরে চিৎ হয়ে ভাসছে এই শহরের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল মন্টু...ওরফে অমিতাভ...ওরফে সরকার...”।
নীলাভ ঠিক শুনতে পাচ্ছিল কিনা বুঝতে পারছিলো না ওরা কেউ। নীলাভ ঠিক দেখতে পাচ্ছিল কিনা ঠাহর করতে পারছিলো না ওরা কেউ। ওরা আরো তাড়ায় ছিল আকাশের মাঝামাঝি হাল্কা বাতাসের স্তরটাকে ধরার জন্যে। ওখানে ওদের উড়তে সুবিধে হয়। ওখানে উড়লে বাইপাসের পাশে কিম্বা রাজারহাটের দিকে এখোনো জেগে থাকা দু-একটা মরা ক্ষেতের সন্ধান পাওয়া যায়। ছোট ছোট ইদুর গুলো এখোনো খাবারের সন্ধানে মরা ক্ষেতের মাঝে হা-হুতাশ করতে বেরোলে সেই হাল্কা বাতাসের স্তর থেকে সহজেই উড়ে এসে ছোঁ-মারা যায়। ভোরের অনেক আগে বাসায় ফেরা যায়, যে বাসা তাদের দিয়েছে এক নাগরিক লাঞ্ছনা। গাছের বদলে দশতলার চিলে কোঠার এক ফাঁকা কোঠর। যে কোঠর বানানো হয়েছে মন্টুরই সাপ্লাই করা ইঁট, বালি, সিমেন্টে। তাই সত্যিই সেই ভুতুম পেঁচার দলটার একটুও অবকাশ ছিল না মন্টুর দিকে ফিরে দেখার। যদিও সবচেয়ে কাছের দূরত্ত্বে ছিল তারাই। জন্মের সময়ে...রাজা হওয়ার দিন গুলোতে...মৃত্যুর পরেও।
মন্টু তখোনো জানতো না মাতৃ গর্ভের ওম থেকে বেরিয়ে এসে সে এক তারায় ভরা আকাশ দেখতে পাবে। মন্টু তখোনো জানতো না গভীর রাতের অন্ধকারে গাছের সবুজ পাতাকে দেখায় কালো। মন্টু তখোনো জানতো না তার জন্মানোর কিছুক্ষণ পরেই আকাশবানী কোলকাতা থেকে খবর পড়বেন বরুণ মজুমদার। মন্টু তখোনো জানতো না সে এক ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী। মন্টু তখোনো জানতো না স্বাধীনতার আঠাশ বছর পরে দেশে এই প্রথম জারী হচ্ছে জরুরী অবস্থা। মন্টু তখোনো জানতো না এই নতুন জন্ম তাকে ফিরে দেখতে হবে আরো অনেক বছর পরে কোনো এক পাঁচতারা হোটেলের সুইমিং পুলে। তারই ফুসফুসের রক্তেভেজা নীল-সাদা স্ফটিক জলে।
মন্টু ওরফে অমিতাভ ওরফে সরকার এখন একটা ফাইল। সেই হলদেটে ক্ষয়াটে ফাইলটা পড়ে আছে তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নাম্বার ড্রয়ারে। ওই ফাইলটা খোলা হবে না আর কোনোদিন। খোলা হবে না কারণ ওই ফাইল না খোলার জন্য অনেক নোটের তাড়া জমা পড়েছে বিভিন্ন দফতরে। অনেক লোকের মুখ বন্ধ করা হয়েছে গুম করে, না করে, অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখিয়ে। যে ক্যামেরা সেদিন সেই তারায় ভরা আকাশে সুইমিং পুলের রক্তে ভেজা জলে মন্টুর চিৎ হয়ে সাঁতার কাটার ছবি তুলেছিল; আজ, এখন এই মুহূর্তে সে শহরে একটা শ্যুটিং এর মহরত তুলতে ব্যাস্ত। রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই। জ্যাম জটে শহর নাজেহাল। নতুন সরকার কলকাতাকে প্রোমোট করছেন। তাই উড়ে এসে জুড়ে বসলে কলকাতায় সব ফ্রি। কলকাতার নগর...রাস্তাঘাট...কলকাতার ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট জীবন...কলকাতার রসগোল্লা...কালীঘাট...মাদার টেরিজা...সত্যজিৎ... বাস স্ট্যান্ড...সবটাই এখন ছবির ফ্রেম। বোম্বের পরিচালক হাত দিয়ে দিয়ে ক্যামেরার সেই অদৃশ্য ফ্রেমটাকেই নিরূপণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে তার হাত গলে যে মন্টু ঢুকে পড়ল তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না।
আর ঠিক সেই সময়ে সাদা পর্দায় ভেসে উঠলো অমিতাভ।
একটা ভাঙা সিনেমা হল।
একটা লু লাগা দুপুর...।
মিঠাই বরফ...।
পরিচালক চিৎকার করে বলে উঠলেন এ্যাকশান। রাস্তার ধারে ভিড়ে ঠাসা জনতা দেখলো ঝাঁ-চকচকে শহরের ফিটফাট রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছেন অমিতাভ। যে রাস্তার ইঁট...বালী...সিমেন্ট...পিচ...খোয়া...সাপ্লাই করেছিল মন্টু...।
যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিল সে হবে এই শহরের ‘মন্টু ওরফে অমিতাভ ওরফে সরকার’...।
যেভাবে সাধারণ মানুষ বাস ধরার জন্যে ছোটে তেমনটা নয়।
মন্টু ছুটছিল।
যেভাবে ফাস্ট বোলার নিমেষে ছুটে আসে সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষের পেছনের তিনটে উইকেটকে ফেলে দিতে তেমনটা নয়।
মন্টু ছুটছিল।
যেভাবে সাইকেল চালানো মেয়েটার হাতে প্রথম প্রেমের চিঠিটা ধরিয়ে দিতে হয় তেমনটা নয়।
মন্টু ছুটছিল।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে সিরিয়াস পেশেন্টকে ভর্তি করানোর জন্য যেভাবে ডাক্তারের সন্ধানে দৌড় দিতে হয় তেমটা নয়।
আসলে মন্টু ছুটছিল পেছন থেকে ঠিক পিঠ বরাবার এগিয়ে আসা বুলেটটাকে এড়াতে। হৃৎপিন্ডটাকে এফাল ওফাল করার আগে পর্যন্ত মন্টু ছুটছিল। আর তার মনে পড়ে যাচ্ছিল...
আদিগন্ত একটা ধান ক্ষেত।
তালগাছে একটা হুতুম পেঁচার বাসা।
বিশ্বকর্মা পুজোয় একতে ঘুড়ির মার কাট্টা প্যাঁচ।
চ্যাটচেটে ঘেমো দুপুরে নুন শোয়ের দুটো টিকিট।
বাবার হাত ধরে প্রথম সমুদ্রের জলের নোনা স্বাদ।
নীল জলে মাখামাখি।
মন্টু নীল জলের ঢেউয়ে স্নান করছিল। তার চার পাশে ভরে উঠছিল লাল রঙের একটা নিশান। আসলে মন্টু একটা সুইমিং পুলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার চারপাশের স্বছ স্ফটিক নীল সাদা জল লাল হয়ে উঠছিল তারই ফুসফুস বিদীর্ন রক্তে।
ঠিক সেই সময় মন্টু স্বপ্ন দেখতে চাইছিল বাঁচার। ঘ্রাণ নিচ্ছিল রক্তের। শ্বাস নালী ভর্তি হয়ে উঠছিল গর্ভস্থ থাকার সময়ে মুখের মধ্যে জমে থাকা নবজাতকের শ্লেষায়। আসলে মন্টু জন্ম নিচ্ছিল একটা পেয়ারা গাছের নীচে। ধাত্রী মা চেপে ধরেছিল কিছুটা বেরিয়ে আসা তার মাথার অংশটা। আর সেই কবেকার, কোন যুগের পৃথিবীর গভীর রক্তের উচাটন থেকে...গর্ভের অন্তর্লীন অন্ধকার জগত থেকে আস্তে আস্তে একটু একটু করে মন্টুর সামনে উঁকি দিচ্ছিল রাতের আঁধারে তারায় ভরা এক আকাশ। মন্টু চমৎকার একটা চিৎকার করেছিল।
বুলেটটা ঠিক তার পিঠ বরাবর গেঁথে যাওয়ার পর।
প্রথম প্রেমের চিঠির উত্তর আসার পর...।
জীবনে প্রথম ব্ল্যাক টিকিটে সিনেমা দেখার আনন্দে...।
শরীরে প্রথম যৌন অনুভূতি আবিষ্কারের মুহূর্তে।
একটা শহরের রাজা হওয়ার পর।
সেই চিৎকারের রেশ ছড়িয়ে পড়ছিল এক দামী সংবাদ পত্রের অফিসে। পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণায়মান স্যাটেলাইটের মধ্যস্থতায়। আরো জটিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক দৃশ্য ও শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে ছোট্ট একটা ভিডিয়ো টেপে...এক সাংবাদিকের ক্যামেরা থেকে।
“নীলাভ আপনি শুনতে পাচ্ছেন কী? আমি দাঁড়িয়ে আছি শহরের এক ফাইভস্টার হোটেলের চোদ্দ তলার সুইমিং পুলের ধারে...। নীলাভ আপনি দেখতে পাচ্ছেন কি? আমার সামনে জলের ওপরে চিৎ হয়ে ভাসছে এই শহরের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল মন্টু...ওরফে অমিতাভ...ওরফে সরকার...”।
নীলাভ ঠিক শুনতে পাচ্ছিল কিনা বুঝতে পারছিলো না ওরা কেউ। নীলাভ ঠিক দেখতে পাচ্ছিল কিনা ঠাহর করতে পারছিলো না ওরা কেউ। ওরা আরো তাড়ায় ছিল আকাশের মাঝামাঝি হাল্কা বাতাসের স্তরটাকে ধরার জন্যে। ওখানে ওদের উড়তে সুবিধে হয়। ওখানে উড়লে বাইপাসের পাশে কিম্বা রাজারহাটের দিকে এখোনো জেগে থাকা দু-একটা মরা ক্ষেতের সন্ধান পাওয়া যায়। ছোট ছোট ইদুর গুলো এখোনো খাবারের সন্ধানে মরা ক্ষেতের মাঝে হা-হুতাশ করতে বেরোলে সেই হাল্কা বাতাসের স্তর থেকে সহজেই উড়ে এসে ছোঁ-মারা যায়। ভোরের অনেক আগে বাসায় ফেরা যায়, যে বাসা তাদের দিয়েছে এক নাগরিক লাঞ্ছনা। গাছের বদলে দশতলার চিলে কোঠার এক ফাঁকা কোঠর। যে কোঠর বানানো হয়েছে মন্টুরই সাপ্লাই করা ইঁট, বালি, সিমেন্টে। তাই সত্যিই সেই ভুতুম পেঁচার দলটার একটুও অবকাশ ছিল না মন্টুর দিকে ফিরে দেখার। যদিও সবচেয়ে কাছের দূরত্ত্বে ছিল তারাই। জন্মের সময়ে...রাজা হওয়ার দিন গুলোতে...মৃত্যুর পরেও।
মন্টু তখোনো জানতো না মাতৃ গর্ভের ওম থেকে বেরিয়ে এসে সে এক তারায় ভরা আকাশ দেখতে পাবে। মন্টু তখোনো জানতো না গভীর রাতের অন্ধকারে গাছের সবুজ পাতাকে দেখায় কালো। মন্টু তখোনো জানতো না তার জন্মানোর কিছুক্ষণ পরেই আকাশবানী কোলকাতা থেকে খবর পড়বেন বরুণ মজুমদার। মন্টু তখোনো জানতো না সে এক ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী। মন্টু তখোনো জানতো না স্বাধীনতার আঠাশ বছর পরে দেশে এই প্রথম জারী হচ্ছে জরুরী অবস্থা। মন্টু তখোনো জানতো না এই নতুন জন্ম তাকে ফিরে দেখতে হবে আরো অনেক বছর পরে কোনো এক পাঁচতারা হোটেলের সুইমিং পুলে। তারই ফুসফুসের রক্তেভেজা নীল-সাদা স্ফটিক জলে।
মন্টু ওরফে অমিতাভ ওরফে সরকার এখন একটা ফাইল। সেই হলদেটে ক্ষয়াটে ফাইলটা পড়ে আছে তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নাম্বার ড্রয়ারে। ওই ফাইলটা খোলা হবে না আর কোনোদিন। খোলা হবে না কারণ ওই ফাইল না খোলার জন্য অনেক নোটের তাড়া জমা পড়েছে বিভিন্ন দফতরে। অনেক লোকের মুখ বন্ধ করা হয়েছে গুম করে, না করে, অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখিয়ে। যে ক্যামেরা সেদিন সেই তারায় ভরা আকাশে সুইমিং পুলের রক্তে ভেজা জলে মন্টুর চিৎ হয়ে সাঁতার কাটার ছবি তুলেছিল; আজ, এখন এই মুহূর্তে সে শহরে একটা শ্যুটিং এর মহরত তুলতে ব্যাস্ত। রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই। জ্যাম জটে শহর নাজেহাল। নতুন সরকার কলকাতাকে প্রোমোট করছেন। তাই উড়ে এসে জুড়ে বসলে কলকাতায় সব ফ্রি। কলকাতার নগর...রাস্তাঘাট...কলকাতার ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট জীবন...কলকাতার রসগোল্লা...কালীঘাট...মাদার টেরিজা...সত্যজিৎ... বাস স্ট্যান্ড...সবটাই এখন ছবির ফ্রেম। বোম্বের পরিচালক হাত দিয়ে দিয়ে ক্যামেরার সেই অদৃশ্য ফ্রেমটাকেই নিরূপণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে তার হাত গলে যে মন্টু ঢুকে পড়ল তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না।
আর ঠিক সেই সময়ে সাদা পর্দায় ভেসে উঠলো অমিতাভ।
একটা ভাঙা সিনেমা হল।
একটা লু লাগা দুপুর...।
মিঠাই বরফ...।
পরিচালক চিৎকার করে বলে উঠলেন এ্যাকশান। রাস্তার ধারে ভিড়ে ঠাসা জনতা দেখলো ঝাঁ-চকচকে শহরের ফিটফাট রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছেন অমিতাভ। যে রাস্তার ইঁট...বালী...সিমেন্ট...পিচ...খোয়া...সাপ্লাই করেছিল মন্টু...।
যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিল সে হবে এই শহরের ‘মন্টু ওরফে অমিতাভ ওরফে সরকার’...।
পর্ব-২
ঝাঁ-চকচকে শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল বহুতলের ওপরে, সৌর বিদ্যুতের অসংখ্য চাকতি
লাগানো এ্যান্টেনার নীচে, একটা গুপ্ত ঘর আছে। সেটাকে ঠিক গুপ্ত বলা যায় কিনা সে বিষয়ে
সন্দেহ থাকতে পারে। যাহা চোখের সামনে বিরাজমান, তাহা গুপ্ত হয় কেমনে? ভাষা-বিদ্যার
লোকজনেরা চোখ পাকাতেই পারেন। প্রশ্ন করতেই পারেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও চোখের সামনে
দন্ডায়মান ঘরটা গুপ্তই। কেউ ওখানে প্রবেশ করেনা সচরাচর। সভ্য জামাকাপড় পড়া পাহাড়াদাররা
ওটাকে বলে মেশিন ঘর।
নীচের উঠোন থেকে বাইশতলার মেশিন ঘরের হদিশ তারাও খুব একটা রাখে না। রাখলে জানতে পারতো ওখানে ছড়িয়ে আছে রাশি কৃত বিদ্যুৎবাহী তার মাকড়সার জালের মতো। তারা ছড়িয়ে পড়েছে কংক্রিটের পাঁজরে পাঁজরে। এ- বি- সি ব্লকে। শহরের তথাকথিত সেলিব্রিটিদের খাঁচায় খাঁচায়। যাঁরা এক মুহূর্ত ঠান্ডা ছাড়া থাকতে পারেন না। যাঁরা এই মুহূর্তে জমিয়ে রেখেছেন নিজেদেরকে হিমাঙ্কের নীচে।
হঠাৎ ট্রান্সফরমার উড়ে গেলে...
শহরে হঠাৎ ঝড় উঠলে...
নিছকই অসাবধানতায় অন্ধকার নেমে এলে...
ভোটের আগের দিন বদমাইশের লোডশেডিং হলে...
গোটা শহরকে কানা করে এই বহুতলে আলো জ্বলে ওঠে। সেই সময় এই ঘরে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ইলেকট্রনিক মেশিন গুলো হঠাৎই কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। চিক চিক...টিক টক...পিঁ পিঁ শব্দ তুলে। এই ভাষা, এই ঘরে আশ্রিত উদ্বাস্ত ভুতুম পেঁচার দলটা বুঝতে পারে না। প্রাথমিকে ইংরাজী শিক্ষা তুলে দেওয়ার ভুলে বাঙালীরা যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি এক অবাধ্য আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয় ভুতুমের দলটি। কুলকুন্ডলিনী যোগে তখন তারা ডানা ঝাপটায়। দেওয়ালে গা ঘষে। অথবা রাতের অন্ধকারে উড়ে যায় খেতে না পাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া ইঁদুর গুলোকে ধরতে। ওরা চলে গেলে ঘর ফাঁকা হলে নজরে পড়ে দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা স্টিকার। যা বহুদিন আগে মন্টু সেঁটে দিয়েছিল নিজের অজান্তে।
তার মন্টু নামটা খসিয়ে দেওয়ার পরে।
অমিতাভ হবার সূচনায়।
সরকার হবার দিবা স্বপ্নের ক্রান্তিলগ্নে।
ঠিক এই মুহূর্তে রাজ্যে যখন নতুন সরকার শপথ নেবে। গোটা রাজ্যে বিজয় উল্লাসের মিছিল থেকে ঢাকের দ্রিম দ্রিম শব্দের বদলে মানুষের চামড়া বাজানোর চড়াম চড়াম আওয়াজ নির্গত হবে। তখনও লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নম্বর ড্রয়ারে একটা হলুদ ফাইল ঘুমিয়ে থাকবে। যাকে আর কেউ কোনো দিন জাগাবে না। পাতা গুলো উলটে দেখবে না। মেটা ডেটা ফাইলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের আর্কাইভে সংরক্ষণ হবে না। মন্টু নামটা ধূসর অতীত হয়ে ঝুলে থাকবে একটা হারিয়ে যাওয়া, ভেঙে ফেলা, বর্তমান প্রজন্মের না দেখা সিনেমা হলের প্রজেক্সান রুমে।
গঙ্গার ধারে মহাদেব জুটিমিলের নাগকেশর ফুল গাছের তলায়।
একটা উচ্চমাধ্যমিকে স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর লাস্ট বেঞ্চে।
এক বহুতল বিলাসবহুল বাড়ির মেশিন ঘরে।
দুঃখের বিষয়টা হলো মন্টু নিজেও, মারা যাবার এতোগুলো বছর পরেও মেনে নিতে পারে না তার সাক্ষী থাকা সেই হলুদ ফাইলটার মধ্যে কোথাও এই জায়গা গুলোর নাম নেই। এমনকি লেখা নেই মেশিন ঘরের দেওয়ালে ধূসর হওয়া এক স্টিকারের কথা। যেখানে অমিতাভ হাতে একটা বাজ পাখি নিয়ে ঠোঁটের কোনে বিড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীচে পেন্সিলের কয়েকটা হরফ। ‘মন্টু অমিতাভ হতে চেয়েছিল’।
যা নেই তা নিয়ে কথকের মাথা ব্যাথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যা আছে তা নিয়ে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। হলুদ রঙের ফাইলটার মধ্যে সুইমিং পুলের নীল জলে মন্টুর ক্ষত বিক্ষত দেহের সাঁতার কাটার ছবি ছাড়াও রয়ে গেছে বেশ কিছু তাবড় শুহুরে বিখ্যাত বেঁচে থাকা মনীষীদের ছবি। একজন কবি, একজন চিত্র পরিচালক, পার্কস্ট্রিটের এক পরিচিত ম্যাসাজ পার্লারের ছেলে-বেশ্যা, আর একজন দালাল। এদের মধ্যে শেষ দুজনকে গুম করে ফেলা হয়েছে। কবি, চিত্র পরিচালককে ছোঁওয়া যায়নি। সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকার কথা ভেবে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে নেওয়া হয়েছে। এইসব হুজ্জুতিতে তাদের কিছু এসে যায়নি। বোম্বে ফেরত পরিচালক এখন শহরে শ্যুটিং করছেন। কবি তাঁর তেত্রিশ খন্ডের শেষ কবিতাটা নিয়ে মক্সো করছেন। আর ঠিক তখনি তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের এক লুকোনো ছোট্ট ঝাঁ চকচকে মাসাজ পার্লার। এক আঠারো পেরোনো ছেলে। তার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁওয়া। কবি কলম রাখলেন পাশে।
ভুতুম গুলো ডানা ঝাপটালো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাছে ও দূরের পথ নিরীক্ষণ করতে থাকলো। আর কবি কলম তুলে নিয়ে একটা পেল্লাই শব্দের আঁক কষতে গিয়ে হঠাৎ মনে করে ফেললেন সেই লোড শেডিং রাতের কথা। পুলিশ এসে দরজা ধাক্কালো। বরুণ মজুমদার আকাশবাণী কলকাতা থেকে খবর পড়লেন। দিল্লীর দরবার থেকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা হলো। এক আকাশ তারার মাঝে মন্টু জন্মালো পেয়ারা গাছের নীচে। কবিকে ডেকে তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী একটা অফার দিলেন। শব্দ গুলো দুমড়ে, মুচড়ে ভেঙে ফেলার। কবি তার সামনে দুমড়ে মুচড়ে শব্দ গুলোকে ভেঙে ফেললেন। সে বছর শারদীয় পত্রিকায় তার সতীর্থদের বাদ দিয়ে একমাত্র তারই গুচ্ছ কবিতা বেরোলো। অনেক পরে সেই কবিতার বই হাতে এলে মন্টু সাজিয়েছিল আলমারীর তাক। তারও অনেক পরে এই কবির সাথে মন্টুর যখন দেখা হলো তখন অবাক বিস্মরণে ধাঁধিয়ে গিয়েছিল চোখ তার। বৃদ্ধ কবির ঠোঁট ছোওয়ানো ছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো এক ছেলের ঠোঁটে। বাসনা ছিল এক কবিতা জন্মানোর। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
মর্গের টেবিলে মন্টুর উদোম হওয়া দেহের থেকে রাশীকৃত বুলেট বার করতে গিয়ে ডোমটা দেখেছিল তার ভুরুর পাশে কাটা দাগ। তার ঠোঁটের নীচে একটা ছোট্ট তিল। তার নাভির অসামঞ্জস্যতা। তারও নীচে তাকাতে গিয়ে ডোমটার হিসি পেয়েছিল। আর মন্টু শুয়েছিল পাশ ফিরে। তার শীত করছিলো। নিরাভরণ শরীর থেকে প্রাণের যাবতীয় উষ্ণতা চলে যাবার পর নিজেকে তার কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিলো। হালকা লাগছিলো মাথা। ওপড়ানো খুলিটার ভেতর দিয়ে হাওয়া ঢুকছিলো। বুকের কাটা অংশ থেকে হৃৎপিন্ড উঁকি দিচ্ছিলো অল্প অল্প করে। বীরেন ভদ্র রেডিওতে মহালয়ার স্তোত্র পাঠ করছিলেন। খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিলো ভোরের শিউলির গন্ধ। আর ঠিক তখনি মন্টুর মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ইচ্ছে করছিলো মাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে। যে মাকে সে হারিয়েছে সেই কবেকার পেয়ারা গাছের তলায়। জন্মানোর সময়। এক আকাশ তারার নীচে।
ডোম ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়েছিল। জীবনে প্রথম লাশকে পাশ ফিরে শুতে দেখে উল্লুক বনে গিয়েছিল সে। চোখে মুখে জল দেওয়ার পরেও নিশ্বাসের সাথে বাংলার ঝাঁঝালো গন্ধটা মন্টুর ঠিক নাকের পাশে এসে পড়ছিল। লোকটা মাথা নীচু করে সেলাই করছিল মন্টুর কপাল। যে কপালে সে না হতে পারলো মন্টু। না হতে পারলো অমিতাভ। না হতে পারলো সরকার।
তাহলে মন্টু ঠিক কী হয়েছিল?
মন্টু হয়েছিল এক মৃত প্রায় অঞ্চলের সময়। যে সময় তাকে দিয়ে এমন একটা কাজও করায়নি যা আসলে মন্টু করতে চেয়েছিল।
ওয়াগান ভাঙা। লুঠ। গুম করে দেওয়া। রাহাজানি। সিন্ডিকেট রাজ। অনৈতিক ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট। লোহার ছাঁট। মন্ত্রী কেনা-বেচা। বর্ডারের ওপারে গরু পাচার। সবশেষে নিজেই আইন হয়ে যাওয়া। এমন এক গুচ্ছ নালিশের লাল কালির তালিকা ওই হলুদ ফাইলে দাগানো আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যেটা নেই সেটা হল মন্টু আসলে অমিতাভ হতে চেয়েছিল। মন্টু চেয়েছিল এই রাজ্যের সরকার হতে।
গোটা দেহ সেলাই হয়ে গেলে ডোম ভেবেছিল নতুন জন্ম পেলো যেন ছেলেটা।
সেদিন আবার আকাশে তারা উঠেছিল।
ভ্যাপসা দম বন্ধ করা পচা মাংসের ঘরে ঢুকে পড়েছিল শিউলির সুবাস।
শুধু
সেদিন বরুণ মজুমদার খবর পড়ছিলেন না।
বাংলায় আরো বেশি করে যাতে মন্টুদের জন্ম হয় তার দিকে নজর রাখছিলেন কলম পাশে রাখা সেই পুলিশ মন্ত্রীর কবি।
নীচের উঠোন থেকে বাইশতলার মেশিন ঘরের হদিশ তারাও খুব একটা রাখে না। রাখলে জানতে পারতো ওখানে ছড়িয়ে আছে রাশি কৃত বিদ্যুৎবাহী তার মাকড়সার জালের মতো। তারা ছড়িয়ে পড়েছে কংক্রিটের পাঁজরে পাঁজরে। এ- বি- সি ব্লকে। শহরের তথাকথিত সেলিব্রিটিদের খাঁচায় খাঁচায়। যাঁরা এক মুহূর্ত ঠান্ডা ছাড়া থাকতে পারেন না। যাঁরা এই মুহূর্তে জমিয়ে রেখেছেন নিজেদেরকে হিমাঙ্কের নীচে।
হঠাৎ ট্রান্সফরমার উড়ে গেলে...
শহরে হঠাৎ ঝড় উঠলে...
নিছকই অসাবধানতায় অন্ধকার নেমে এলে...
ভোটের আগের দিন বদমাইশের লোডশেডিং হলে...
গোটা শহরকে কানা করে এই বহুতলে আলো জ্বলে ওঠে। সেই সময় এই ঘরে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ইলেকট্রনিক মেশিন গুলো হঠাৎই কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। চিক চিক...টিক টক...পিঁ পিঁ শব্দ তুলে। এই ভাষা, এই ঘরে আশ্রিত উদ্বাস্ত ভুতুম পেঁচার দলটা বুঝতে পারে না। প্রাথমিকে ইংরাজী শিক্ষা তুলে দেওয়ার ভুলে বাঙালীরা যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি এক অবাধ্য আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয় ভুতুমের দলটি। কুলকুন্ডলিনী যোগে তখন তারা ডানা ঝাপটায়। দেওয়ালে গা ঘষে। অথবা রাতের অন্ধকারে উড়ে যায় খেতে না পাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া ইঁদুর গুলোকে ধরতে। ওরা চলে গেলে ঘর ফাঁকা হলে নজরে পড়ে দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা স্টিকার। যা বহুদিন আগে মন্টু সেঁটে দিয়েছিল নিজের অজান্তে।
তার মন্টু নামটা খসিয়ে দেওয়ার পরে।
অমিতাভ হবার সূচনায়।
সরকার হবার দিবা স্বপ্নের ক্রান্তিলগ্নে।
ঠিক এই মুহূর্তে রাজ্যে যখন নতুন সরকার শপথ নেবে। গোটা রাজ্যে বিজয় উল্লাসের মিছিল থেকে ঢাকের দ্রিম দ্রিম শব্দের বদলে মানুষের চামড়া বাজানোর চড়াম চড়াম আওয়াজ নির্গত হবে। তখনও লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নম্বর ড্রয়ারে একটা হলুদ ফাইল ঘুমিয়ে থাকবে। যাকে আর কেউ কোনো দিন জাগাবে না। পাতা গুলো উলটে দেখবে না। মেটা ডেটা ফাইলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের আর্কাইভে সংরক্ষণ হবে না। মন্টু নামটা ধূসর অতীত হয়ে ঝুলে থাকবে একটা হারিয়ে যাওয়া, ভেঙে ফেলা, বর্তমান প্রজন্মের না দেখা সিনেমা হলের প্রজেক্সান রুমে।
গঙ্গার ধারে মহাদেব জুটিমিলের নাগকেশর ফুল গাছের তলায়।
একটা উচ্চমাধ্যমিকে স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর লাস্ট বেঞ্চে।
এক বহুতল বিলাসবহুল বাড়ির মেশিন ঘরে।
দুঃখের বিষয়টা হলো মন্টু নিজেও, মারা যাবার এতোগুলো বছর পরেও মেনে নিতে পারে না তার সাক্ষী থাকা সেই হলুদ ফাইলটার মধ্যে কোথাও এই জায়গা গুলোর নাম নেই। এমনকি লেখা নেই মেশিন ঘরের দেওয়ালে ধূসর হওয়া এক স্টিকারের কথা। যেখানে অমিতাভ হাতে একটা বাজ পাখি নিয়ে ঠোঁটের কোনে বিড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীচে পেন্সিলের কয়েকটা হরফ। ‘মন্টু অমিতাভ হতে চেয়েছিল’।
যা নেই তা নিয়ে কথকের মাথা ব্যাথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যা আছে তা নিয়ে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। হলুদ রঙের ফাইলটার মধ্যে সুইমিং পুলের নীল জলে মন্টুর ক্ষত বিক্ষত দেহের সাঁতার কাটার ছবি ছাড়াও রয়ে গেছে বেশ কিছু তাবড় শুহুরে বিখ্যাত বেঁচে থাকা মনীষীদের ছবি। একজন কবি, একজন চিত্র পরিচালক, পার্কস্ট্রিটের এক পরিচিত ম্যাসাজ পার্লারের ছেলে-বেশ্যা, আর একজন দালাল। এদের মধ্যে শেষ দুজনকে গুম করে ফেলা হয়েছে। কবি, চিত্র পরিচালককে ছোঁওয়া যায়নি। সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকার কথা ভেবে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে নেওয়া হয়েছে। এইসব হুজ্জুতিতে তাদের কিছু এসে যায়নি। বোম্বে ফেরত পরিচালক এখন শহরে শ্যুটিং করছেন। কবি তাঁর তেত্রিশ খন্ডের শেষ কবিতাটা নিয়ে মক্সো করছেন। আর ঠিক তখনি তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের এক লুকোনো ছোট্ট ঝাঁ চকচকে মাসাজ পার্লার। এক আঠারো পেরোনো ছেলে। তার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁওয়া। কবি কলম রাখলেন পাশে।
ভুতুম গুলো ডানা ঝাপটালো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাছে ও দূরের পথ নিরীক্ষণ করতে থাকলো। আর কবি কলম তুলে নিয়ে একটা পেল্লাই শব্দের আঁক কষতে গিয়ে হঠাৎ মনে করে ফেললেন সেই লোড শেডিং রাতের কথা। পুলিশ এসে দরজা ধাক্কালো। বরুণ মজুমদার আকাশবাণী কলকাতা থেকে খবর পড়লেন। দিল্লীর দরবার থেকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা হলো। এক আকাশ তারার মাঝে মন্টু জন্মালো পেয়ারা গাছের নীচে। কবিকে ডেকে তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী একটা অফার দিলেন। শব্দ গুলো দুমড়ে, মুচড়ে ভেঙে ফেলার। কবি তার সামনে দুমড়ে মুচড়ে শব্দ গুলোকে ভেঙে ফেললেন। সে বছর শারদীয় পত্রিকায় তার সতীর্থদের বাদ দিয়ে একমাত্র তারই গুচ্ছ কবিতা বেরোলো। অনেক পরে সেই কবিতার বই হাতে এলে মন্টু সাজিয়েছিল আলমারীর তাক। তারও অনেক পরে এই কবির সাথে মন্টুর যখন দেখা হলো তখন অবাক বিস্মরণে ধাঁধিয়ে গিয়েছিল চোখ তার। বৃদ্ধ কবির ঠোঁট ছোওয়ানো ছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো এক ছেলের ঠোঁটে। বাসনা ছিল এক কবিতা জন্মানোর। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
মর্গের টেবিলে মন্টুর উদোম হওয়া দেহের থেকে রাশীকৃত বুলেট বার করতে গিয়ে ডোমটা দেখেছিল তার ভুরুর পাশে কাটা দাগ। তার ঠোঁটের নীচে একটা ছোট্ট তিল। তার নাভির অসামঞ্জস্যতা। তারও নীচে তাকাতে গিয়ে ডোমটার হিসি পেয়েছিল। আর মন্টু শুয়েছিল পাশ ফিরে। তার শীত করছিলো। নিরাভরণ শরীর থেকে প্রাণের যাবতীয় উষ্ণতা চলে যাবার পর নিজেকে তার কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিলো। হালকা লাগছিলো মাথা। ওপড়ানো খুলিটার ভেতর দিয়ে হাওয়া ঢুকছিলো। বুকের কাটা অংশ থেকে হৃৎপিন্ড উঁকি দিচ্ছিলো অল্প অল্প করে। বীরেন ভদ্র রেডিওতে মহালয়ার স্তোত্র পাঠ করছিলেন। খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিলো ভোরের শিউলির গন্ধ। আর ঠিক তখনি মন্টুর মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ইচ্ছে করছিলো মাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে। যে মাকে সে হারিয়েছে সেই কবেকার পেয়ারা গাছের তলায়। জন্মানোর সময়। এক আকাশ তারার নীচে।
ডোম ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়েছিল। জীবনে প্রথম লাশকে পাশ ফিরে শুতে দেখে উল্লুক বনে গিয়েছিল সে। চোখে মুখে জল দেওয়ার পরেও নিশ্বাসের সাথে বাংলার ঝাঁঝালো গন্ধটা মন্টুর ঠিক নাকের পাশে এসে পড়ছিল। লোকটা মাথা নীচু করে সেলাই করছিল মন্টুর কপাল। যে কপালে সে না হতে পারলো মন্টু। না হতে পারলো অমিতাভ। না হতে পারলো সরকার।
তাহলে মন্টু ঠিক কী হয়েছিল?
মন্টু হয়েছিল এক মৃত প্রায় অঞ্চলের সময়। যে সময় তাকে দিয়ে এমন একটা কাজও করায়নি যা আসলে মন্টু করতে চেয়েছিল।
ওয়াগান ভাঙা। লুঠ। গুম করে দেওয়া। রাহাজানি। সিন্ডিকেট রাজ। অনৈতিক ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট। লোহার ছাঁট। মন্ত্রী কেনা-বেচা। বর্ডারের ওপারে গরু পাচার। সবশেষে নিজেই আইন হয়ে যাওয়া। এমন এক গুচ্ছ নালিশের লাল কালির তালিকা ওই হলুদ ফাইলে দাগানো আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যেটা নেই সেটা হল মন্টু আসলে অমিতাভ হতে চেয়েছিল। মন্টু চেয়েছিল এই রাজ্যের সরকার হতে।
গোটা দেহ সেলাই হয়ে গেলে ডোম ভেবেছিল নতুন জন্ম পেলো যেন ছেলেটা।
সেদিন আবার আকাশে তারা উঠেছিল।
ভ্যাপসা দম বন্ধ করা পচা মাংসের ঘরে ঢুকে পড়েছিল শিউলির সুবাস।
শুধু
সেদিন বরুণ মজুমদার খবর পড়ছিলেন না।
বাংলায় আরো বেশি করে যাতে মন্টুদের জন্ম হয় তার দিকে নজর রাখছিলেন কলম পাশে রাখা সেই পুলিশ মন্ত্রীর কবি।
পর্ব-৩
স্নেহের
বরেণ,
মানিকচকের
বাজারসরকার মারফৎ সংবাদ পেলাম তোমার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। বংশের পিদিম
জ্বালাবার লোকের যে অভাব ছিল তা বুঝি এবার ঘুঁচলো। সঙ্গে একটি দুঃসংবাদে হতবাক
হলাম।
সন্তান প্রসবকালে তোমার স্ত্রী রানীর অকাল মৃত্যু। তুমি আর কি করবে বাবা?
সবই বিধির বিধান। শোকে পাথর হবার সময় এটা নয়। বুক বেঁধে আবার গড়ে তোলো সংসার। পত্র
মারফৎ বাজার সরকারের কনিষ্ঠা কন্যা শিউলী রানীর একটি ফটো তোমাকে পাঠালাম। কন্যা
রূপবতী না হলেও গুণবতী বটে। সেলাই ফোড়াই, রান্না-বান্নার কাজে সিদ্ধহস্ত। প্রাথমিক
শিক্ষার ব্যাপারেও সে দড়। নিজ নাম সহী সহ অক্ষর জ্ঞানের পরিচিতি তার আছে। তোমার
ভাঙা সংসার জোড়া লাগলে সবচেয়ে খুশী হব আমি। এই বয়েসকালে সব কিছু জোড়া এবং গোটায়
গোটায় দেখতে চাই। আজকাল চোখে ভালো দেখি না। অদ্যাবধি লেখার অভ্যাসটাও গেছে। পোষ্ট
অফিসের এই কেরানী ছোকরাটিকে চার-আনা বকশিস দিয়ে পত্র লেখাতে হয়। পত্র-পাঠ উত্তর
দেবে। আমি তোমার বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ করবো।
আশীর্বাদান্তে
সকল মঙ্গল
সূচক খবরের আশায়
তোমার
জ্যাঠামশায়
পুনশ্চঃ
তামাকুর ভালো তামাক পাইলে একটু পাঠিও বাবা। বর্তমানে ওই নেশাটিই বিদ্যমান। আর সব
তো সঙ্গ ছেড়েছে। গাঁয়ে গঞ্জে কলকাতার মতো ভালো তামাক পাই কোথা? শুনলাম শহরে নাকি বিস্তর
গন্ডগোল। ধড় পাকড় চলছে। যদিও এখানে তার লেশমাত্র নেই। তোমার বসানো সাদা গোলাপে
কুঁড়ি এসেছে। ভালোকথা দাদাভাইয়ের নামকরণে তাড়াহুড়ার দরকার নাই। উহার জন্মছক মিলিয়ে
নামকরণ করা লাগবে। জন্মের সময় দিনক্ষণ শীঘ্রই পাঠাবা। ওর জন্যে তো আর কিছু রেখে
যেতে পারবো না। নামটাই না হয় আমার দেওয়া থাকলো।
বৃদ্ধ
পুরুষের বজ্র গম্ভীর কন্ঠে অফ ভয়েজে এই চিঠিটা পড়া শেষ হওয়া মাত্রই আসবে ছবির
টাইটেল কার্ড। সেখানে স্পষ্টভাবে বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকবে...
রানী
ফিল্মস প্রযোজিত
মন্টু
সরকার পরিচালিত
বাংলায়
প্রথম গ্যাঙস্টার মুভি
অমিতাভ।
ছবিটা শেষ
পর্যন্ত হয়নি। তার আগেই মন্টু মারা গিয়েছিল। মেরে ফেলা হয়েছিল লালবাজারের সাজানো
চিত্রনাট্য অনুযায়ী। দাদুর চিঠিটা অনেকদিন পড়েছিল সেই কবেকার ছোট্টবেলার মন্টুর
রাঙতা জমানো খেলার বাক্সে। তার সাথে ছিল হলদেটে হয়ে যাওয়া সাদা কালো একটা মেয়ে।
ক্যামেরার দিকে ভয়ের চোখে তাকিয়ে। নাকে নোলক ছিল। কানে সোনার রিং ছিল। আর চোখ দুটো
ছিল হরিণের মতো সরল।
চিঠি পেয়ে
বরেণ আর অপেক্ষা করেনি। আরও একটু গুছিয়ে বললে বলা ভালো, করতে দেওয়া হয়নি বরেণকে।
ঘাড় ধরে মরা বউয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মানিকচকে। প্রথম বৌয়ের
পারলৌকিক নমো নমো করে সেরেই শিউলী রানীর সাথে বিয়ে হয়েছিল তার। ফুল শয্যার রাতে
শুতে এসে বরেণ আবিষ্কার করেছিল শিউলির উন্মুক্ত বুকে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে জন্মের
সময়ে মা খাওয়া দিন পনেরোর এক ছেলে। সেদিন থেকেই মনে হয় চক্ষুশূল হয়েছিল ছেলেটি
তার। পারতপক্ষে মন্টুকে দেখতে পারতো না তার বাবা। মন্টুও দেখতে চায়নি তার বাবাকে।
সেই আক্রোশেই কিনা ঠিক জানা যায় না নব বিবাহিতা যুবতী মেয়েটির স্তনদুটি ছিঁড়ে
খেয়েছিল মন্টু সেই পনেরো দিনের বয়স থেকে বছর সাত পর্যন্ত। দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে
ডলে ডলে সে দুধহীন স্তন থেকে দুধ বার করার চেষ্টা চালিয়ে যেত। আর একটু বড় হলে সেই
মেয়েটিকে দেখতো নিরাভরণ হয়ে বাবার সাথে সাপের মতো পেঁচিয়ে শুয়ে থাকতে। মাঝে মাঝে
সেই প্যাঁচানো শরীরের ওম পেতে মন্টু জেগে উঠতো। হামা দিয়ে এগিয়ে যেত খাটের
শেষপ্রান্তে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো মেঝের দিকে। একদিন মিলন যখন তুঙ্গে সেই
সময় মন্টু খাট থেকে পড়ে গিয়েছিল। এক ফোঁটাও কাঁদেনি সে। দুধহীন মুখে নিজের রক্তের
স্বাদটা সেই প্রথম পেয়েছিল সে। বাঁদিকের ভুরুর ওপরে কাটা দাগটা তখন থেকেই। যে কাটা
দাগটার ওপরে চুমু খেয়েছিল ডোমটা মন্টুর প্রাণহীন কপালে সেলাই করার সময়ে। ততদিনে এইসবে
অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সে।
বাংলা
ব্যাকরণের লিঙ্গ হিসেবে কার শরীর যে মন্টুকে বেশি প্রলুব্ধ করতো তা নিয়ে বিশেষ
মাথা ব্যাথা ছিল তার সেই বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই। মেয়েদের শরীর তাকে টানতো না। একথা
হলফ করে বুঝেছিল মন্টু। বুক দেখলেই দুধহীন শিউলীরানীর স্তন গুলোর কথা মনে পড়তো।
সাপের মতো জড়ানো পেঁচানো দুটো শরীরের শিৎকারের শব্দ কানে আসতো। ক্লাস এইটে দুবার
ফেল করার পর হেডস্যার যখন শেষবারের মতো তাকে সুযোগ দিলেন আর একবার ক্লাসে থেকে পাশ
করার কঠিন শপথের দিকে ঠিক সেইদিন বিকেলে রাস্তা দিয়ে খেলতে যাওয়ার সময় বিশু তাকে
ডেকেছিল পাতকো তলার পাশ থেকে। মন্টু একটু একটু করে এগোচ্ছিল। বিশু চান করছিলো
বালতি বালতি জল তুলে। সাদা একটা ফিনফিনে গামছায় ফুটে উঠছিলো তার শরীরের সব লেখা,
আঁকা-জোকা। তার শরীরের স্তুপ এবং ভঙ্গিল পর্বত গুলো। “আমি যখন স্নান করি হাঁ করে
তাকিয়ে থাকিস কেন রে তোদের দোতলার জানলা থেকে?” বিশুর প্রশ্নে শিরদাঁড়া দিয়ে জল
নামতে শুরু করেছিল মন্টুর। মনে হচ্ছিল তার শরীরের রক্ত প্রবাহে শীতলতার মাত্রা
বেড়ে গেছে। পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকা ফর্সা লম্বা বিশুকে দেখতে ভালো লাগতো মন্টুর।
কেন ভালো লাগতো সে জানতো না। জানার কারণ ছিল যদিও অনেক। কিন্তু মন্টু মানব মনের
গভীর গহনে ঝাঁপ দিতে ভয় পেতো। বিজ্ঞান স্যার বর্ষাকালে ব্যাঙের মিলন পদ্ধতি
ব্যাখ্যা করলে শেষ বেঞ্চে বসে মন্টু ঘামতো। বাড়ি ফিরে বাথরুমে কেটে যেত কয়েকঘন্টা।
শুধু চোখ থাকতো বিজ্ঞান বইয়ের লাইন দুটোর ওপর। দমবন্ধ হয়ে আসতো তার। হাত ব্যাথা
করে উঠতো। অসুস্থ শিউলী রাণী দরজায় ধাক্কা দিতো “ও মন্টু...ও বাবা...কী করিস?
অবেলার ভাত যে ঠান্ডা হয়ে যায়”। তারও অনেক পরে চোখ লাল করে মন্টু বাথরুম থেকে
বেরোতো। মনে হতো অনেকক্ষণ ধরে ছেলেটা হয়তো কেঁদেছে। বিশু গালটা টিপে এক হ্যাঁচকায়
মুখটা তুলেছিল মন্টুর। “শুনলাম এইবারও নাকি ডাব্বা খেয়েছিস? হেডু নাকি লাস্ট বার
তোকে চান্স দিয়েছে?” মন্টু কোনো কথা বলতে পারে না। বিশুর প্রশ্নে নিরুত্তর সে। তার
চোখ তখন বিশুর শরীরে। একটা ক্ষীণ জলের ধারা ফর্সা বুকের মাঝ বরাবর জন্ম নিয়ে সটান
গড়িয়ে যাচ্ছে পেটের ওপর দিয়ে এক্কেবারে নাভির নীচে। “শালা ষোলো বছর বয়েস হয়ে গেল
এখনও গোঁফের চুল গজালো না।” চুক্কি দেখিয়ে প্যান্টের ওপর দিয়ে টিপে দিয়েছিল বিশু।
ব্যাথায় কনকনিয়ে উঠেছিল মন্টু। যে জায়গায় হাত দেওয়া ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী
সেই জায়গায় প্রথম হাত পড়লো মন্টুর।
পাড়ার
ক্লাবে। পার্টির মঞ্চে। চাঁদা তোলার সময়। ছোট-খাটো ঝামেলায়। গভীর রাতে অন্ধকার
কোনের ঘরে ছোট্ট খাটে কলেজের ফাস্ট ইয়ারে পড়া বিশুর সাথে এরপর থেকে প্রায়ই দেখা
যেতে থাকলো ক্লাস এইটে দুবার ফেল করা মন্টুকে। বিশু শুধু মন্টুর মস্তিষ্কে প্রবেশ
করলো না, তার হাত গিয়ে পৌঁছোলো সবে ষোলোতে পড়া কৈশোরিক শরীরের নিষিদ্ধ স্থানে।
সেগুলো উপভোগ করে তোলার নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকলো বিশু। মন্টুর কোনো ভাব
বিকার হলো না তাতে। ভেসে আসলো না সাপের মতো পেঁচিয়ে থাকা শরীরের শিৎকার। রক্ত
মাংসের হাড় মজ্জায় যখন বিশুর শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেদ করতে চাইছিলো
ঠিক তখন হাতে টর্চ জ্বালিয়ে একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল মন্টু। ‘লেলিনের বক্তৃতা
সংকলন’। কুচোকুচো বরফ বৃষ্টির মধ্যে সমবেত জনগণের সামনে এইমাত্র বক্তব্য রাখলেন
কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিন। চিৎকার করে বললেন “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। লেলিনের
কোটে, টুপিতে, উদ্ধত তর্জনীতে তখন শুধু বরফের কুচি। চারিদিকে নীল সাদা বরফের
স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেদিন বিশুর খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিল মন্টু। সকালে লাথি মেরে বিশু
যখন মন্টুকে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিলো তখন সে বিশ্বাসই করতে পারেনি তাদের খাটে
শোওয়ার চাদরটা হয়ে গেছে রক্তে রাঙা এক পতাকা। মাঝে শুধু কাস্তে হাতুড়ি আর তারাটাই
নেই। দূর থেকে ভেসে আসছে তীব্র হুইসিল। বরফের ওপর দিয়ে অসংখ্য বুটের এগিয়ে চলার
আওয়াজ। হাজার শ্রমিকের পাশে নীল সাদা বরফের বৃষ্টি। এইমাত্র বক্তৃতা দিতে উঠলেন
সবার প্রিয় কমরেড লেলিন।
শুধুমাত্র
এই বরফ বৃষ্টির স্বপ্ন দেখার জন্য প্রতিরাতে মন্টু বীশুর ছোট খাটটাতে আশ্রয় নিতো।
যদিও আর রাঙা হয়ে উঠতো না বিছানার চাদর রক্তে ভেজা লাল রঙে। একদিন ঝুরঝুরে বরফ
পড়ার স্বপ্নটাও যখন চলে গেল তখন ব্ল্যাক পয়েন্ট রেঞ্জ থেকে গুলি করেছিল মন্টু
বিশুকে।
খুলিটা
উপড়ে গিয়েছিল তার।
ছিটকে
পড়েছিল ঘিলু।
নীল-শাদা
বরফের মধ্যে দিয়ে রক্তের রঙকে মনে হয়েছিল লালচে কালো।
ঘটনাটির
কথা কেউ টের পায়নি। পাওয়া সম্ভব ছিলো না।
কারণ ঠিক
সেই সময়ে সিকিমের বরফ ধূষর প্রান্তে কোনো ট্যুরিস্ট ছিল না। শুধু সাক্ষী ছিলো
হাতের রিলভবার। ঝুরঝুরে শাদা বরফ যা দ্রুত ঢেকে ফেলছিলো ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া
বিশুকে। আর একটু দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিন তার বক্তৃতা
সংকলনের মধ্যে। তর্জনী উঁচিয়ে, জনতার দিকে তাক করে। ঠিক সেই মুহূর্তে খবর পেয়েছেন
তিনি। সেদিনই পশ্চিমবঙ্গে প্রথম প্রবেশের অনুমতি আদায় করেছে পশ্চিমী দুনিয়ার
বিখ্যাত বহুজাগতিক সংস্থার একটা ঠান্ডা পানীয়।
মন্টু সেই
ঠান্ডা পানীয় খেতে গিয়ে দেখেছে তার রঙও লালচে কালো।
যদিও সেই
বহুজাগতিক পানীয়ে কোথাও সে খুঁজে পায়নি নীল-শাদা বরফ।
পেয়েছিল
শুধু নিজের হাতে প্রথম খুন করা কমরেডের লালচে কালো রক্তের স্বাদ। (ক্রমশ...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন