হারিয়ে পাওয়া ভালোবাসা



আজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কানে কানে শ্রী বলে গেলো "কাল ভ্যালেন্টাইনস ডে জানো কাকা"। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম তাই? শ্রী তার চশমা পড়া চোখ নিয়ে এগিয়ে এসে বললো “ধুর...তুমি কিচ্ছু জানো না। বাবা মাকে একটা ইয়া বড় রাম এ্যান্ড রেজিনস দিয়েছে। আর আমার জন্য কিন্ডার জয়েস।” শ্রী ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর অনেক বন্ধু আছে। তাদের জন্য সে নিয়েছে বেশ কিছু চকলেট। আমার টেবিলেও একটা আছে দেখলাম। কাল ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার দিন। 
 
সবে যারা স্টিল ছবি দেখে গল্প বলতে শিখছে...বানাচ্ছে... এমন এক পুঁচকে ছাত্র অনেক রাতে ফেসবুকের ম্যাসেজ বক্সে চুপি চুপি জানালো। স্যার আপনার ফেসবুকের সব এ্যালবাম গুলোতে ঘুরে বেড়ালাম। ভালোবাসার গল্প আছে সেখানে কিন্তু প্রেম কই? আমি ভাবলাম সত্যি তো প্রেম না থাকলে তো মাটি। আর এখন সেই আসল মাটি পাই কই? ছুটতে থাকলাম...পাঁই পাঁই করে ফ্ল্যাশব্যাকে। দেখলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লবিতে আজ যেন বসন্ত উৎসব। ওদিকে তুলনামূলক সাহিত্যের লাইব্রেরীর সামনে অনেকেই জোড়ায় জোড়ায়। অতো গম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনার চলচ্চিত্রবিদ্যার ক্লাসেও আজ কোথা থেকে যেন পড়ন্ত শীতের চন্দ্রমল্লিকা। এবং সাদা কালো রাশিয়ান ছবি তুলে রেখে আজ ক্লাসে হঠাৎই ত্রুফো। এর আগে আমি স্বাধীনতা দিবস পালন করেছি। প্রজাতন্ত্র দিবস। শিক্ষক দিবস। কিন্তু ভালোবাসা দিবস? 


না...না...। এইসব আবার হয় নাকি? এতো খরচ করতে পারবো না। আমি হনহন করে হাঁটছি ঢাকুরিয়ার ব্রিজ। আর আমার পেছনে আমার থেকে বছর দশেকের ছোট ভালোবাসা হাঁটছে। সে বলছে বেশ তাহলে এখনি কিন্তু এই ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিই। আমি থমকে দাঁড়াই। সেই প্রথম আর্চির দোকানে ঢুকি। ওখানে একটা লাল রঙের কুকুর আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে লাভ সাইন ছুঁড়ে দিলে আমরা তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসি। এরপর প্রত্যেক বছর আমাদের দুজনের কোলে কোলে কেউ না কেউ বাড়ি ফিরেছে। এই করে পাঁচ বছরে আমাদের ছানাপোনা কম হয়নি। ভালোবাসার দোহাই দিয়ে তাদের আমরা তাকে তুলে রেখেছিলাম। কোনো এক অগাষ্টের বর্ষায় তাদের কথা কেউ ভেবে দেখিনি আমরা। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছিল সব। ঠিক তখনি হঠাত দেখলাম কলকাতার রাস্তায় বড় পোষ্টার পড়েছে টাইটানিক এবার চশমা পড়ে। আমাদের ভালোবাসা চশমা পড়লো।  


হিমেল রাতের গাঢ় অন্ধকার চিরে এগিয়ে আসছে একটা বোট। উদ্বিগ্ন নাবিক চিৎকার করছে, “তোমরা কি কেউ শুনতে পাচ্ছো?... তোমরা কি কেউ কি বেঁচে আছো?” আমরা তখন সিনেমা হলের সিটে বসে আটলান্টিক মহাসাগরের নীল জলে দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রার হীম-পরশ অনুভব করছি। ভাবছি বেঁচে যাবেতো জ্যাক আর রোজ? এইতো যাদের সাথে আড়াই ঘন্টার বেশি থাকলাম জাহাজটাতে। যাদের হাসিতে হাসলাম...যাদের দুঃখে কাঁদলাম...যাদের প্রেমটাকে সায় দিলাম মনে মনে। এতোক্ষণ! “শালিখ ঠাকুর ওদের বাঁচিয়ে দিয়ো...প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ...।” এক ঝটকায় ঘাড় ঘুরিয়ে ছিলাম। দেখেছিলাম সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া ছেলে-মেয়ে দুটিকে। দুজনে দুজনের হাত জড়িয়ে ধরে বসেছিলো। আর মেয়েটা হাউ-হাউ করে কেঁদে কেঁদে বলছিলো কথাটা। ছেলেটা থামানোর চেষ্টা করেনি একবারও। সময়টা ছিলো ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরের এক শীতের রাত। স্থান, বালীর রবীন্দ্রভবন। সবে যাদবপুরে ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেছি। মাথায় ঘুরছে তখন ফরাসী নব তরঙ্গ, ইতালির নববাস্তববাদ, হলিউডের স্টুডিও সিস্টেম। আমল দিইনি কান্নাটাকে। টেকনিকাল অনেক মারপ্যাঁচ...তত্ত্বগত ধ্রুপদী চিত্রনাট্য...আর বহু যুগের কাপল ফরমেশান নিয়ে আটকে থেকেছিলাম। জনপ্রিয় আঙ্গিকের রসায়নটাকে তখন বুঝিনি। বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম অনেক পরে। ঠোক্কর খেতে খেতে...কাজের জায়গায়...ক্লাসের চৌহদ্দির অনেক বাইরে। বুঝেছিলাম ওই কান্নাটার মধ্যেই কোথাও অমর হয়ে আছে টাইটানিক। অমর হয়ে আছে জ্যাক আর রোজ। যে অমর হয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প খুঁজতে খুঁজতে আমাদের এই এতো কার্ড...এতো ফুল...এতো বাণিজ্যের আয়োজন।


ফেসবুকে পরিচালক জেমস ক্যামারুন বারবার তাঁর দর্শকদের অনুরোধ করেছিলেন আবার টাইটানিককে ফিরে দেখতে। ডিস্ট্রিবিউটাররা বলেছিলেন, এটা নাকি তাঁদের ভ্যালেন্টাইন্স ডের উপহার। দুষ্টুরা বলছিলো নতুন বোতলে পুরোনো ওয়াইন। ক্যামারুন সাহেবের ওটাই নাকি স্ট্র্যাটেজি। আর মন বলছিলো কেনো আবার? এতোকাল পরে? আবার কেনো অতল জলের কান্না?  উত্তরটা পেলাম হলে গিয়ে। বলছি সে কথা। বরাবরের মতো এবারেও লেট ছিলো আমার ঘড়ি! তবে বাঁচোয়া,  শহরে কাল বৈশাখী ছিলো... শহরে ছিলো বৃষ্টি। আমি মনে মনে শালিখ ঠাকুরকে ডাকিনি...। ভরসা পাইনি তেমন। তবে আপ্রান চেষ্টা করছিলাম ঠিক সময়ে হলে পৌঁছতে। আমার মেগা সিরিয়ালের মিটিং, আমার চিরকালের অবসাদ...আমার লেখা না লেখার বিস্তর ব্যবধান ঘুঁচিয়ে আমি ছুটছিলাম । আর বারবার ঘড়ি জানান দিচ্ছিলো এই তো আর একটু পরেই...এক্ষুনি ছেড়ে যাবে টাইটানিক সাউথ সিটির ফেম থেকে। পঞ্চাশ টাকা জমা দিয়ে প্লাস্টিকের খেলনা চশমা পড়ে উঠে পড়লাম টাইটানিকে। সেই কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা ঘিরে ধরলো আমাকে... আমার পাশে বসা অবাঙালী প্রেমিক-প্রেমিকাকে... ওপাশের সিটে বসা মধ্য বয়স্ক দম্পতি্কে...ছটা পঞ্চাশের প্রায় হাউসফুল হওয়া হলে বেজে উঠলো টাইটানিকের থিম মিউজিক। আর আমি যেনো কোথায় ফিরে ফিরে দেখতে চাইলাম...মেলাতে গেলাম বহুবছর আগের দেখা একটা ছবির সাথে নতুন ত্রিমাত্রিক টাইটানিককে। ফিরে দেখতে চাইলাম এক বহু জানা ভালোবাসাকে। বিচ্ছেদকে।


ওই তো আমার সামনে দিয়ে উঠছে ওরা জাহাজে। ওই তো গাড়িটা। “সত্যি ডেফথ অব ফিল্ডটা কি সুন্দর বোঝা যায় না?” পেছনের সিট থেকে মন্তব্য ভেসে এলো। “আর দেখো...ওই যে ঘুঁষি...মনে হলো না নিজেই খেলাম? জ্যাক মারলো তো?” মহিলা খিঁচিয়ে ওঠেন “আরে না না! উফ তুমি বড্ডো বকো...আলুভাজা খাও তো।” ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজের প্যাকেট হাত বদল হতে থাকলো, আর ওদিকে তখন আবার সবাই জ্যাক আর রোজের প্রেমে হাবুডুবু খেলো। আবার সবাই দুইহাতে ডানা মেললো জাহাজের ডেকে... যে যার মনের সঙ্গোপনে। আবার সবাই কেঁদে উঠলো টাইটানিকের মরণ বিষাদের আর্তনাদে। 
কোন ভালোবাসাকে চাই আমরা কাছ থেকে? কোন ভালোবাসা এসে ধরা দেয় প্রতি মুহূর্তে? মিলনের বিপরীতে বিচ্ছেদ আছে বলেই কি তা আরো মধুর হয়? জানি না। তবে এইটুকু জানি ভালোবাসার পরশ লেগে থাকে অতীতের ডানায়। বাস্তবের পথে। অনেক কিছু হারিয়ে অনেক কিছু পাওয়ার নাম ভালোবাসা। জন্মদিনে আদি আজ তোকে এইটুকুই দিতে পারলাম। ভালোথাকিস। অনেক শুভেচ্ছা।


 


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি