স্মৃতি তর্পণ
আজ সকালে হালকা কুয়াশা ছিলো।
আজ সকালে থার্মোমিটার বলছিলো আমার গায়ের উষ্ণতা একশো এক। গত মাঝ রাত পর্যন্ত মা
বসে ছিলো মাথার কাছে। অনেক ভোরে আকাশবানী ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলো আমার। ভেসে আসছিলো
পাশের বাড়ি থেকে “রূপং দেহি...জয়ং দেহি...যশো দেহি...দ্বিষো জহি...”। চেয়ে
দেখেছিলাম আমার সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম...। পাশেই মা শুয়ে নিমীলিত চোখে। ধড়াস
করে উঠেছিলো বুক। মায়ের গায়ে হাত দিতেই চোখ খুলেছিলো মা। “টুকনু”। একটা স্বস্তির
নিঃশ্বাস পড়েছিলো সেই জ্বর ছেড়ে যাওয়া গা দিয়ে। কিন্তু দশ বছর আগে...এমনি এক শরতের
ভোরে বার বার ডেকেও বাবার ঘুম ভাঙাতে পারিনি আমি, দাদা, মা কেউই। সেদিনও
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্ত্রোত্র পাঠ করছিলেন উদাত্ত কন্ঠে। সেদিনও জানলা দিয়ে শরতের হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে
আসছিলো শিউলি ফুলের গন্ধ। সেদিনও গঙ্গার ঘাটে মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিলো
“প্রেতোস্য...সন্নিধিস্য...”। দলে দলে লোক আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গঙ্গায়
যাচ্ছিলো। আর থমকে দাঁড়াচ্ছিলো তাদের প্রিয় মাষ্টারমশাইকে শেষ বারের জন্যে দেখতে। আমি
চোখ বন্ধ করলে সকালটাকে আজও দেখতে পাই স্পষ্ট।
“ব্রাহ্মণের ছেলে পৈতে
কোথায়?” জ্বর চোখে চেয়ে দেখি বাড়ির অনেক দিনের পুরোহিত জেঠু আমার সামনে। বাবার
বয়সী কি উনি? তাহলে উনি আছেন বাবা নেই কেনো? মায়ের দিকে তাকালে মা ঠিক করে নিতে
বলেন ধুতির কোঁচা। আমি এবার তর্পণে বসবো। প্রতিবার গঙ্গায় যাই, এবার বাড়িতে। কারণ
এবার আমার জ্বর। থার্মোমিটার বলছে গায়ের তাপমাত্রা একশো এক। “অনামিকাতে কুশের আংটি
পরো...”। দুহাতের অনামিকায় কুশের আংটি পরে আমার জ্বর হাত। করজোড়ে আমি পিতামহ
ভীষ্মকে স্মরণ করি...ব্যাধের হাতে মারা যাওয়া মহাভারতের সেই আসল নায়ক কৃষ্ণকে
স্মরণ করি, কুরুক্ষেত্রের অসংখ্য সৈন্য যাঁরা যুদ্ধে মারা যাবার সময় জল পায়নি
তাদের স্মরণ করি...প্রজাপতি ঋষি সমেত যম রাজাও আমার হাতে জল পান। প্রত্যেককে মনে
করিয়ে করিয়ে জল দেওয়ান পুরোহিত জেঠু। সব শেষে আসে বাড়ির পালা। বাবাকে মনে করতে বলা
হয়...মনিকে...আমার ঠাম্মাকে..হাঁদাকে। ঝাপসা হয়ে আসছে কি দৃষ্টি? ঠাম্মা বলছে কি
আমাকে খুলনার কোলাপোতার গল্প? ফলসা গাছের তলায় কিভাবে মেঘ ঘনিয়ে আসতো? পিসিকে মণি
বলে ডাকতাম। সেই কোন ছোট্ট বেলায় বিধবা হয়ে চলে এসেছিলো আবার মায়ের কাছে। দেশ
ছাড়ার সময় মা কী করে পারে মেয়েকে ফেলে আসতে? পিসিও সঙ্গ নিয়েছিলো ঠাম্মার।
উদ্বাস্তু হয়ে এপারে উঠেছিলো দরমার ছাওয়া ঘরে। হাঁদাকে বিয়ে দেওয়া হয়নি। ছোট্ট
থেকে রুগ্ন ছিলো বাবার পরের এই ভাই। একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছিলো বাবা। আমি আর
দাদা রাত জেগে ঠোঙা বানাতাম। হাঁদার দোকানে মুড়ি বিক্রির জন্যে। কিন্তু হাঁদার
ভালো নাম কি ছিলো মা? মা মনে করতে পারে না। দাদার আই ফোনে সেভ করা নেই হাঁদার ভালো
নাম। বড়মাকে ফোন করে লাভ নেই কারণ তিনি ভুগছেন স্মৃতি ভ্রংশ রোগে।
আমরা ভুলে গেলাম
লোকটার নাম? আমরা ভুলে গেলাম...যারা দেশের মাটিতে মরতে চেয়েছিল? যারা মারা যাবার
সময় সত্যি জল পায়নি কোনো দিন। যারা বুঝতেও পারেনি আসলে স্বাধীনতা মানে দেশ ভাগ? আমার হাত কাঁপে। তিল হরতকি দেওয়া জল যেনো আর
পড়তে চায় না কলাপাতার ডোঙায়। চোখের সামনে শুধু ভাসে, মনি একবার দেশে যাবে বলে আমরা
সবাই তাকে দিয়ে এসেছিলাম মাদারের নির্মল হৃদয়ে। কেউ জানি না, মারা যাবার সময় মনিকে
কেউ সত্যি কথাটা বলেছিলো কিনা। ঠাম্মা খেতে চেয়েছিলো বাড়ির ফলসা। বাবা এনে দিতে
পারেনি। আর বাবাকে কিছু বোঝাতেই হয়নি কারণ বাবা জানতো যে দেশটাকে ফেলে এসেছে
পেছনে...সে দেশটা আসলে মায়া...। যে মায়ার টানে আমার মা জ্বর গায়ের ছেলেকে বসিয়েছে
তর্পণে। যে মায়ায় সারা রাত বসে থেকেছে মা, আমার মাথার কাছে। সেই মায়া আমার তপ্ত গা
জড়িয়ে ধরছে। আর আমার কানে পৌছোতে পারছে না সব কঠিন মন্ত্র। কোথা থেকে যেন ঠাম্মা
ডেকে উঠছে। ওই তো মণি শীতের দুপুরে কাসুন্দি রোদে দিচ্ছে আর রাজপুত্র, রাজকন্যার
বাকি গল্পটা বলছে। দরজার ফাঁক দিয়ে আসা একটু রোদ্দুরে মাথা নীচু করে বসে আছে রুগ্ন
হাঁদা। আর বাবা কোথায়? চোখ বন্ধ করি। একটা চটি বই হাতে নিয়ে বলছে “টুকনু আমার সাথে
গড় গড় করে বল দেখি”। দাদাও এসে যোগ দিচ্ছে। বাবা পড়ছে, আমি পড়ছি...এক নিশুতি রাত
শুধু সাক্ষী থাকছে। আমাদের বালীর দশ ফুট বাই দশ ফুটের বাসায়, বাবার সাথে আমি আর
দাদা সুর করে বলে চলেছি “এসেছে শরত...হিমের পরশ...লেগেছে হাওয়ার পরে”। আমি তোমাদের
বড় মিস করি দাদার এই দামী ফ্ল্যাটে। সত্যি আজ যদি তোমরা জল খেতে আসতে বাবা। সত্যি
যদি একবার পড়তে সহজ পাঠ। মণি যদি সত্যি এসে রোদে দিতো কাসুন্দি। হাঁদাকে যদি সত্যি
আমাদের বড় ছাদটা দেখাতে পারতাম...যেখানে কখোনো রোদ সরে যায় না। সব যদি সত্যি হতো
বাবা, আমি তাহলে আজ এই সময়ে স্মৃতির তর্পণ লিখতাম না। কুশের আংটি পরে কলাপাতার
ডোঙায় ঢালতাম না গঙ্গাজল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন