আমাদের ইন্দিরঠাকরুণরা



আমার ঘরের জানলা থেকে দেখা যায় ওদের জানলা। রান্নাঘর। বারান্দার একটা অংশ। গেরস্থালির টুকিটাকি। ঠিক তেমন ওদের দিক থেকেও নিশ্চই আমাদের এই দিকটা অমনটাই দেখা যায়। মুখোমুখি ফ্ল্যাট হলে যা হয় আর কি। আমাকে অনেক সময়, অনেকটা সময় বাড়ি থাকতে হয় মাঝে মাঝে। কাজের সূত্রে। কিম্বা এমনি কোনো কাজ ছাড়াই। ওই জানলায়...ওই রান্নাঘরে...ওই বারান্দায় আমি একজন পঞ্চাশ ঊর্ধ মহিলাকে দেখতে পাই। বছর দেড়েকের নাতনিকে কোলে করে তিনি কাক দেখান...ভাত খাওয়ান...কখোনো আমার বছর দশেকের ভাইঝির সাথে গল্প করেন। সেই সূত্র ধরেই মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হলে, বাজারে, কুশল বিনিময় হয়। 

ভদ্র মহিলা কর্মঠ। কাজ করেন সারাদিন। কাজ করতে ভালোবাসেন। শীতের সময় ফ্ল্যাটের ভাগ করা ছাদে বড়ি দেন। কুলের আচারের বয়াম যত্ন করেন রোদে দিয়ে বই পড়েন। সেলাই, ফোড়াইয়ে নতুন নক্সা তোলেন। এবারে আম সস্তা ছিল বলে সারা বারান্দা...জানলা...ছাদ জুড়ে আমসত্ত্ব দিয়ে বেড়িয়েছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। ছোট ছোট কাঠের আর পাথরের ছাঁচে শুকোচ্ছে আমসত্ত্ব। কোনোটা মাছ, কোনোটা পাখি, কোনোটা ফুলের মতো দেখতে। বর্ষার গোড়াতে হঠাৎ কাজের চাপ এসে গিয়েছিল। নানা দিকে ছুটোছুটি করতে হয়েছিল। তাই বেশ কয়েকদিন আর দেখা হয়নি পারিপার্শ্ব। খোঁজ নেওয়া হয়নি যাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো তাদের। হঠাৎ একদিন ঘোর বর্ষায় পাড়ার রাস্তায় দেখা হয়ে যায় মহিলার সাথে। প্রথমে চিনতে পারিনি। খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন। অসুস্থ মনে হল দেখে। জানতে চাইলাম কী হয়েছে? বললেন, চোখে একটা কি সমস্যা হচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে দেখিয়েছেন। আমি সান্ত্বনার সুরে বলেছিলাম। ঠিক হয়ে যাবে। যেমন আমরা বলে থাকি রাস্তা ঘাটে, কথার কথায়। মহিলা আমার পাশ দিয়ে মাথা নীচু করে চলে গিয়েছিলেন। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে এক পরিবর্তিত মানুষকে দেখেছিলাম যেন মনে হয়। 

তার কয়েকদিন পরে শুনতে পেলাম হঠাৎই ভদ্র মহিলাকে নাকি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই মিলে এদিকে ওদিকে খোঁজ নিলাম। ছেলে গিয়ে থানায় মিসিং ডায়রী করলো। ঠিক তার পরদিন তাঁকে পাওয়া গেল আমাদের খেয়া ঘাটের পাশের ছোট্ট একটা ঘাটে। বর্ষার ঘোলা জলে ভেসে উঠেছিল তার দেহ। বাড়িতে ঝগড়া হয়নি। নাতনিকে বরাবরের মতো ভাত খাইয়েছিলেন। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বিকেলের বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। তার দিন দুয়েক আগে বোনদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছিলেন। বলেছিলেন দেখতে এসেছি তোদের। আর কবে দেখতে পাবো জানি না তো। চোখ আসতে আসতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সবাই আমার মতোই বলেছিল ঠিক হয়ে যাবে। ছোট্ট ডায়রীর শেষ পাতায় লিখেছিলেন “এতো খরচ করে...এমন অস্থির হয়ে...বাঁচতে পারবো না।” ডায়রী খুলে কাঁদছিল ছেলে। আমি কিছু বলতে পারিনি। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছিলাম সেই ঘর ছেড়ে...বারান্দা ছেড়ে...। এক পরিপূর্ণ গেরস্থালিতে এক বয়স্ক মানুষের অনুপস্থিতির মন কেমন ছেড়ে। 

এই মহিলার তাও ছেলে ছিল, ছেলের বউ ছিল, নাতনি ছিল...আর উমা পিসির যে কেউ ছিল না। বালী স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের পাশে অনেকে তাকে দেখেছে ভিক্ষে করতে। উমা পিসির জন্যে মাঝে মাঝে চা খাওয়া হতো আমাদের। খুচরোর সমস্যা মিটতো পিসির কাছ থেকে নেওয়া পয়সায়। পদাবলীর গান শুনিয়ে মাত করতে পারতেন। অফিস যাত্রীরা পিসির জন্য একটা ফান্ড করেছিল। তবুও পিসিকে পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণেশ্বর থেকে একটু এগিয়ে ট্রেন লাইনের পাশে। ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা ছিল। এমন অস্থির হয়ে...নিদারুণ হয়ে...বাঁচার নাম কি? পাশ থেকে কেউ বলেছিলেন 'সিনিয়র সিটিজেন'। 

আস্তে আস্তে যখন নিস্তেজ হয়ে আসছে দেহের শক্তি। নিজের বশেই যখন নেই আর পরিস্থিতি। বাড়ি ফেরার আকূল ইচ্ছে যখন কূরে কূরে খাচ্ছে মনকে এমন এক বিষাদঘন বিকেলে হুগলীর টিবি হসপিটাল থেকে ফোন পেয়েছিলাম গোরা কাকুর। আমি একটু বাড়ি নিয়ে যাবি টুকনু? কথাটা কানে বাজে এখোনো। একদিন শীতের দুপুরে আমরা গোরাকাকুকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেদিন বাড়ি আসার আনন্দটা লোকটা আর উপভোগ করার মতো অবস্থায় ছিল না। ফুলের মালার মধ্যে দিয়ে শুধুই জেগে ছিল এক বিষাদগ্রস্ত মুখ। এতোটা পড়ে আপনার যদি মনে হয় প্যাথোজ। তাহলে আমি দুঃখিত। আমি জানি আমার কিম্বা আপনার বাড়ির বয়স্করা হয়তো অনেক ভালো আছেন এদের থেকে। তারা হয়তো শতকরা সব সুযোগ সুবিধে পাচ্ছেন। তাহলে আমি আবার বলবো ব্যাপারটা রি-ভিজিট করতে। একবার তার ঘরে উঁকি মারতে। তার বাড়ি আসা আর যাওয়ার রাস্তাটা দেখতে। বাসে, মেট্রোতে, ভিড় ট্রেনে উঠলে এদের যে ব্যবহার পেতে দেখি তাতে লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যায়। আর মনে ভয় হতে থাকে এরপরে তাহলে কি আমারও টার্ন নয়? একটা পরিসংখ্যান দেখে সেটা আরো নিশ্চিত হয়ে যাই। যেখানে ভারতে দু-হাজার এগারো সালে ষাটোর্ধ নাগরিকের সংখ্যা ছিল দশ কোটির কাছাকাছি সেখানে দু-হাজার একুশে সেটা গিয়ে দাঁড়াবে চোদ্দ কোটির ওপর। যার মধ্যে থাকবো হয়তো আমি, আপনি, আমরাও। এঁদের মধ্যে একান্ন শতাংশ মহিলা। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা রিপোর্ট অনু্যায়ী বয়স্কদের পঁচাত্তর শতাংশ থাকবেন গ্রামীন এলাকা থেকে। যাদের কাছে ন্যুনতম পরিষেবার কিছুই পৌঁছোয় না।

পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুনকে মনে আছে? বুড়ির দূর সম্পর্কের ভাইপো ছিল। ভাইপোর বউ ছিল। ছোট্ট ছোট্ট দুটো নাতি নাতনি ছিল। আর বুড়ি মরেছিল বাঁশঝাড়ে...একটা এঁদো পুকুরের পাশে। একা...একা...। উলটে গিয়েছিল তার তোবড়ানো ঘটিটা। 'ডিজিটাল ভারত' যখন কে কি 'মাংস' খাবে আর না খাবের ঝগড়ায় মেতে আছে। মন্দির হবে না মসজিদ হবে তাই নিয়ে মেতে আছে...। ঠিক তখন  অন্য ফাইল গুলোতে দিনের পর দিন পচে উঠছে প্রবীন নাগরিকদের জন্যে নেওয়া না নেওয়া নানান সুযোগ সুবিধের পলিসি মেকিং-এর ডিসিশান গুলো। ইতিহাসের ভূতের দৌড়ে সুভাষের ফাইল খোলা হল ঠিকই। কিন্তু এই ইন্দির ঠাকরুণদের ফাইল না খুললে যে ভবিষ্যতের ইতিহাস আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। কে জানে সেই পচে যাওয়া স্থবিরের বিষাদগ্রস্ততায় হয়তো সেদিন আমিও নিজেকে খুঁজে পাবো। আন্তর্জাতিক প্রবীন দিবসে এই ভয়টা নিয়ে বেঁচে থাকবো? নাকি যারা কাজ করছে, চিন্তাভাবনা করছে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো? বাড়ির বয়স্ক মানুষটার প্রতি আরো যত্নশীল হবো? আজকের এই ছোট্ট ব্যাক্তিগত ডিসিশানটা হয়তো আমাদের আগামীর বেঁচে থাকার পরিসর নির্ধারণ করবে।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি