গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর-১



নিছক গল্প নয় এক মহাকাব্যিক আখ্যান...

এক জনপদের কথাকে চিত্রায়িত করা হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে নতুন পদক্ষেপ কি? প্রশ্নের জবাবে আপনার উত্তর হবে হয়তো “না”। কিন্তু সেই জনপদের গল্পকে মহাকাব্যিক আখ্যানে  রূপান্তরের চেষ্টা কোনোদিন দেখেছেন কি? এবার হয়তো আপনি ভাবতে বসবেন। ডুব দেবেন সুদূরে। আপনার সামনে সত্তর থেকে আশির দশকের কিম্বা সাম্প্রতিক নামকরা কিছু পরিচালক, ছবির নাম এসে ঘোরাফেরা করবে, আপনাকে ভাবাবে...কিন্তু সঠিক উত্তর পাবেন কি? আমি পাইনি। খুব গরমের এক সকালের শোতে একটা ছবি দেখতে গিয়ে সেই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম, নিছক একটা গল্প বলার জন্য এই ছবির নির্মাণ নয়। হিন্দি সিনেমার মূল স্রোতে দাঁড়িয়ে এই ছবি ইঙ্গিত করছে চলচ্চিত্রে এক মহাকাব্যিক আখ্যানের কথা। যে মহাকাব্যিক আখ্যান আসলে খুব আধুনিক এক চলচ্চিত্র ভাষায় লেখা এবং চিত্রিত। আমাদের ছবি 'দেখা', 'শোনা' আর 'পড়া'র রাজ্যে যাকে সহজেই একটু অন্যরকমের তালিকায় অন্তর্ভূক্তি করা যায়।
আসুন চট করে চোখ রাখি কয়েকটি তথ্যে। গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর, মূল ছবিটির সময়সীমা পাঁচঘন্টার। ছবিটির প্রথম ভাগ মুক্তি পেয়েছিল ভারতের প্রায় একহাজার প্রেক্ষাগৃহে। দুটি ভাগেরই সময় সীমা যাথাক্রমে একশো পঞ্চাশ মিনিটের। কান ফেস্টিভালে ডিরেক্টার’স ফোর্টনাইটে ছবিটি এই বছরে প্রদর্শিত হয়েছে। ছবিটির মুক্তি নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। ওয়াসিপুরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদ। কারণ তাদের অনুমান এই ছবি তাদের অঞ্চলের নাম খারাপ করছে। বদনাম করা হয়েছে এই ছবিতে। তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রীকে তাঁরা চিঠি পাঠিয়েছেন। রাঁচি হাইকোর্টে  রিট পিটিশান দাখিল হয়েছে। দুজাহার দশ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে বেনারসে স্টান্ট সিকোয়েন্স শ্যুটিংয়ের সময় মারা গেছেন ছবির সহকারী পরিচালক সোহিল শাহ। তাঁর মৃত্যুটা নিছকই এ্যাক্সিডেন্ট না খুন তা নিয়েও একটা চাপা গুঞ্জন আছে। ছবিটি সোহিলের নামে উৎসর্গীকৃত। মুক্তির পর থেকে মাত্র চার দিনে এই ছবি ব্যবসা করেছে প্রায় বারো কোটি টাকার। যা প্রযোজকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তবুও মনে রাখার মতো বিষয় বাণিজ্যিক নানা উপকরণ নিয়ে ছবির দিগন্তরেখা চিহ্নিত হলেও এই ছবির এগিয়ে যাওয়ার চলন অন্য। এই ছবি সেইসব মানুষের গাথা যা ভারতের ইতিহাসের এক অন্যমুখের সাক্ষী। এক অন্য সভ্যতার নিদর্শন। যে সভ্যতাকে বড় হতে হয়েছে কয়লাখনির আশে পাশে। যে সভ্যতা নিজের দেশের নামে, স্বাধীনতার নামে লুট করেছে ট্রেন, জনপদ। যে সভ্যতা দেখেছে নিজের মাকে বিক্রি হতে রাতের পর রাত...যে সভ্যতা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে কোলিয়ারির সাইরেনে...ঘুমোতে গেছে হাড় হিম করা রক্তবন্যার ভয় নিয়ে। যে সভ্যতা নিজের হাতে খুন করেছে বিশ্বাসকে, শৈশবকে, তার ভালোবাসাকে। 




একটা ছোট্ট ছেলে সর্দার খান প্রতিজ্ঞা করে যতদিন না সে তার বাবা শহিদ খানের খুনের বদলা নিতে পারছে ততদিন মাথায় চুল রাখবে না। মস্তক মুন্ডন হয় তার। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতে একটু আধটু লেখাপড়াও শেখে সে। কাকার সংসারে লুকিয়ে মানুষ হয়। কিন্তু সর্দারের রক্তে তো বইছে তার বাবার মতোই এলাকা দখল, আধিপত্য বিস্তার আর মুরুব্বিয়ানার রক্ত। একদিকে আছে কয়লা খনির মালিক রামধীর সিংহ। বাবার খুনি। এলাকার জনদরদী নেতা। অন্যদিকে সর্দারের দুই বিবি, পাঁচ সন্তান আর নিজের কৌমের সাথে যুঝে চলার নিরন্তর সংগ্রাম। সর্দার এই ছবির ট্রাজিক বীর কিনা আমরা জানি না। কারণ ছবির প্রথম অংশ শেষ হয় সর্দারকে খুনের চেষ্টার মধ্যে দিয়ে। হিংসা, মারামারি, খুন-জখম, রাহাজানি, বিশ্বাসঘাতকতা আর গভীর প্রেম যদি হয় এই আখ্যানের মোড়ক। তাহলে অন্যদিকে আছে এক পরিবারের গল্প বলতে বসে তার মহাক্যাবিক আখ্যানের বিস্তারের সাথে সাথে দেশ, সময় ইতিহাসকে ছুঁয়ে যাওয়ার এক আপ্রান প্রচেষ্টা।

পরিচালক, প্রযোজক আর গল্পের সহযোগী লেখক অনুরাগ কাশ্যপ সর্দারের জীবন কাহিনী বিস্তার করতে গিয়ে এনেছেন অসংখ্য চরিত্র। যে চরিত্ররা স্বাধীন ভারতের আগে থেকেই ওয়াসিপুরের অংশীদার। যারা জড়িয়ে রয়েছেন অঞ্চলের মাটির সাথে... তার গন্ধে, বর্ণে, চরিত্রে। চল্লিশের দশক থেকে সাম্প্রতিক সময় এই আখ্যানের বিস্তার। ব্রিটিশ যুগে ট্রেন লুটের মধ্যে দিয়ে যে দস্যিবৃত্তির শুরু তার পারম্পরিক এক ধারাবাহিকতা আছে কয়লা খনি হয়ে সাম্প্রতিকতম নিছক দাদাগিরিতে। আর এই দীর্ঘ সময় পথ হাঁটতে গিয়ে... তাকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে... অনুরাগ বেছে নিয়েছেন নানা মাধ্যম। সেখানে যেমন আছে চরিত্রের সাথে সাযুজ্য রেখে সিনেমার রেফারেন্স ঠিক তেমনি আর্কাইভ ফুটেজ, আর আছে অসম্ভব দক্ষতায় বোনা আঞ্চলিক গান। যা খানিকটা লোকগাথার মতো ফিরে ফিরে আসে ছবিতে। মনে করিয়ে দেয় অঞ্চলকে, সময়কে, স্মৃতিকে তার জীবন্ত হয়ে ওঠা সত্তাকে।
ছবির প্রথম পর্বের শুরু আর শেষের দৃশ্য দিয়ে যেন পরিচালক এক আখ্যানের আদি এবং উত্তরকে চিহ্নিত করেন। দাঁড়ি বসান। যে গাদা বন্দুকে্র ভয় দেখিয়ে এক সময়ে সর্দারের পূর্ব পুরুষেরা ট্রেন লুট করতো সেই বন্দুক এখন ‘ইলেট্রনিক’। তার ব্যবহার অন্য...তার ভাষা অন্য। সর্দারও তো নিজেকে ভেঙে চুরে অন্যরকম করে ফেলে। চোখের সামনে দেখতে দেখতে ওয়াসিরপুরটাও অন্যরকম হয়ে যায়। কিন্তু কোথাও কি পড়ে থেকে আঞ্চলিক স্মৃতি?...তার জীবন? যা বারবার তাদের স্থানীয় সংলাপে, লোকগীতিতে ফিরে আসে, ভাবায়? চরিত্রদের মুখ আর মুখোশের ব্যবধান ঘটায়? স্বল্প পরিসরে লিখতে বসে এই ছবি নিয়ে সব কথা বলা যায় না। বরং আর একবার দেখে নিয়ে আড্ডা এগিয়ে যেতে পারে অনেক দূর।



শেষ করবো ব্যক্তিগত এক অভিজ্ঞতার কথা লিখে। দুহাজার দশ সালে বীরভূমে খাদান অঞ্চলে খুব গন্ডগোল শুরু হয় জমির মালিক সাঁওতাল আর মুসলমান খাদান মালিকদের সঙ্গে। সেই সময় এক তথ্যচিত্রের জন্যে দীর্ঘদিন থেকেছি ওইসব অঞ্চলে। দেখেছি তাদের প্রচন্ড দুঃখের জীবন। আমার ক্যামেরা ছবি তুলেছে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চিত্র। আমাদের ভয় দেখানো হয়েছে মৃত্যুর। আমাদের গাড়িতে এসে পড়েছে পাথরের ঢেলা, আর একের পর এক দিন আমরা লুকিয়ে তুলেছি সেই জীবন্ত দগ্ধ জীবন। যে জীবনের কথা ‘ইতিহাস’ খুব চট করে বলতে চায় না।  যে জীবনের কথা রাষ্ট্র বলে না। যে গল্প মিডিয়া সবার সামনে রাতারাতি প্রকাশিত করে না। অথচ যারা স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে আছে। যারা সত্যিই কোনোদিন পড়েনি বর্ণমালা। পড়েনি “গোপাল বড় সুবোধ বালক”। 
 
পরিচালনা ঃ- অনুরাগ কাশ্যপ।

কাহিনী ও চিত্রনাট্য ঃ- অনুরাগ কাশ্যপ, সৈয়দ জিশান, অখিলেশ, সচীন লাডিয়া। 
 
অভিনয়ে ঃ-  মনোজ বাজপেয়ী, জয়দীপ আহলোয়াট, রিচা চাড্ডা, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, জামিল খান, সৈয়দ জিশান কাদরি, আদিত্য কুমার, রিমা সেন প্রমুখ।
 

ছবি সৌজন্য ঃ- গুগুল ইমেজ। ইউ টিউব।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি