শান্তিগোপাল
স্মৃতির
শ্রদ্ধা
গুটি গুটি পায়ে
নেমে আসছে শীতের সন্ধ্যে আমাদের বালির বাসার দশ ফুট বাই দশফুটের উঠোনে। আজ একটু তাড়াতাড়ি
মনি সন্ধ্যে দিয়েছে। শাঁখ বাজিয়েছে। ঠান্ডা লাগবে বলে মা আমাকে দুটো গেঞ্জির ওপর একটা
ফুলহাতা সোয়েটার পরিয়েছে। ভালো করে মাথা, কান আর গলা ঢেকে জড়িয়ে দিয়েছে মাফলার। তারপরেও
ব্যাগে রেখেছে একস্ট্রা একটা চাদর, পা ঢেকে বসার জন্যে। ডিবে ভর্তি করে সাজানো হয়েছে
পান। মনি আর মা খাবে। ছোট্ট এ্যালুমনিয়ামের টিফিন কৌটোতে নেওয়া হয়েছে বিস্কুট। পিসির
ভাজা নিমকি। আমি ঠাকুরের থালা থেকে গোটা কতক বাতাসাও লুকিয়ে রেখেছি সেখানে। আমরা তিনজনে
চলেছি গঙ্গার ধারের মাঠে। আজ
সেখানে যাত্রা হবে। তরুন অপেরার ‘আমি সুভাষ বলছি’।
পাঁচুদা
একমাস ধরে রিক্সা করে মাইক নিয়ে টিকিট বিক্রি করেছে। সকাল সন্ধ্যে লোকটাকে চিতকার
করে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি এপাড়া-ওপাড়া। আজ পাঁচুদা হাসি হাসি মুখ করে একটা বড়
ভলেন্টিয়ার ব্যাচ আটকে বসে আছে মাঠে ঢোকার বড় গেটের পাশে। সব টিকিট শেষ। হাউজ ফুল। “মাসিমা একটু তাড়াতাড়ি পা চালান, সামনের দিকে তো সব
বেপাড়ার লোক ভর্তি করে দিলো।” আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারি না। কিছুদিন আগে রিলিফ
ক্যাম্পে মনির ছানি অপারেশান হয়েছে। দুই মহিলার একমাত্র পুরুষ প্রতিনিধি আমি।
দায়িত্ত্ব কি কম? মনিকে বলি আস্তে হাঁটো তো, জায়গা আমাদের ঠিক রাখা থাকবে। ওরা
অবাক হয়। “আমাদের জায়গা কে রাখবে টুকনু?” আমি বলি কেনো? যাত্রা দলের লোকেরাই
রাখবে। মা ধমকায়। ভাবে এও বুঝি আমার খেলনাবাটির কাল্পনিক সংসার। মাকে তো আর বলিনি
ভলেন্টিয়ার ব্যাচ না থাকলেও কতবার যে ঢুকেছি প্যান্ডেলে তার ইয়ত্তা নেই। কতবার যে
গ্রীন রুমের সামনে গিয়ে উঁকি দিয়েছি। বাস থেকে যাত্রা দলের জিনিস নামানোর সময়
দাঁড়িয়ে থেকেছি ঠায়। বড় বড় টিনের সিন্ধুকের মধ্যে আছে সৈন্যদের পোষাক। বন্দুক।
কামান। এই সব আমাকে কানাই বলেছে। তার সাথে ভাব করে নিয়েছি। সেই আমাকে বলেছে
কনর্সাট দলের পাশেই জায়গা রাখবে।
সে এক হই হই...
রই রই... ব্যাপার! গঙ্গার ধারের মাঠে দাঁড়িয়ে আজ নেতাজী চিতকার করে বলবে “দিল্লী
চলো।” যুদ্ধ ঘোষণা করবে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। তাই কাছ থেকে না দেখলে চলে? “নেতাজী
কে জানিস তো?” কানাই বড় বড় চোখ করে আমার কাছে জানতে চায়। আমি ঘাড় নেড়ে বলি খুব। এইসব
গল্প আমাকে গোরা নকশাল বলেছে। গোরা নকশালের একটা পা খোড়া। পুলিশ নাকি ভেঙে দিয়েছে।
থাকে গঙ্গার ধারের বাড়িটার চিলে কোঠায়। অনেক বই আছে জানো গোরা নকশালের। কানাই বলে “সেতো
আমাদের বাবুর বাড়িতেও আছে।” কে তোমাদের বাবু? “উফ, তুই তো দেখছি কিছুই জানিস না!”
বিরক্ত হয় কানাই। “এই যাত্রা দলটা যার। যে আজ সুভাষ সাজবে। খুব পন্ডিত মানুষ।
ধন্যি ধন্যি করে লোকজন। শান্তিগোপালের নাম শুনিস নি তুই?”
কানাইয়ের
সাথে আমি সেঁটে থাকি সারাদিন জল ছবির মতো। আমি শুনি যাত্রা দলের কথা। কানাইয়ের
কথা। শুনি কত নতুন নতুন জায়গায় ওরা যাত্রা করতে যায়। রাতের পর রাত বাসেই কেটে যায়
অনেক সময়। ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখি আমিও বেড়িয়ে পড়েছি কানাইয়ের সাথে। আমারো বাসের
সামনে লেখা ‘তরুন অপেরা’। বেলা পড়তে থাকে। কানাই বড় স্টোভ জ্বালায়। বড় একটা
কেটলিতে জল ঢালে। সাদা এ্যাম্বাসাডারে করে আসেন শান্তিগোপাল। আমি দূর থেকে দেখি।
কানাই ডাকলেও যেতে পারি না। কারণ ওখানে তো দেখছি স্কুলের হেডমাষ্টার, মনি স্যার
সবাই আছে। খুব কথা বলছেন সবাই। গেলেই যদি জানতে চায় আজ স্কুলে যাইনি কেনো?
লেলিনের বড়
কাট আউটের পাশের গেটটায় বেশি ভিড়। সেখান দিয়ে আমরা ঢুকি। শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে
মা আমার। পাছে হারিয়ে যাই। আমাদের টিকিট একেবারে সামনে। চাটাইয়ে বসার। কিন্তু
সেখানেও গিজ গিজ করছে লোক। এতো লোক আমি কোনোদিন দেখিনি। বিকেলে যে স্টেজটাকে অসুন্দর
মনে হয়েছিলো এখন সেখানে কত রকমের আলো। লোকের আওয়াজে গমগম করছে মাঠটা। কিন্তু কানাই
কোথায়? মা বসিয়ে দেয় আমাকে। কিছুতেই যেতে দেয় না ভিড় ঠেলে কনর্সাটের কাছে। আমি
খুঁজে পাই না অত ভিড়ে কানাইকে। আলো ক্রমে কমে আসতে থাকে। ঘন্টা পড়ে ঢং। বেজে ওঠে
হারমোনিয়াম। সানাই। স্টেজের লাইটগুলো বন বন করে ঘুরতে থাকে। সেই আলো আঁধারির মধ্যে
যুদ্ধ হয়। কত শত মানুষ মরে। কত শত মানুষ প্রান দেয় দেশের জন্যে। উঠে আসেন সুভাষ।
জনতার হাততালিতে ফেটে পড়ে মাঠ। উত্তেজনায় আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। খুলে ফেলি মাফলার। এই লোকটাকেই
তো আজ বিকেলে দেখেছি। এই মুহূর্তে সে
চিতকার করে বলছে, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।” পাশে চেয়ে
দেখি মনির ছানি কাটা চোখেও করুনাধারা। দেশ ছাড়া গ্রাম ছাড়া মানুষগুলো অবাক হয়ে
চেয়ে থাকে সেই নানা রঙের আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সুভাষের দিকে। যে একদিন সত্যি
বলেছিলো স্বাধীনতা এনে দেবে। মনি শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতো নেতাজী থাকলে দেশভাগ
হতো না।
তারপর যে
কতবার গোরা নকশালের চিলেকোঠায় আমাদের যাত্রা যাত্রা খেলার মধ্যে আপনি নেমে এসেছেন
শান্তিগোপাল তার হিসেব আমার কাছে এখন আর নেই। ঠিক করে ফেলেছিলাম বড় হয়ে যাত্রা
করবো। টো টো করে ঘুরে বেড়াবো আপনার মতো এক জেলা থেকে আর এক জেলায়। হয়নি। কিন্তু কি
আশ্চর্যের সমাপতন, বহুদিন পর এক ঐতিহাসিক লগ্নে আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো।
আপনি তখন অসুস্থ। ঘোষণা করেছিলেন আপনার শেষ অভিনয়ের দিন। গিরিশ মঞ্চে সেদিন বাঁধ
ভাঙা ভিড় ছিলো না। পাদ প্রদীপের শেষ আলোয় যখন শেষ বারের মতো আপনি এসে দাঁড়ালেন মঞ্চে,
আমি তখন হাত তালির শব্দ খুঁজছিলাম। আমি খুঁজছিলাম মনিকে, গঙ্গার মাঠটাকে। গমগম করা
মানুষের ভিড়কে। খুঁজছিলাম সেই সন্ধ্যাটাকে যাকে আমি হারিয়ে এসেছি বহু যুগের ওপারে।
সেদিন লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে যে মানুষ গুলো আপনার যাত্রার টিকিট কেটেছিলো তারা আজ
নেই। কিন্তু রয়ে গেছে স্মৃতি। আপনি আমার সেই স্মৃতির শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।
ছবি গুগুল ইমেজের সৌজন্যে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন