এক কিশোরের স্বপ্ন
শরতের রোদ
এসে পড়েছে আমাদের বেলুড় স্কুলের বারান্দায়। হিমেল হাওয়ার অল্প কাঁপুনিতে নড়ে উঠছে
স্কুলের মাঠের দেবদারুর পাতা গুলো। টিফিনের পরের ক্লাস। পেট পুরে আলু-কাবলি খেয়ে
কার আর ক্লাস করতে ভালো লাগে? হাই উঠছে খুব। ক্লাস সিক্স। কয়েক দিন হলো আয়নার
সামনে দাঁড়ালে ঠোঁটের ওপর হালক কালচে রঙের রেখাটার ওপর হাত চলে যাচ্ছে বারবার ।
ওটা কি গোঁফ? কে জানে! কিন্তু এবার পুজোয় ফুল প্যান্ট। মনের কোনে কোথাও যেন একটা
খুশির রেশ। মনিস্যার ক্লাসে ঢুকলেন ভাঙা তালপাতা পাখার ডাঁটিটা নিয়ে। ওটাই স্যারের
কাছে ডাক সাইটের ছাত্রদের ভয় দেখাবার অস্ত্র। তার সাথে আলগোছে ধরা লাল মলাটের একটা
বই। সারা ক্লাস জুড়ে হই-চই। সারা ক্লাসে কাগজের প্লেন। খাতায় কাটাকুটি। স্যার তাঁর
ভাঙা চশমার আড়াল থেকে দেখে নিলেন একবার গোটা ক্লাসকে। তারপর খুব আস্তে, হালকা
মেজাজে বললেন, “গল্প শুনবি তোরা?” ক্লাসে তখন পিন পড়ার নৈঃশব্দ। লাল মলাটের বই
আমাদের নিয়ে গেলো চট্টগ্রামে। মাষ্টারদা সূর্য সেন তখন প্ল্যান করছেন অস্ত্রাগার
লুন্ঠনের। স্যার বলছেন, আমরা শুনছি। ক্লাস শেষের ঘন্টার কথা তখন আর মনে থাকছে না
কারোর। শরতের এক বিকেলে মুখ ভার করে বাড়ি ফিরছি আমি। কারণ তার কিছুক্ষণ আগেই
মাষ্টারদাকে ফাঁসি দিয়েছে মনি স্যারের ওই লাল মলাটের বইটা।
এক ধাক্কায়
বছর কুড়ি আগে ফিরে গিয়েছিলাম বেদব্রত পাইনের প্রথম ছবি ‘চিটাগং’ এর হাত ধরে। আমি
দেখলাম ঝঙ্কুকে। সেই বয়সন্ধির ছেলেটি কিভাবে আস্তে আস্তে প্রেমে পড়ছে মাষ্টারদার।
কিভাবে বাড়ির তথাকথিত সাহেবিয়ানা ছেড়ে যোগ দিচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামে। পড়ে থাকছে
বাবার সাধের স্বপ্ন ছেলেকে বিলেত পাঠানোর, ইংরেজ সরকারের আরো একজন সুযোগ্য চাকরের
সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা। ছবিটা দেখছিলাম আর একটু একটু করে আমার বন্ধু হয়ে উঠছিলো
খুব কম কথা বলা ছবির নায়ক ঝঙ্কু। তার সরল মুখ, নতুন কিছু করার আনন্দ, জেদ,
মাষ্টারদার ওপর নির্ভরশীলতা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো মনিস্যারের ক্লাসে। লাল রঙের
মলাট দেওয়া ছোট্ট বেলার সেই বইটার মধ্যে। আমিও যেন ঝঙ্কুর সাথে ঘাড় উঁচু করে
স্বপ্ন দেখছিলাম চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের। ঝঙ্কু কাঁদলে আমি
কাঁদছিলাম...ঝঙ্কুর মন খারাপে আমার মন খারাপ হচ্ছিল। ঝঙ্কুর সাথে আমিও যেন বন্দুক
উঁচিয়ে হেঁটে চলছিলাম সেই জঙ্গলের রাস্তায়। লড়াই করছিলাম বীরের মতো। ইংরেজ অফিসারের
লাথি যখন ছিটকে ফেলছিলো ঝঙ্কুকে, কষ বেয়ে গড়াচ্ছিলো তাজা রক্ত আমিও যেন ভেতর থেকে
দুমড়ে মুচড়ে উঠছিলাম। ঝঙ্কুকে যখন দ্বীপান্তরে পাঠানো হল আমিও কি কালাপানি পেরিয়ে
সেই অন্ধ কুঠুরির মধ্যে ঢুকলাম? আন্দামানের সেলুলার জেলের সেই উঁচু পাঁচিলের পেছনে
বসেই কি ঝঙ্কুর মতো আমিও পেলাম মাষ্টারদার ফাঁসির খবর? আর এক সময়ে ঝঙ্কুর হাতে
ধরেই কি এসে দাঁড়ালাম আবার বাংলার মাঠে। চিৎকার করে বললাম জমিতে উতপন্ন ফসলের তিন
ভাগের দুই ভাগ পাবে চাষী আর এক ভাগ পাবে মালিক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল ধরে
নাড়া দিলো ঝঙ্কু। ১৯৪৬ এর তেভাগা আন্দোলনের মূল সারিতে এসে দাঁড়ালো মাষ্টারদার বড়
প্রিয়, বড় আদরের সেই ছোট্ট ছেলেটা। যে শিখেছিলো সুড়ঙ্গ খোঁড়া, যে শিখেছিলো বন্দুক
চালাতে, যে শিখেছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।
আর এখানেই
অন্যান্য ইতিহাস নির্ভর, সত্যি ঘটনার ওপর আধারিত স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক ছবির সাথে বেদব্রত পাইনের চট্টগ্রামের
প্রভেদ। এই ছবি যেন এক কিশোরের স্বপ্ন। খুব সরল চোখে যে স্বপ্ন সে বাস্তবায়িত হতে
দেখতে চায়। তার স্বপ্নের নায়ক এখানে মাষ্টারদা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন
ইতিহাসের কাছে যতবড় ঘটনাই হোক না কেন, এযেন ঝঙ্কুর চারপাশের সুখ স্বাচ্ছন্দের
বৃত্ত ছেড়ে এক উন্মুক্ত স্বাধীনতার আস্বাদ। তার স্বপ্ন পূরণের দলিল। সেই একমাত্র
স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সারা ছবি জুড়ে ঝঙ্কুর মরিয়া প্রয়াস। এই স্বপ্নকে পুঁজি
করেই তো নাসা থেকে বেদব্রতের মুম্বাইয়ে যাত্রা।
এই ছবি এক
রৈখিক চলনে গল্প বলার প্রথায় বিশ্বাসী। চিত্রনাট্যে কোথাও থাকে না মার প্যাঁচের
নুন্যতম প্রয়াস। ঝাঁ চকচকে ভিজ্যুয়াল এফেক্টস দাপিয়ে বেড়ায় না শাদা পর্দা জুড়ে।
যুদ্ধের দৃশ্যগুলো দেখলে বোঝা যায় কত কম সময়ে, কত স্বল্প টাকায় কাজ শেষ করতে হয়েছে
পরিচালককে। প্রায় দুঘন্টার ছবিটি হঠাতই শেষ হয়ে যায় মনে হলেও কোথাও যেন লেগে থাকে
এক অদ্ভুত ভালো লাগার রেশ। কানে বাজতে থাকে শঙ্কর-ইশান-লয়ের গানের সুর। ছাপ ফেলে
যায় প্রত্যেকের অসাধারণ অভিনয়। কিম্বা ভারতে বসে চট্টগ্রামকে প্রতিরূপায়ণের
প্রয়াস। আর সব শেষে থাকে এক মন কেমনের হাতছানি। যে মন কেমনকে সঙ্গে নিয়ে আমার ছবি
দেখা শেষ হয়। বাড়ি এসে তাক থেকে পাড়ি ধুলোয় মোড়া মনি স্যারের সেই লাল মলাটের বই।
ফেয়ারওয়েলের দিনে চুপি চুপি যে বইটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন স্যার। আমার বছর দশের
ভাইঝি তার নাক পর্যন্ত ঝুলে যাওয়া চশমা নিয়ে আমার পাশে এসে বসে। এক ধূসর ছবির দিকে
আঙুল দেখিয়ে জানতে চায় “কাকা, এই লোকটা কে?” আমি ঠিক কুড়ি বছর আগের মনি স্যারের
মতো তাকে সূর্য সেনের গল্প বলতে বসি। আর ঠিক করে ফেলি পুজোর ছুটির দুপুরে কতবেলের
আচার খেতে খেতে দুজনে আবার দেখবো ছবিটা। দেখতে তো হবেই। না হলে ও জানবে কী করে
ঝঙ্কুকে... সেই সাহসী প্রীতিলতাকে।
অভিনয়ে-
মনোজ বাজপেয়ী, ডেলজাদ হিওয়ালে, নওয়াজ উদ্দীন সিদ্দিকী, ভেগা টামোটিয়া, আরো অসংখ্য
অভিনেতা। যাঁদের অনবদ্য অভিনয়ে ছবিটি প্রান পেয়েছে।
চিত্রনাট্য-সোনালী
বসু, বেদব্রত পাইন।
প্রযোজনা-
সুনীল ভোরা, অনুরাগ কাশ্যপ, সোনালী বসু, জয়দীপ আহলাট, বেদব্রত পাইন






মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন