ছোট্ট অমিতাভ মন্টু



মন্টু অমিতাভ বচ্চনের ফ্যান ছিল। মন্টু অমিতাভ বচ্চনের চুল নকল করতো। অমিতাভের হাঁটা-চলা। কান ঢেকে চুল রাখা। পায়ে সাদা চটি কিম্বা জুতো পরা। অমিতাভের গলা নকল করে তার তুখোর তুখোর সংলাপ বলে বয়সন্ধির সন্ধ্যা গুলোকে রঙিন করে দিতো সে। মন্টু ছিলো আমাদের বন্ধু। আমাদের ছোট অমিতাভ। মন্টুর বাড়ি গেলে আমরা অমিতাভের খবর পেতাম। 

সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঘরে ঘরে টিভি ছিলো না। হোয়াটস-আপ বা ফেসবুক ছিল না। তবে হাতে গোনা ভাগ্যবান লোকের বাড়িতে এ্যান্টেনা থাকলে সেখানে সন্ধ্যার দিকে ছন্দা সেন কাঠের চৌকো বাক্সে খবর পড়তে আসতেন। বাংলা ছায়াছবির গান হতো। হিন্দি ছবির চিত্রাহার দেখলে ছেলে পাকা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতো। এ্যান্টেনাতে কাকেরা মজা করে বসলে, কিম্বা হনুমান তার ধরে টানাটানি করে লাফালাফি করলে ঝিরঝিরে ছবি আসতো। বাড়িতে টিভি এলে সারা পাড়া মিষ্টি খেতো।  তিন পাড়া পেরিয়ে একটা লোকের বাড়িতে টেলিফোন থাকলে সেখানে টুকুদির অঙ্কের স্যারের না আসা থেকে মল্লিক বাবুর ছোটো জামাইয়ের টিউমার অপারেশানের খবর থাকতো। এ-হেন প্লটের ছত্র-ছায়ায় চারপাশের বন্ধ হতে থাকা চটকল গুলোর ধূসর চিমনির হাতছানি দেওয়া সাইরেনে শ্রীকৃষ্ণ সিনেমা হলের শো ভাঙলে মন্টুকে দেখা যেত। হাতে সাদা রুমালে হাল্কা আতরের গন্ধ মেখে তখন সে কথা বলছে লাইটম্যান সিদু কাকার সাথে। খোঁজ নিচ্ছে আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বলের সিনেমা হলে কবে আসবে অমিতাভের ছবি? কিন্তু সেখানে নতুন ছবি চলে কটা? পুরোনো ছবির যা ছিটে ফোটা পড়ে থাকে তাই দিয়ে মন ভরে সবার।

মন্টু একদিন খবর নিয়ে এলো দেখানো হবে কুলী। যে সিনেমা করতে করতে তার গুরু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিল। মন্টুর সাথে কি অমোঘ আকর্ষণে আমারও বন্ধু হয়ে যায় লাইটম্যান সিদু কাকা। হলের ছাদের ছোট্ট ঘরে ১৬ মিমি প্রজেক্টার চালানো মহম্মদ চাচা। এক হল থেকে আর এক হলে র‍্যাশন ব্যাগে করে ফিল্মের ক্যান দেয়া নেওয়া করা হারুর। 




খবরটা রটেও যায় হাওয়াতে বারুদের গন্ধ ছড়ানোর মতো। মাষ্টারের ছেলেকে দেখা যাচ্ছে শ্রীকৃষ্ণে...চিলেকোঠার প্রজেক্টারের ঘরে...পোষ্টার সাঁটা চাদুর সাথে। লাইট ম্যান সিদুর সাথে। কিম্বা ফিল্মের বকাটে ছেলে হারুর সাথে। সবাই দু-অক্ষরের বিষাক্ত মাল। কাজেই সাবধান। বাবা বকে। দাদা বকে। গোরা নকশাল মাথা নেড়ে বলে “টুকনু মাথাটা শুধু চুল আঁচড়াবার জন্য নয় রে...। ওরা তোদের ছবির নামে আফিম খাওয়াচ্ছে। একদিন নিয়ে আসিস তো মন্টুকে।” আমি তবুও ছবির আফিম খেতে লুকিয়ে দুপুরে বাড়ি থেকে পালাই। ঠোঁটের ওপর হালকা রঙের কালো দাগটা আয়নায় দেখি। পালিয়ে শ্রীকৃষ্ণের চিলেকোঠাতে যাই। প্রজেক্টারের কির কির শব্দ আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে সিনেমা হল। ভালো লাগে দম বন্ধ হয়ে আসা...গুমোট ভ্যাপসা ঘামের গন্ধে ছবির আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষ গুলোকে। 

তখন অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায় সোচ্চার দাদারা। জুট মিলের সামনে দিয়ে যেতে গেলে শুনতে পাই... ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না...ভিয়েত সংগ্রামী...’। চিৎকার করে অপুদা বলে ওদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও...ভেঙ্গে দাও। হাতের মুঠো শক্ত করা অমিতাভের কুলীর পোস্টার পড়ে পাড়ার বুকে। হনুমান জুটমিলের দেওয়ালে। মন্টু নিজে উদ্যোগ নিয়ে বাড়ির সামনে টাঙায়। বার ছয়েক সিনেমা দেখে। আর ফিরে আসে রোমহর্ষক সিনেমার গল্প নিয়ে। ঠোঁটের ওপর সবে কালো হতে থাকা রেখাটার ওপর বারবার হাত চলে যায় মণ্টুর। ‘সারা দুনিয়াকা বোঝ হাম উঠাতে...’খুব সুন্দর করে শিস দেয়। পাড়ার দাদু দিদার হাতে ভারী ব্যাগ দেখলেই বয়ে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসে। অঙ্ক স্যারের সুবিধে হয় তাঁকে আর রিক্সা ভাড়া করতে হয় না।

এ-হেন মন্টু একদিন এসে সুবোল বাবুর কোচিং-এ এসে ঘোষোণা করে সে নাকি একটা বাজ পাখির বাচ্চা পেয়েছে। আমাদের সবার চক্ষু চড়ক গাছ। বাজ পাখি? মন্টুর মুখে স্মিত প্রজ্ঞার হাসি। মন্টুর বাজ পাখি দেখতে আমরা ভিড় করি। মন্টু বাজ পাখিকে কুলির অমিতাভের মতো হাতে করে নিয়ে ঘোরে। চারা মাছ খাওয়ায়। গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে রোজ কাঁধের ওপর বাজপাখি নিয়ে সাইকেলে করে চক্কর দেয়। হেবিদার আখড়ায় গিয়ে ডাম্বেল ভাঁজে। সকালে গিয়ে টেংরি কিনে নিয়ে আসে। ফুটিয়ে সেদ্ধ করে খায়। হাতের গুলি গুলো টিপে টিপে দেখে শক্ত হয়েছে কিনা। মন্টু কিউটি পাওডার মাখে। 

মন্টু সত্যি একদিন ভরা বর্ষার দুপুরে লাভ লেটার পায়। সেই লাভ লেটারের উত্তর দিতে গিয়ে মণ্টু শুধু অমিতাভের সংলাপ লেখে। জমে যায় প্রেম। কিন্তু একদিন মন্টুর প্রেমিকার দাদার হাতে চিঠি সমেত মন্টু ধরা পড়ে। সেই মেয়ের বিজ্ঞান মঞ্চ করা পক্ষী বিষারদ দাদা প্রমান করে দেয় এতোদিন মন্টু যাকে বাজ বলে ভাবতো...পাড়ায় রেলা দেখাতো...তার বোনকে ফুসলেছিল... সেটা আসলে চিল। মন্টুর মাথায় বর্ষার আকাশ ভেঙে পড়ে। মণ্টুর প্রেম চলে যায়। মন্টুর চিল উড়ে যায়। মন্টু সেই বছর ফেল করে। কলোনীর ছেলে মন্টু আর ফিরে যায় না স্কুলে। কোথায় যে চলে যায় বিধবা মাকে নিয়ে আমাদের খুদাগাওয়া মন্টু আমরা হদিশ করতে পারি না।

এর অনেক দিন পরে মন্টুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল এক নামী টেলিভিশনে চ্যানেলের পি সি আর রুমে। ফুটেজ আসছিলো এ পি থেকে শহরের বুকে দুই বড় গ্যাং এর মারপিটের। সেই ফাইভ স্টার হোটেলের মধ্যে সিনেমার অমিতাভের মতো নাকি মারপিট করেছিল মন্টু। তার প্রমান স্বরূপ  সুইমিং পুলের জলের রঙ ছিল লাল। আর মন্টুর বুকের মধ্যে দিয়ে এফোড় ওফোড় করা ছিল বর্শার তীক্ষ্ণ ফলা। চিত হয়ে থাকা মন্টু যেন সেই লালচে নীল জলে খোলা চোখে সাঁতার কাটছিলো। যেমন করে গরমের ছুটিতে আমরা কাটতাম গঙ্গায়। এই জীবনের সেই যাত্রায় মন্টুকে শুধু বলা হয়নি শ্রীকৃষ্ণ হলটা এখন আর নেই বন্ধু। ব্রিজ করার জন্য ভাঙা পড়েছে অনেক দিন আগে।  মন্টুকে বলা হয়নি একদিন সে নিজে হাত ধরে চিলেকোঠার যে প্রজেক্টার রুমে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিল সেখান থেকে বেরোতে পারিনি আজও। এই মুহূর্তেও...। মন্টুকে বলা হয়নি আজও হলে গিয়ে অমিতাভের ছবি দেখতে বসলে তার কথাই মনে পড়ে সবার আগে।





মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি