জন্মদিনের চাওয়া-পাওয়া...
শেষ বয়সে
তাঁর এক অমূল্য প্রবন্ধে পূর্ণেন্দু পত্রী হঠাৎই অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়েছিলেন একটা
বিষয়ের প্রতি। ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালীর মুক্তির আগে যদি ১৯৫২ সালে নির্মিত
ঋত্বিকের নাগরিক মুক্তি লাভ করতো তাহলে ঠিক ‘কী’ হতে পারতো? মধ্যবিত্ত বাঙালী বিক্ষার চিন্তন প্রণালী, তার ধ্যান
জ্ঞান সমেত স্পেকটাকেলের যে আখড়া তা কি নাগরিক জীবন বোধের সাদা পর্দায় ধাক্কা খেত? নাকি আমাদের কাছে ইন্দিরঠাকরুণের ঘটি উলটে মরার দৃশ্য প্রাসঙ্গিক হতো? অথবা কোনো এক বালকের অপার বিস্ময়ে
একের পর এক মৃত্যু দেখা, নিদারুণ সংসারের মধ্যে প্রকৃতির খেলা আত্ম মর্যাদায়
স্থান পেতো? এক জটিল প্রবন্ধের নক্সা বুনে সেই সময়ে প্রাবন্ধিক
নিজেও যে খুব একটা নিশ্চিন্তিমূলক উপসংহারে পৌঁছোতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না।
অনেকদিন আগে পড়া সেই প্রবন্ধের ঝাপসা লাইনগুলো একটু একটু চোখে ভাসে।
আজ
সত্যজিতের চুরানব্বইতম জন্মদিন। আর পথের পাঁচালীর ষাট বছর। আজও যখন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসারে ফিরে যেতে হয় পথের পাঁচালীর কাছে নিতান্ত
কর্মসূত্রে। আজও যখন এই সময়ের চলচ্চিত্র বিদ্যার তরুণ ছাত্রদের কাছে টেক্সট হিসেবে
ছবিটাকে উপস্থিত করতে হয়। তখন প্রথমেই প্রশ্ন আসে কেন? কিসের জন্য? কোন কারণে আমরা পথের পাঁচালী দেখবো? আর কিভাবে দেখবো? সেই কবেকার এক সাদা কালো ছবি আমাদের কি বার্তা দেবে? যে ছবিটা
বীজ হিসেবে থেকে যাবে ভারতীয় ছবির মর্ম উদঘাটনে। তার ভাষা সন্ধানের নিরীক্ষায়? অতীতের বাংলা ছবির নির্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার ত্রিসীমানায় লক্ষণ গন্ডি
টেনে যে একদল তরুণ দাপাদাপি করবে তাদের সেই ঈর্ষণীয়, দুর্দমনীয়
সময়টুকু দেখতে না পাবার জন্য আক্ষেপ করবেন তার সতীর্থ এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই।
তারও আগে এদেরই একজনের কাঁধে ফরাসী চলচ্চিত্র পরিচালক রেনোয়া হাত রেখে বলবেন, “তোমাদের
দেশে তোমাদের নিজের ছবির ভাষা যতক্ষণ না তোমরা খুঁজে বার করতে পারছো ততক্ষণ তোমরা
বিশ্বপ্রেক্ষায় নিজেদের দাঁড় করাতে পারবে না।” সেই তরুণ তা খোঁজার চেষ্টা
করেছিলেন। বন্ধুরাও খুঁজছিলেন। কাজেই ‘বাস্তবের পথে চলচ্চিত্র’ তাঁর প্রথম প্রবন্ধের
আকর হিসেবে যখন পত্রিকায় স্থান পাবে তখনো হয়তো তরুণ সত্যজিত নিজেও ভাবতে পারবেন না
প্রায় ছত্রিশ বছর কাটিয়ে দেবেন চলচ্চিত্র নির্মাণে।
তাঁর চলচ্চিত্র
জীবনে বাংলা ছবির পদ-চিহ্নের যে ধারাপাত তিনি সূচিত করেছেন তার উত্তরসূরী বাংলা
ছাড়িয়ে ভারতের সর্বত্র গমন করেছে এক সময়। এসময়েও। অপুর 'দেখা' আমাদের যেভাবে সুললিত ছন্দে চলচ্চিত্রের সহজ গদ্যের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে
ঠিক উলটো দিকে নীতা, সীতা, অনসূয়া, জগদ্দল
বুঝিয়ে দিয়েছে আজ নগদ কাল ধারের জীবনে একটু বেচাল কিছু দেখলে হাত পুড়তে পারে। আর শুধু হাত নয় মুখ পুড়িয়েছিলেন সে সময়ে অনেকে। মাত্র এক দুজনের উজ্জ্বল
ব্যতিক্রম ছাড়া ঘটকবাবুর চলচ্চিত্রীয় ভাষার ধারে কাছে কেউ পৌঁছতে পারেননি। যাঁরা
মনে করছেন প্রতিতুলনা। তাঁরা হয়তো ঠিকই মনে করছেন। তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। বাংলা
ছবির লাভের অঙ্ক বেড়েছিল বই কমেনি। এমন বিপরীত বিধ্বংসী ভাষা সমকালের দুই
পরিচালকের সাদা ক্যানভাসে ছড়িয়ে পড়ছিল যা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। এখনও করে চলেছে।
সত্যজিত, ঋত্বিক, মৃণাল একের পর এক ছবি দেখলে, লেখা পড়লে, সম সময়কে খুঁজে বের করলে,
ছবির বিষয়বস্তুকে নিরীক্ষণ করলে আমাদের অবাক হতে হয়। কোথাও নতুন দেশের নতুন ছবির
ভাষা গড়ার বর্ণপরিচয়টা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
ঠিক সেই
সময়ে আমরা এমন এক চলচ্চিত্রীয় ভাষায় অবগাহন করেছিলাম যা আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। কানের কাছে যা বলে গিয়েছিলেন রেনোয়া, কলাপাতার চামর দোলা,
পুকুরে জল ফড়িং এর আঁকিবুকিতে কিম্বা ইন্দিরঠাকুরুণের করুণ চাহনিতে বাংলার আত্মা
প্রতিভাত হলো। রবীন্দ্রনাথের গানকে ভাঙলো চাবুকের শব্দ। নীতার মুখের রক্ত আগমনী
বিজয়ার সুর হয়ে এলো। বাইশে শ্রাবণে আলতা পরা বধু তার সংসারের লালটুকটুকে স্বপ্ন
নিয়ে বোমারু বিমানের মতো ঝুলে পড়লো কড়িকাঠ থেকে। হাঁসুলিবাঁকের উপকথার শুরুতে একটা
লম্বা ট্রাক শট বুঝিয়ে দিল মনে রাখবে বাংলা সিনেমার ইতিহাস এই সময়কে। সত্যি কি মনে
রেখেছি? অন্তত আমরা যারা এইসব নিয়ে নাড়াচাড়া করি। এদিক ওদিক যাই। মাঝে মাঝে গম্ভীর
তর্কের স্ট্যাটাসে লাইক পড়ে ঝড়ের মতো? কি জানি!
ভাবতে ভালো
লাগে তখন পিঠ চাপড়ানি ছিল না। একই সময়ের চিত্রপরিচালকরা পরস্পরের সমালোচনা করেছেন।
বিতর্কে জড়িয়েছেন। কাগজে চিঠি প্রকাশিত হয়েছে একের পর এক। আবার বন্ধুত্ত্বও ছিল মন
কাড়া। সত্যজিত, ঋত্বিক, মৃণাল, তপন সিংহ সমেত
সেই সময়ের গন্ডিটা আমাদের অনেকের কাছে এখনও অনেকটা অজানা। ধরা ছোওয়ার বাইরে।
কয়েকটি ইংরাজী বই, আর হাতে গোনা বাংলা বইতে সীমাবদ্ধ।
অনেক ছবি হারিয়েও গেছে। অনেক ছবি আবার নতুন করে সংরক্ষণ হচ্ছে। আরও অনেক কাজ
বাঁকি। আরও অনেক কাজের সুযোগ এবং সময় পাবে বলে আশা করি তরুণ প্রজন্ম। মাটি খুড়ে
বের হবে তার ব্যাখ্যান। শুধু বিদেশীদের চোখ দিয়ে নয়, তখন হয়তো দেশজ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ছবিগুলির। ঠিক দেশজ চলচ্চিত্রের ভাষার মতো।
যার কিছুটা শুরু করেছিলেন সেই সময়ের লেখার নিরিখে এই তিনজন পরিচালক। তারও অনেক পরে
বেশ কিছু কাজ হয়েছে। বাংলায় সত্যজিতকে নিয়ে অসাধারণ কাজ করেছিলেন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়।
এবং কেউ কেউ। ঋত্বিককে নিয়ে কাজ করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন অধ্যাপক সঞ্জয়
মুখোপাধ্যায়। ভারতীয় ছবির ভাষা সন্ধানের নিরিখ নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গদ্য
আছে অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাসের। কিন্তু বাংলাভাষায় চলচ্চিত্র চর্চায় সংখ্যার নিরিখে
সেগুলি খুবই স্বল্প।
প্রত্যেক
বছরই এই দিকপাল লোকদের জন্মদিন আসে। প্রত্যেক বছরই সেমিনারে ছবিতে কয়েকটা দিন কেটে
যায়। তারপর আবার বাড়ির কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের পাশে ছবি হয়ে
ঝুলতে থাকেন এঁরা। আগামী বছরের জন্মদিনের অপেক্ষায়। এমন যদি হতো সত্যজিতের জন্মদিন
মানে হারিয়ে যাওয়া বাংলাছবিকে খুঁজে বের করা। তার সংরক্ষণ। এমন যদি হতো ঋত্বিকের
জন্মদিন মানে ‘তেরো নদীর পারের’(যা অনেকেই আমরা দেখিনি। একটি মাত্র প্রিন্ট আছে
আর্কাইভে) ডিভিডি প্রকাশ। মৃণাল সেনের জন্মদিন মানে সরকারের নতুন প্রজন্মকে ছবি
করার উৎসাহ প্রদান; তাহলে হয়তো অন্যরকম হতো জন্মদিন গুলো।
কিন্তু সত্যিই
কি আমরা অন্যরকম কিছু চাই? হয়তো চাই। হয়তো পাই না। জন্মদিনের এই চাওয়া-পাওয়ার
হিসেব হয়তো অন্যকিছু নিয়ে খেলা করে। যে খেলায় শামিল হই আমিও...এই ছোট্ট লেখাটা
লিখে। ব্লগের দেওয়ালে টাঙিয়ে।
ছবি সৌজন্য- গুগুল ইমেজ।
চলচ্চিত্র বিষয়ে এমন কোন বই আছে কি যেটায় চলচ্চিত্রের মৌলিক বিষয়গুলো খুব সাবলীলভাবে লেখা আছে, নামটা জানলে বিশেষ উপকৃত হতাম।
উত্তরমুছুনবাংলায় কি পড়তে চাইছেন? তাহলে খুব একটা ভালো বই কিছু হবে না। কয়েকটা মিলিয়ে পড়তে হবে। আপনি আপনার ইমেল ঠিকানাটা দিয়ে রাখুন। কিম্বা আমাকে ইমেল করুন। kallolcine@gmail.com। আমি আপনাকে বাংলা আর ইংরাজী কয়েকটা বইয়ের তালিকা দিতে পারবো বলে মনে হয়। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুন