কানন দেবী (১৯১৬-১৯৯২)
এক
ভয় পেয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটা। অনেক
লোকের মাঝে তাকে সকাল থেকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এই পাড়াতে, এইরকম বাড়িতে আগে
কোনোদিন আসেনি সে। তার বাড়ির লোকেরাও কোনোদিন আসেনি। তাকে আসতে দিতেও মন চায়নি
তাদের। প্রায় জোর করেই চলে এসেছে ছোট্ট মেয়েটি। কারণ সে জানে তার ওপর এবার সংসারের
অনেকটা দায়িত্ত্ব। কিছুদিন আগেই বাবা মারা গেছেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে তাকে উঠে আসতে
হয়েছে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে সারাদিন, সারা রাত অমানুষিক
পরিশ্রম করেও বাড়ির লোকের মন পায়নি তারা। চলে আসতে হয়েছে সেই অপমানকর আশ্রয় থেকেও।
মায়ের সেই দুঃখ ছোট্ট মেয়েটি ভুলতে পারেনি কোনোদিন। ভুলতে পারেনি পড়শিদের সেই
কানা-ঘুষো। আসলেই যাকে বাবা বলে ডাকতো, আদতে সেই কি ছিল তার বাবা? নাকি মায়ের অন্য
কেউ...? লজ্জায় রাঙা হয়ে যেত ছোট্ট সেই মেয়েটার মুখ। দারিদ্র্য ছিল। কিন্তু
দারিদ্র্যের সাথে সম্মানবোধ ছিল খুব তীব্র। ছোট্ট মেয়েটা মনে মনে পণ করেছিল আর
যাইহোক দিদি, মা, এই সংসারটাকে সে কোনোদিন ভেসে যেতে দেবে না। সবাই যাতে দুবেলা
খাবার পায়, পড়ার কাপড় পায়, মাথা গোঁজার জায়গা পায়, সন্মানের সাথে জীবন নির্বাহ
করতে পারে তার জন্য ছোট্ট মেয়েটা নিজের সমস্ত শখ, আহ্লাদ, নিজের ছোটবেলাটা বিসর্জন
দিয়ে একলা একলা প্রতীক্ষা করছে। অনেক আলো, অনেক যন্ত্রপাতি আর বেশ কিছু রঙ-চঙে
মানুষের মাঝে। মনে হচ্ছে আজ তার অগ্নি পরীক্ষা। হ্যাঁ, এই ছোট্ট বয়সেই।
ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে এক
বয়স্ক মানুষ এগিয়ে আসেন। “একি? এমন কাঁদো কাঁদো মুখে বসে কেন? ভয় করছে? নাকি
ক্ষিদে পেয়েছে?” সারাক্ষণ চুপ করে ভয়ে পেয়ে বসে থাকা মেয়েটার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো
জলধারা। এমনভাবে, এমন স্নেহ মাখিয়ে তার সাথে কেউ অনেকদিন কথা বলেনি। কেউ জানতেই
চাইতো না কেমন আছে সে। কেমন লাগছে তার এই ক্ষিদে পাওয়া অপমানিত জীবন? প্রথমে
বিশ্বাস করতে পারছিল না নিজের কানকেই। লম্বা, সুদৃঢ় মানুষটি কি তার কাছেই জানতে
চাইছে? ভয় পেয়েছে কিনা সে? কোনো জবাব দিতে পারছে না মেয়েটি। উলটো দিকের ভদ্রলোক
তখন অবাক হয়ে দেখছেন তার সামনের ছোট্ট মেয়েটির দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা।
তিনি লক্ষ্য করছেন কি অসাধারণ অভিব্যক্তি সেই মেয়ের। সেখানেই কি, সেই মুহূর্তেই কি
নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল সে? এক নিষ্ঠুর ভাগ্য পরিক্রমায় যেখানে এসে হাজির হয় মেয়েটি,
সেখান থেকেই এবার তাকে দেখবে পরাধীন এবং স্বাধীন ভারতের লাখ লাখ মানুষ। মেয়েটির
চোখের জল মুছিয়ে দেন সেই বয়স্ক মানুষটি। “দূর বোকা মেয়ে, কান্না কিসের? দেখবে
তোমার কত সুন্দর ছবি উঠবে, সবাই দেখবে, কত নাম হবে। এই স্টুডিওটাই সেদিন কত আপনার
বলে মনে হবে।” ভবিষ্যৎ বাণী নির্দ্বিধায় ফলে গিয়েছিল। খুব নাম করেছিল মেয়েটা। সবাই
তাকে জেনেছিল কানন দেবী বলে। যে ভদ্রলোক তাঁকে স্নেহের প্রথম পরশ দিয়ে অভয় দান
করেছিলেন তিনি ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত পরিচালক জ্যোতিষ সরকার। যে স্টুডিওতে
মেয়েটি প্রথম কাজ শুরু করলো তার নাম ম্যাডান থিয়েটার।
আজ এঁরা সবাই ইতিহাস। আজ অনেকেই
বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। তবুও স্টুডিও পাড়ায় যখন বৃষ্টি নামে। শীতের কুয়াশা যখন খুব
জমাট বাঁধে সন্ধ্যেবেলার বাড়ি ফেরার তাড়ায়। বসন্তের আগমনকে যখন মেট্রো রেলের
আওয়াজের সাথে মিশিয়ে দেয় কোকিল। তখনও নিউ থিয়েটার্স বা টেকনিসিয়ান স্টুডিওর গাছ
গুলো দাঁড়িয়ে থাকে এক স্মৃতি-বিস্মৃতির প্রহর গুণে। এতো আজকের কথা নয়। এতো একশো
বছরের বেশি সময়ের কোনো এক জনপদের কথা। এক সাদা পর্দার কালো হওয়ার কথা। যার ধারা
বিবরণী ছড়িয়ে আছে অনেকের স্মৃতি কথায়, উপন্যাসে, হারিয়ে যাওয়া সরকারী নথিতে,
কিম্বা না লেখা ইতিহাসে। “এখানে দেওয়ালের লেখা পড়ার মতো চোখ, কান আর মস্তিষ্ক
কোথায়?” আক্ষেপ করেছিলেন কোনো এক মহৎ গুণী ব্যক্তি। কিন্তু যে মানুষটির জীবন
প্রবাহের মধ্যে পাঠক আপনাকে প্রথমেই প্রতিস্থাপিত করেছি সেই ছোট্ট মেয়েটি কালে
কালে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নিজেকে এক মহীরুহে পর্যবসিত করবেন। মাত্র পাঁচটাকায় ‘জয়দেব’
নির্বাক ছবিতে যার পথ চলা শুরু তাঁর কর্মকান্ডে মুগ্ধ হবে ‘টকি’ও। বাংলা সিনেমার
ছায়ায় মায়ায় বিচিত্র রহস্যে নিজেকে না সরিয়ে রেখে এই মহিলাই একদিন শোনাবেন
রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান। আল্লারাখা, রাইবাবু, পঙ্কজবাবু, ভীষ্মবাবু যাঁর
কণ্ঠের তালিমদার হবেন। নজরুল যাঁর জন্য লিখবেন গান। আর মাত্র একবারের দেখায়
বিশ্বকবি জানাবেন... “কি মিষ্টি মুখখানি গো তোমার? গান গাইতে পারো?” নিমন্ত্রণ
করবেন কবি শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য। যাওয়া হবে না তাঁর। কিন্তু নাই বা যাওয়া হল।
তখন তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে বাঙালী ভদ্রলোকের মুখে মুখে,
তাদের গেরস্থালির অন্দর মহলে। মেয়েরা তাঁকেই নকল করে পড়ছে শাড়ি। কপালের টিপ। রপ্ত
করছে গান আর কথা বলার মুদ্রাদোষ গুলোও।
কিন্তু জীবনটা এতোই সহজ ছিল না তাঁর
কাছে। প্রতি পদে জীবনের যে আলো ঠিকরে পড়বে। যে খ্যাতির চূড়ায় তাঁকে আরোহণ করতে হবে
সেই স্বপ্ন তো সেই ছোট্ট বেলার পুতুল খেলার সংসারে তিনি দেখে এসেছেন। যে জীবনের
রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে তিনি ছড়িয়ে যাচ্ছেন সকলের মধ্যে সেই জীবনকে পেতে কষ্ট করতে
হয়েছিল তাঁর। করতে হয়েছিল রাত জাগা সাধনা। একাধারে তাই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন
অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী পরবর্তীকালে এক সফল প্রযোজক। দুঃস্থ মহিলা শিল্পীদের
জন্য সংঘ গড়েছিলেন আপ্রান খেটে। এইসব তো হাঠাৎ হতে পারে না। জীবনের এক চরম পথ চলা
তাঁকে শিখিয়েছিল অনেক কিছু। সেই জীবন
সংগ্রামের কথা লিখেও গেছেন দুই মলাটের মধ্যে। “সবারে আমি নমি”। নামের নির্বাচনে আর
রচনার প্রতি ছত্রে এক বিনম্র অথচ সাহসী মহিলাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
বইটা এক শীতের সকালে কলেজস্ট্রিট
থেকে যখন কিনি তখন ভাবতেও পারিনি কতলোক এই বইটা পড়তে পারেন। আমার হাতে এই মুহূর্তে
বইটার পুণঃ প্রকাশের তালিকা বলছে পঞ্চম সংস্করণ। এখোনো আমার মতো হয়তো অনেকে
পড়েননি। হয়তো কোনোদিন পড়বেন। হয়তো কোনো একদিন কোনো এক স্যারকে বা অজানা বন্ধুকে
কেউ ঘুম থেকে তুলে ফোনে জানতে চাইবে “সেই নায়িকার বইটার নাম কি আপনি বলেছিলেন?’’
কিম্বা অনেক রাতে বালী সিনে গিল্ডের অঞ্জনদা মোবাইলে টেক্সট করে জানতে চাইবে “ঠিক
করে বলতো আর কতদিন সময় নিবি লিখতে?” আর ঠিক তখনি নানান অছিলায় কাজের ফাঁকে ঘুরে
ফিরে আসবে সাদা কালো ছবিতে এক হারিয়ে যাওয়া হাসি মুখের নায়িকা। তাহলে কি আমরা
আপনাকে ভুলে গেলাম? মুছে ফেললাম স্মৃতি থেকে? না
ভুলিনি। ভুলতে পারলে এতো রাত্রে এই
লেখাটা আমার ল্যাপটপের সারা স্ক্রিন জুড়ে থাকতো না। ভুলতে পারিনি বলেই হয়তো একটা
সময়ে আপনাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কারে ভূষিত করেছিল রাষ্ট্র। সম্মান জানিয়েছিল
আপনার এই দীর্ঘ পথ চলার প্রতি। এখোনো মনে রাখতে চাই বলেই ইউ টিউবে খুঁজে বেড়াচ্ছি
আপনার গানকে, ছবির চিত্রিত অংশকে। উইকিপিডিয়া সম্মান দিচ্ছে একসময়ের এই হারিয়ে
যাওয়া শিল্পীর। তবুও শতবর্ষের দোড় গোড়ায় দাঁড়ানো সময় বলছে...প্রশ্ন করছে... সত্যি কতটাই
বা আমরা ফিরে দেখলাম ইতিহাসকে? কতটাই বা মনে রাখলাম আপনাকে? আমাদের এই দেখা না
দেখার বঞ্চনাটা যে অনেক দিনের পুরোনো। আমাদের নির্লজ্জ অধিকার।
দুই
“জীবনে
সম্মান, মর্যাদা কেহ হাতে তুলে দেয় না। অতি সহজ বস্তুও পাবার পথে বহু বিঘ্ন। অনেক
পোড় খেয়ে, অনেক বেদনা বয়ে, অনেক রক্ত ঝরা অন্তর্দ্বন্দের বন্ধুর পথে চলে বুঝেছি
পৃথিবীটা সরল নয়। কঠিন পর্বতের মতো এবড়োখেবড়ো। গাঁইতি দিয়ে কেটে কেটে তাকে সমতল
করে নিজের চলার পথ নিজে তৈরী করে নিতে হয়। এই পথের বিবরণ জানাবার তাগিদ এসেছে।
জীবনে কোনো কাজ এতো কঠিন মনে হয়নি, যেমন মনে হচ্ছে আজকের এই আত্মবিশ্লেষণ আর পিছন
ফিরে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ।’’
জীবনের
শেষবেলায় জীবনকে ফিরে পড়বার ইচ্ছে জেগেছিল মনে। যে রূপালী দিনের সাক্ষী ছিলেন
অভিনেত্রী সেই দিন গুলো ফিরে ফিরে এসেছে কখোনো তার লেখায় ব্যক্তিগত আকর হিসেবে
আবার কখোনো তা উদ্ভাসিত হয়েছে ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতায়। তাহলে এই মুহূর্তে যে লেখার
মধ্যে অবগাহন করতে চলেছি। এক না দেখা, না জানা সময়, ব্যক্তিক্ত্বকে স্পর্শ করতে
চলেছি তাকে মাত্র কয়েকটা পাতার নিয়মের নিরিখে বাঁধবো কী করে? হাতের কাছে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে একটা মাত্র আত্মজীবনী, আছে একটা আশ্চর্য সম্ভাবনাময় উপন্যাস, কয়েকজনের
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্মৃতি। আর আছে ভার্চুয়াল জগতের উইকিপিডিয়া, ইউ টিউব অনেক
বন্ধুর সাথে কথা বলার ফসল। সব শেষে আছে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ খুঁজে না পাওয়ার এক চরম মন
খারাপ। লেখাটাকে আপনি ফাঁকিবাজির আদর্শ ঠিকানা হিসেবে পেড়ে ফেলতে পারেন। কারণ আমি
সত্যি জানি না এই বিশাল কর্মকান্ডকে আমি কিভাবে পড়ে দেখবো? আমি জানি না আপনাকে
কিভাবে ছুঁয়ে দেখবো কাননদেবী? একটা প্রথাগত লেখার আকারে দাঁড় করাতে চাইলে আমাকে
প্রথমে বলতে হয় আপনার জন্মের তারিখ। আপনার জন্মস্থান। আপনার বংশের একটা তালিকা।
আরো অন্যান্য কিছু। কিন্তু সেইভাবে একটুও যেতে চাইছে না আমার লেখার হরফ। চাইছে না
আমাদের আলোচনার এগিয়ে যাওয়ার চিত্রিত পরিসর। এই যে একটা আস্ত বা আধখানা জার্নি। এই
যে সময়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার দূরাতিক্রমিক সাহস সেটা আপনার কাছেই পাচ্ছি। মনে হচ্ছে
এই তো সেদিনের কথা। ছবি কথা বলতে শিখলো আর কত শিল্পীর কাজের মেয়াদ ফুরোলো। কত
শিল্পী গা ঢাকা দিলেন, কেউ আবার উঠে এলেন সামনের সারিতে। আপনার গল্পও তো পেছনের
সারি থেকে একেবারে সামনের সারিতে আসার গল্প। এক ছোট্ট মেয়ের শৈশব কেড়ে নিয়েছিল যে
সমাজ তাকে তো তার প্রতি উত্তর দিতেই হবে। হলিউডের সবাক 'কথার' ছোঁওয়া এসে দরজা
ধাক্কালো আমাদের টালিগঞ্জেও। সবাই যখন ভাবছে এই বুঝি হারালো তার শিল্পীর জীবন সাদা
পর্দায় ঠিক তখনি আপনার বরাত খুললো।
এক্কেবারে
ছোট-খাটো রোলের অভিনেত্রী নায়িকার ভূমিকায় এলেন “জোর বরাত” ছবিতে। ১৯৩১ সালের ২৭
শে জুন ক্রাউন সিনেমা যা এখন উত্তরা নামে পরিচিত সেখানে মুক্তি পেল টকি। “এ-ছবি
আমার প্রথম যুগের কর্মের অধ্যায়ের এক অগ্নি পরীক্ষা বলা যায়”। কিন্তু কেমন ছিল সেই
অগ্নি পরীক্ষা? হলিউডের অনেক নামী দামী অভিনেতার আত্মজীবনীতে, স্মৃতি কথায় পাওয়া
যায় নির্বাক থেকে সবাকের এই পালা বদল। কিন্তু বাংলা ছবির ইতিহাসে সেই উজ্জ্বল
উদ্ধার কোথায়? কজনকেই বা আমরা ফিরে পড়ি? বা খুঁজে বেড়াই? এই অসহায়তা আমাদের চাবুক
মারুক প্রতি নিয়ত। আমাদের বিস্মৃতি আমাদের অভিশাপ দিক। বইটা যখন পড়ছি তখন যেন সেই
সেদিনের কিশোরী মনের ভয়ের ধুকপুক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমিও। “...টকির যুগের শুরুতে
সাউন্ড রেকডিং মেসিন যেদিন ম্যাডান স্টুডিওতে এসে পৌঁছল, সেদিন সন্দেহ, দ্বিধা,
হতাশা ও ভয় মিশ্রিত যে বিচিত্র অনুভূতির মধ্যে কয়েকটা মুহূর্ত কেটেছিল তার তীব্রতা
আজও ভুলিনি। মেসিনটির চারিদিকে ঘুরে ফিরে চোখের একোণ ও কোণ দিয়ে কৌতূহল ভরে সবাই মিলে দেখছিলাম। কিন্তু কৌতূহলের অন্তরালে
যে বস্তুটি মনকে প্রতি মুহূর্তে দমিয়ে দিচ্ছিল, তাকে নির্ভেজাল ভয় বললেই বোধহয়
সত্যি কথা বলা হবে। এখনই সাউন্ড টেস্ট হবে। কপালে কি আছে কে জানে? হয়তো এখানেই
কাজের ইতি হয়ে যাবে। হায়রে নির্বাক যুগের সেই সোনার দিনগুলো কে কেড়ে নিল? কেনই বা
নিল?...এই সাউন্ড টেস্টের কত গল্প শুনেছিলাম। কত বিখ্যাত শিল্পী যাঁরা নির্বাক
যুগে রীতিমতো নাম করেছিলেন সাউন্ড টেস্টের দৌরাত্ম্যে তাঁদের ছবিতে কাজ বন্ধ হয়ে
গিয়েছিল। মাইক ফিটিং গলা নয়। অতএব চলবে না ওকে দিয়ে। এই অজুহাতই তো যথেষ্ট। ...যখন
আমায় ডাকা হলো আমার অবস্থা হলো ফাঁসি কাঠে যাবার আগের অপরাধীর মতো। ঠোঁট দুটো
শুকিয়ে গেছে, গলা বুঁজে আসছে। নিজের হৃৎকম্পের শব্দই যেন কানে বাজছে। জিভ আড়ষ্ট,
চোখে সর্ষে ফুল দেখছি ঠিক এই সময়ে আমাকে সংলাপ বলতে এবং গান গাইতে দেওয়া হল।...চাপা
গলার ক্লিষ্ট রুদ্ধ প্রাণহীন স্বর নিজের কানেই এতো কদর্য শোনালো যে ইচ্ছে হচ্ছিল
মেশিনটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই। দৌড়ে পালিয়ে পাশের ঘরে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইলাম।
চাকরি তো গেলো এখনি কি উপায়? কিন্তু না, একটু বাদেই খবর পেলাম চাকরি বহাল তবিয়েতেই
আছে। প্রথমের নার্ভাসনেস-কে ওঁরা লিবারালি দেখেছেন। আমার কণ্ঠস্বর অমনোনীত হয়নি।”
এই গলার
স্বরকে কারো অস্বীকার করার উপায় ছিল না। ছিলনা বলেই একদিন গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে
গান রেকর্ড করার আমন্ত্রণ এলো। সেই সূত্র ধরে জীবনের অন্য দিকের...অন্য প্রতিভাকে
পরিচয় করানোর সুযোগ পেলেন শিল্পী। এর পরেই শুরু হয় নিউ থিয়েটার্সের উজ্জ্বল
অধ্যায়। ১৯৩৬ সালের এক গরমের দুপুরে রাধা ফিল্মস ছেড়ে নায়িকা এসে দাঁড়ালেন নিউ
থিয়েটার্সের গাছপালা ঘেরা স্টুডিওর বাগানে। এরপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৩৬
থেকে ১৯৪০ ছিলেন নিউথিয়েটার্সের সাথে। একের পর এক ছবির সাফল্যই শুধু নয় একজন
বিখ্যাত গায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করলেন শিল্পী। অকপটে স্বীকার করেছেন, “ আজ
আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড়। কিন্তু আমার নিজের কাছে সবচেয়ে দামী আমার
গানের মহল।” তবুও কোথাও যেন মনে থেকে যায় আঁধার করা কালো মেঘের ছায়া। তখন তিনি তালিম নিচ্ছেন ওস্তাদ আল্লারাখার
কাছে। ওস্তাদ যেমন ভাবে চাইছেন ঠিক তেমন আর সময় পাচ্ছেন না রেওয়াজ করার। অনেক রাতে
ফিরে রেওয়াজ আর তেমন যুৎসই হচ্ছে না। তাই একদিন মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চলে গেলেন গুরু।
যাবার আগে দুঃখ করে যে কথা গুলো বলেছিলেন তা যেন আমাদের নায়িকার কানে সারা জীবন
বেজে গেল অভিশাপের মতো “ আজ যশ ও খ্যাতির মোহে তুমি কতবড় জিনিস হারালে সেকথা একদিন
বুঝবে। খোদাতালা যে কন্ঠ দিয়েছিলেন মানুষ বহু সাধনা করেও তা পায় না। তাকে বে-খাতির
করে শুধু সস্তা নাম ও অর্থ উপার্জনের কাজে বাজে খরচ করলে। একদিন দেখবে নিজের বলতে
তোমার কিছুই থাকবে না। সেদিন কিন্তু আফশোস করতে হবে।” আফশোস করতে হয়নি
অভিনেত্রীকে। কারণ তাঁর ছিল অসম্ভব পরিশ্রমের ক্ষমতা, নিষ্ঠা আর কাজের প্রতি
ভালোবাসা।
১৯৩৭ সালের
১৭ নভেম্বর নিউথিয়েটার্স থেকে যে ছবি প্রথম দর্শক দেখলো এবং বাংলা ছবিতে এক
কিংবদন্তি জুটির জন্ম দিল সেই ছবির নাম ‘মুক্তি’। অনেক পরে এই ছবির পরিচালক এবং
নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার কাজের ভূয়সী প্রশংসা শোনা যাবে আর এক কিংবদন্তী পরিচালক
ঋত্বিক ঘটকের মুখে। সেই সময়ের এক সফল ধারার এবং বাংলা চলচ্চিত্র ভাষার অঙ্কুরিত
ছাপ থেকে গেল মুক্তি ছবিতে। শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ ছবিতে অন্নদাদি করার পরে আর
কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি কাননদেবী। কেন করেননি, কিসের জন্য করেননি, তার বিস্তৃত
ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাজ থেমে
থাকেনি। ছবির প্রযোজনার সাথে চলছিল আরো হরেক রকমের কাজ। লাইট, ক্যামেরা,
এ্যাকশানের বাইরে তখন হয়তো নিজেকে অন্যভাবে মেলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে
পর্যন্ত একমাত্র কাজই ছিল তাঁর বিশ্বস্ত সহচর।
তিন
***কাননদেবীর চলচ্চিত্র জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা***
১৯২৬ সালে
ম্যাডান থিয়েটার্সের ‘জয়দেব’ ছবিতে অভিনেত্রী জীবনের শুরু। পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ
বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৩২ সালের
ডিসেম্বর মাসে রাধা ফিল্ম কোম্পানীর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি।
১৯৩৩-৩৪
সালে রাধা ফিল্মের প্রথম ছবি শ্রী গৌরাঙ্গ’তে বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় অভিনয়। প্রথম
বড় চরিত্র। অভিনয়ের স্বীকৃতি। পরিচালক- প্রফুল্ল ঘোষ।
১৯৩৫ সালে
কেশব ফিল্মের তরফ থেকে জে জে ম্যাডান প্রযোজিত ও সতীশ দাশগুপ্ত পরিচালিত বাসবদত্তা
ছবিতে বাসবদত্তার ভূমিকায় অভিনয়।
১৯৩৫ সালে
মাননীয় গার্লস স্কুল ছবিতে শিল্পী জীবনের প্রকৃত সম্মান।
১৯৩৬ সালে মা
ছবির হিন্দী সংস্করণে জনপ্রিয় হিন্দী চিত্রাভিনেতা জাল মারচেন্ট ও জুবেদিয়ার সাথে
অভিনয়।
রাধা
ফিল্মের শেষ ছবি চারদশক।
১৯৩৬ সালে
নিউথিয়েটার্সে যোগদান।
১৯৩৭ সালের
১৮ সেপ্টেম্বর চিত্রায় মুক্তি প্রদর্শিত হয়।
১৯৩৮ সালে ২
এপ্রিল বিদ্যাপতি।
ফণী
মজুমদারের পরিচালনায় বাংলায় সাথী এবং হিন্দিতে স্ট্রিট সিংগারে অভিনয়।
দেবকী বসু
পরিচালিত সাপুড়ে (হিন্দি ও বাংলা) ছবিতে অভিনয়।
১৯৩৯ সালে
পরাজয় ছবিতে অভিনয়।
১৯৪১ সালে
পরিচয় ও তার হিন্দি ভার্সন লগন। এই ছবির জন্যই বি এফ জে এ’র শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীরূপে
পুরষ্কার লাভ।
১৯৪২ সালে
এম পি প্রোডাক্সানের প্রথম ছবি শেষ উত্তর এবং হিন্দী সংস্করণ জবাব। এই ছবির জন্যও
বিএফ জে এর পুরষ্কার লাভ।
১৯৪৯ সালে
কাননদেবী প্রযোজিত শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম ছবি অনন্যায় কেন্দ্রীয় চরিত্রের
ভূমিকায়। পরিচালক সব্যসাচী ইউনিট।
শ্রীমতী
পিকচার্সের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ ছবিতে অন্নদাদির ভূমিকায় অভিনয় করার পর আর কোনো
ছবিতে অভিনয় করেননি।
১৯৬৪ সালে
ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে।
১৯৭৬ সালে
তিনি চলচ্চিত্রে তাঁর সারা জীবনের অবদান স্বরূপ দাদা সাহেব ফালকে পুরষ্কার পান।
ঋণ
সবারে আমি
নমি/কানন দেবী/ এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড।
আলো নেই/
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়/দেজ।
ইউ টিউব। উইকিপিডিয়া।
গুগুল ইমেজ। কয়েকটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখা, কথা।
সিনে গিল্ড,
বালী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন