বাড়ির নাম কণিকা (শেষ পর্ব)



একটা সরু গলির আদ্যপান্ত কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। একটুও বোঝা যাচ্ছে না আসলেই ঠিক কতগুলো বাড়ির পরে কণিকা? ঢোকার মুখে ডানহাত বরাবর যে কয়েকটা বাড়ি সেগুলো তো সব নতুন। আর বাঁ পাশের দিকে তো উঠে গেছে বড় বড় সব এ্যাপার্টমেন্ট! তাহলে কী লোকটা ভুল বললো আমাদের? আচ্ছা হীরক সামনের বাড়িটা কি? ওই তো একটা পুরোনো বাড়ি! জুনায়েদ এগিয়ে যায়। কিন্তু কী করে হবে? এটা তো কানাগলির সেই প্রান্তিক বাড়ি নয়। হীরক বলে আমরা এগিয়ে যাই দাদা। নিশ্চই পাবো। সানি বলে ওঠে। হ...পাবে...ক্যামনে পাবে তুমি? দেখছো না চারিদিকে শুধু ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট...। ইঁটের জঙ্গলে ভর্তি? আমরা আশা ছাড়ি না। ক্ষীণতম আলোয়, সবে নামা এক বর্ষার সন্ধ্যায় এগিয়ে যাই গলির পথ ধরে। থমকে দাঁড়াই একটা বাড়ির সামনে। বলি...মাধবীলতায় মোড়া এই...এই বাড়িটা কী? কিন্তু সামনের বারান্দা কোথায়? কোথায় সেই গেট জোড়া বাগান? ফাহমিদ এগিয়ে এসে বলে কলিংবেল দিই দাদা? যাই না... একবার বাজিয়েই দেখি?


“আমার একাত্তরের দিনগুলি বইটি ইতিমধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং বইটি পড়ার পর অনেক পাঠকই বাড়ি খুঁজে বের করে খবর নিয়ে গেছে। তারা আমাকে দেখতে চায়। আমি দেশে নেই শুনে অপেক্ষা করেছে। আমি আসার পর তাদের অনেকেই একে-একে এসে দেখা করতে লাগলো। আমাকে তো চেনে না, আগে দেখেনি কখোনো, আমার ভাস্তের মেয়ে রিমা যখন দরজা খুলে তাদেরকে দোতলায় সোবার ঘরে নিয়ে আসে তারা প্রথমে আমাকে দেখে চিনতে পারে না। রিমা যখন বলে ইনিই। তখন তারা একটা ধাক্কা খায় মনের মধ্যে। সেটা তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে। চমকে রুদ্ধশ্বাসে বলে ই-নি-ই। তখন মনে হয় ধরণী দ্বিধা হও। এরা এই বই পড়ে এক সনাতন বাঙালী মাকে দেখবে বলে আশা করে এসেছে। তার বদলে এই খাটো চুলের জিভ বের করা মহিলা! তারা মেলাতে পারে না। অবশ্য মিনিট খানেকের মধ্যে সামলে নেয়। তারপরে বসে সহজ কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে। বলে কীভাবে, কত কষ্ট করে বাড়ি খুঁজে বের করেছে। বইতে লেখা আছে বাড়ি থেকে বেরিয়েই ডানদিকে দু-তিনটে গলি পেরিয়েই পলিক্লিনিক। তারা পলিক্লিনিক ধরে উলটো পথে হাঁটতে হাঁটতে এসে বহুজনকে জিজ্ঞেস করে করে বাড়ি খুঁজে বের করেছে। এসে শোনে আমি নেই। হতাশ হয়ে চলে গেছে, মাঝে মাঝে এসে বা ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে কবে ফিরব? বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা আসে।” (ক্যান্সারের সাথে বসবাস/ জাহানারা ইমাম সমগ্র/ পৃষ্ঠা- ৪৫২-৪৫৩)


কলিংবেল বাজে। কেউ দরজা খোলে না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমরা জনাকয়েক। মাঝে মাঝে বর্ষার আকাশে বিদ্যুতের ঝিলিক। গুমোট গরম আর অস্বস্তি ঘিরে ধরছে আমাদের। আমার চারপাশে ঘিরে থাকা বয়সে ছোট অনেক লেখকদের। ওরা সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে কণিকা নামের বাড়িটাকে। যে বাড়িতে থাকতেন শহীদ জননী...যে বাড়িতে থাকতো রুমী...যে বাড়ি থেকে একদিন বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি সে। তাকে ফিরতে দেওয়া হয়নি। অথচ দেশ স্বাধীন হয়েছে। অনেক বছর কেটে গেছে। একাত্তরের দিনলিপি রজত জয়ন্তী সংস্করণ পেরিয়ে গেছে। একটা বাচ্চা মেয়ে দরজা খুলে দেয়। আমাদের, অতগুলো মানুষকে দেখে সে একটু থতমত। কাকে চাই প্রশ্নের জবাবে যখন সে জানতে পারলো আমরা কণিকা নামের একটা বাড়িকে চাই, তখন সে ঠোঁট উলটে জবাব দিল এমন নামের বাড়ি সে চেনে না। আচ্ছা তাহলে কি সে শহীদ জননীকে চেনে? মাথা নাড়লো ছোট্ট মেয়েটি, চেনেনা সে। আমাদের মাথার ওপর বর্ষার কালো মেঘ। পায়ের নীচে মাটি দুর্বিসহ হতাশায় কাঁপছে। ঠিক তখনি, মনে হয় অনেক অপেক্ষার চূড়ান্ত সীমা কাটিয়ে সেই প্রায় অন্ধকার গলির মধ্যে এক জন বয়স্ক দ্বাররক্ষী এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। কারে খুঁজছেন আপনারা? এগিয়ে যায় জুনায়েদ, চাচা, সালাম, আমরা আসলে একটা বাড়ি খুঁজছি...তার নাম কণিকা...শহীদ জননী...। কথা শেষ করতে পারে না জুনায়েদ। বয়স্ক ভদ্রলোক আঙুল তুলে আমাদের যে বাড়িটার দিকে দেখান, কোথাও যেন তার সাথে...আশে পাশে বইয়ের বর্নণা...রুমীর গেরিলা প্রস্তুতি... রজনী গন্ধার ফুলের টব, শেষ বিদায়বেলায় সেই রাতের ঘন কালোর আঁধার তমশায় পাকিস্তানি মিলিটারী বুকের শব্দ। রুমীর একবারও পেছন ফিরে না তাকানো। বারবার...বারবার...ফিরে আসে। আর সেই দোতলা ঘর...? যেখানে জমায়েত হত রুমী আর তার বন্ধুরা? যে ঘরের মাটি পুরু করে কার্পেটে মোড়া ছিল। যে ঘরে দিনের পর দিন হতো দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন? যে ঘরে বসেই ছকা হয়েছিল ২৫ অগাস্ট রাতের একশান প্ল্যান। আমরা তাকালাম সবাই সমবেত ভাবে। আমরা তাকালাম ইতিহাসের দিকে। আমরা তাকালাম একটা বাড়ির দিকে। যার নাম কণিকা। কিন্তু সেখানে...আমাদের যাবতীয় কৌতূহল, আমাদের যাবতীয় আকাঙ্খা, আমাদের যাবতীয় স্বপ্নকে ভেঙেচুরমার করে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছোঁওয়া এক অট্টালিকা। নেই সেখানে কণিকা। জানা গেল বেশ কয়েকবছর হল বাড়িটা ভাঙা পড়েছে। বিশ্বাস হলো না আমাদের। সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলেন বয়স্ক সেই দ্বাররক্ষী। আমরা দেখলাম ফ্ল্যাটের নীচে শহীদ জননীর মুখ ফ্রেস্কোতে উজ্জ্বল। লেখা আছে কণিকা। কিন্তু এই কণিকা দেখার জন্যই কি আমি ছুটে গিয়েছিলাম? নাকি আমার লেখকবন্ধুরা আমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ছিলেন? সবাই যখন চুপ। বাতাসে ভারী জলীয় শব্দ ছাড়া ওই অন্ধকার গলি থেকে কিছু উঠে আসছে না, আর ঠিক তখনই সেই রক্ষী শোনালেন এক আশার কথা। “আপনারা শনিবার আসুন। দুপুর একটা নাগাদ। তখন দোতলার মিউজিয়ামে যেতে পারবেন। আম্মার কিছু কিছু জিনিস রাখা আছে। আমরা ঠিক করলাম আমরা আবার ফিরে আসবো। রুমীর পায়ের চিহ্ন ধরে। খুব সুন্দর কথাটা আস্তে আস্তে বললো নাসিমূল। এখনি কি বৃষ্টি পড়বে? নাকি আমাদের চোখের পাতা ভারী?
 

“রুমী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো। জিম রিভস বেজে বেজে এক সময় থামলো। রুমী উঠে আর একটা রেকর্ড লাগালো, বললো আম্মা, গানটা শোনো মন দিয়ে। টম জোনসের গ্রীন গ্রীন গ্রাস গানটা বেজে উঠলো। বহুবার শোনা এ গান। রুমী এটা প্রায়ই বাজায়। শুনতে শুনতে সুরটা আমারও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, যদিও ইংরেজি গানের কথা বিশেষ বুঝি না। তিন মিনিটের গানটা শেষ হলে রুমী আস্তে আস্তে বললো, গানটার কথা শুনবে? এক ফাঁসীর আসামী তার সেলের ভেতর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে। সে ট্রেন থেকে নেমেই দেখে তার বাবা-মা আর প্রেয়সী মেরী তাকে নিতে এসেছে। সে দেখলো তার আজন্মের পুরোনো বাড়ি সেই একই রকম রয়ে গেছে। তার চারপাশ দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে সবুজ সবুজ ঘাস। তার এতো ভালো লাগলো বাবা মাকে দেখে, তার প্রেয়সী মেরীকে দেখে। তার ভালো লাগল সবুজ সবুজ ঘাসে হাত রাখতে। তারপর সে হঠাৎ চমকে দেখে সে ধূসর পাথরের তৈরী চার দেওয়ালের ভেতরে শুয়ে আছে। সে বুঝতে পারে সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। আমি বলে উঠলাম চুপ কর রুমী চুপ কর। আমার চোখে পানি টলমল করে এলো। হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে নিলাম। রুমী...রুমী এতো কম বয়স তোর পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না। রুমী মুখ তুলে কি একরকম যেন হাসি হাসি হাসলো। মনে হল অনেক বেদনা সেই হাসিতে। ”(একাত্তরের দিনগুলি/জাহানারা ইমাম/ পৃষ্ঠা- ১৭৫)


কয়েকদিন পরেই রুমী ধরা পড়ে যায়। আর ফিরে আসেনি সে। ফিরতে দেওয়া হয়নি তাকে। অনেকের মতোই। আজ এই প্রায়ন্ধকার গলির সামনে কণিকা নামের এক বিরাট অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল এই বাড়িটাকেই কি খুঁজতে এসেছিলাম আমরা? নাকি কারো বেদনার তাপ পুইয়ে নিতে এসেছিলাম দু-পাঁজর উজার করে? কি চেয়েছিলাম এক মায়ের কাছ থেকে আমরা? অসুস্থ শরীরে যখন তিনি যুদ্ধ শানাচ্ছিলেন সেই রাজাকারদের বিরুদ্ধে? আমরা কি তাকে কিছু দিতে পেরেছি? ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামলো। 

 “আজ সত্যি সত্যি এতো বছর পরে যদি রুমী ফিরে আসে?” আমরা সবাই চমকে তাকালাম হীরকের দিকে। “আমাদের কিছু বলার থাকবে না দাদা...একরাশ হতাশা ছাড়া...।”


লেখাটা এখানেই শেষ করে দিচ্ছি। মানে দিতে বাধ্য হচ্ছি। অনেক লেখায় যেমন আমি সুস্থির থাকতে পারি। নিজেকে গুছিয়ে উঠতে চেষ্টা করি। ল্যাপটপের কি-প্যাডকে নিজের বশ্যতা মানতে বাধ্য করি এবার সেটা হয়ে উঠছে না।  আবেগঘন উপসংহারে যেতে পারছি না। কিম্বা লিখতে পারছি না কিছুই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে সব কিছু। এমনটা তখনি হয়, যখন আমি কারো প্রেমে পড়ি। আমি লক্ষ্য করেছি আমি প্রেমে পড়ে গেছি একটা ছেলের। যার সামনের বড় দুটো দাঁতের একটার নীচের দিকটা একটু ভাঙা। সবসময় হাসে। আর হাসলে গালে টোল পড়ে। অসম্ভব পজেটিভ এনার্জি নিয়ে সারক্ষণ হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফটো ফ্রেম থেকে। যার মা-বাবা একদিন তাকে এগিয়ে দিয়েছিল দেশের জন্য...মৃত্যুর পথে। শহীদের পথে।  


বর্ষার এক ঝলমলে বৃষ্টিভেজা শনিবারে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে আমার জীবনের একটাই প্রাপ্তি থাকে। সেটা অনেক বড় প্রাপ্তি। আমার লেখক বন্ধু হীরক এসে বলে সে রুমীকে নিয়ে জীবনীমূলক উপন্যাসে হাত দিতে চায়। মন কেমনের অলি গলিতে ঘুরে ঘুরে প্রায় একবছর হতে চললো। আমরা জানি একদিন সত্যি রুমী ফিরে আসবে আবার...বাংলার এই মাঠ...ঘাট...নদী...মাটির গন্ধ স্পর্শ মেখে...হীরকের হাত ধরে...আমাদের কাছে। কোথা থেকে যেন ভেসে আসে...কেউ আবৃত্তি করছে...কেউ কি কোনো সংকেত পাঠাচ্ছে। বাতাসে কান পাতি...
"দেখতে কেমন তুমি? কি রকম পোশাক আশাক
প'রে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবর জং, ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতোই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?
দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আতিপাতি! তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন 
করে খোঁজে প্রতি ঘর। পারলে নীলিমা চিরে বের 
করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার।"
(গেরিলা/ শামসুর রহমান)



কৃতজ্ঞতা- 
বই- একাত্তরের দিন গুলি। ক্যান্সারের সাথে বসবাস। জাহানারা ইমাম সমগ্র। জাহানারা ইমাম।
ছবি- গুগুল ইমেজ
হীরক, নাসিমূল, ফাহমিদ, জুনায়েদ, সানি, রাজীব, এনা, পিউ, লীনা, শারওয়ার, অমলদা, রাকিন। আমার লেখক বন্ধুরা। 

মন্তব্যসমূহ

  1. প্রথমে যখন পড়ছি এটাই শেষ পর্ব তখন খুব অবাক হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম দাদা এত তাড়াতাড়ি শেষ করছেন, কিন্তু পরে, লেখায় ব্যাখ্যা পড়ে, মনে হয়েছে তাই তো... এই আবেগ কী করে সংবরণ করা সম্ভব। এই প্রেম? আর আমার ভয়টা দাদা ওখানে, রুমীকে নিয়ে লিখতে তো আমি চেয়েছি, পরিশ্রমটুকুর কথা বাদ দিলেও আবেগের যে ধারা আছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করি কী করে? আপনার লেখায় আমি নিজেকে পেয়ে যেমন সম্মানিত বোধ করছি, একই সাথে যে নিদারুণ দায় আমার ওপর দিয়েছেন তা নিয়ে শঙ্কা বোধ করছি। তবে, লিখবই। আর আমি জানি, সে লেখায়, আপনার দু'হাত প্রসারিত ভালোবাসা আর রাতজাগা সাহায্যও পাবো।

    উত্তরমুছুন
  2. আমি আশায় থাকলাম হীরক। শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি