হারানো সময়ের ইতিবৃত্ত
বিশুর মন খারাপ হলে দাঁত দিয়ে নোখ
কাটতো। আর ক্লাসের শেষ বেঞ্চে দেওয়ালের কোণে গিয়ে চুপ করে বসে থাকতো। সেই সময়
বিশুকে আমরা বেশি ঘাঁটাতাম না। একই ক্লাসে দু-বার তিনবার থাকা বিশুর রেকর্ড ছিল।
বিশু আমাদের থেকে বয়সে ছিল বড়। তা সত্ত্বেও বিশুকে আমরা দাদা বলে ডাকিনি কোনোদিন।
তাহলে সেই বিশুর মন খারাপ আমাদের মনের কোনে ঠাঁই নিতো কেন? কারণ... বিশু সেই লাস্ট
বেঞ্চের কোণের দেওয়ালে ভরিয়ে তুলতো মন খারাপের রেখাচিত্র। দাঁতে কাটা আধ খাওয়া নখ
দিয়ে বিশু আঁকতো তার মামার বাড়ির গ্রামের তাল গাছ। ছোট নদী। পাল তোলা নৌকা। প্রথম
বেঞ্চে বসা ছেলেদের এই ছবির খোঁজ পাওয়া সুবিধের নয়। কিন্তু যারা লাস্ট বেঞ্চের
মনের হদিস রাখতো তারা ঠিক পৌঁছে যেতে পারতো মন কেমনের পর্দার পেছনে দেওয়ালের
রেখাচিত্রের সেই সাদা কালো কিম্বা রঙ্গীন বর্ণময় জীবনে।
আমাদের স্কুলের দেওয়াল ছিল এমনই অনেক
বিচিত্র চিত্রের রহস্যময় ভান্ডার। স্কুলের দ্বাররক্ষী লালুদার ছোট্ট টুলের পাশের
দেওয়ালে ছিল রবীন্দ্রনাথের অবয়বের দিকে তাকিয়ে আছে একটা কোলা ব্যাঙ। কিম্বা হেড
স্যারের ঘরের প্রবেশের দরজার ঠিক পাশের দেওয়ালে কেউ হাঁটু মুড়ে কান ধরে বসে থাকার
সময় এঁকে গিয়েছে একটা লিন ডাউনের ছবি। হুবহু শাস্তি পাওয়া ছেলের ব্যাজার মুখসহ।
টিফিন ঘরের উঁচু জানলাটার পাশেই কেউ অনেক কষ্টে আর বানান ভুলে লিখেছে “অল্পেতে
খুশি হবে দামোদর শেঠ কি?” পাশে একটা ছেলের হাতে এক ঠোঙা কুল আর কাঠি আইসক্রিম।
ক্লাসে ঢুকেই একদিন আমাদের সবার চোখ ছানা বড়া। সবে সপ্তম শ্রেনীর নতুন ঘরে বসা
শুরু করেছি। মাঘের শীতের চাদর গায়ে মেখে ঠোঁটের ওপরে ওঠা হালকা কালচে রেখা নিয়ে
যখন সবাই বেশ রহস্যময় তাত্ত্বিক অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। বয়ঃসন্ধি যখন প্রকাশ্যে ও
নিভৃতে হাতছানি দিচ্ছে...ঠিক তখনি আমাদের ক্লাসে সারা দেওয়াল জুড়ে মোটা মোটা গোঁফের
ছবি। তাও আবার কালো প্যাস্টেল কালার দিয়ে আঁকা। ক্লাস টিচার শশাঙ্কবাবু এসে চিৎকার
করলেন। শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিলেন ক্লাস বয়কট সহ। কিছুতেই কেউ এগিয়ে এলো না দোষ
স্বীকারের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জল গড়ালো অনেকদূর। হেডস্যার
সবাইকে যখন ‘রাস্টিকেট’ করতে যাবেন। মাঝের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো পল্টু। স্যারের
চোখে চোখ রেখে বললো সেই এঁকেছে এই বড় বড় গোঁফ। মাত্র কয়েকদিন পরেই তাকে চলে যেতে
হবে বাবার কর্মস্থলে। নতুন স্কুলে। কিন্তু পল্টুর তো শোনা আছে বিবেকানন্দের সেই
গুরু গম্ভীর বানী। “ওরে...যাবার আগে দাগ কেটে যা”। তাই পুরোনো স্কুল থেকে নতুন
স্কুলে যাবার আগে দেওয়ালে বড় বড় গোঁফের ছবি এঁকে দাগ ধরিয়ে গেছে। অনেক দিন পরে
কৈশোরের সেই অনেক আলো আর রোদে ভরা দিন গুলোর দিকে তাকায়ি আজ ঠিক মনে করতে পারছি না
হেড স্যারের মুখটা। তিনি রেগে গিয়েছিলেন নাকি ক্লাসে বলা তাঁর নিজের গল্প নিয়েই
দ্বিধায় ছিলেন? এখন বুঝতে পারি কিছুটা, যখন পড়াই, সেমিনারে বক্তৃতা দিই। আদৌ যা
বলছি, যা বোঝাচ্ছি...যেভাবে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি সেভাবে পৌঁছোতে পারছি তো
সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর কাছে?
দেওয়ালের রেখা চিত্রের কি সেই
দায়বদ্ধতা থাকে? মন খারাপের সময়...কিম্বা মনের ফূর্তিতে যে সৃষ্টিশীল মানুষ নিজের
মনের ইচ্ছে অনুযায়ী এঁকে চলেছেন, কিম্বা পাশের দেওয়ালটিকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে
ভরিয়ে তুলছেন... তার কি অনেক লোকের কাছে পৌঁছে যাবার ইচ্ছে থাকে? শিল্পী তাঁর
শিল্পের জন্ম লগ্নে কি ধরে নেন, কোনোদিন কেউ দেখবে আমার এই রেখাচিত্র? নাকি নিছকই
সময়ের ফাঁকপূরণে তার ব্যবহার? ইতিহাস
অবশ্য অন্য কথা বলে। রাজা মহারাজ আর তার শিল্পী গোষ্ঠীকে ছেড়ে ইতিহাস যখন ফিরে
তাকায় সমাজের সেই ধূসর অংশের দিকে তখন তাকে রাস্তায় নামতে হয়। ঘিঞ্জি লোকালয়ে
বেরিয়ে পড়তে হয়। থমকে দাঁড়াতে হয় জ্বরা, মৃত্যু, ক্রোধ, ব্যাধি, অন্ধকার, আর অনেক
আলোর সামনে। কখনো ইতিহাস এদের স্বীকৃতি দেয়। আবার কখোনো দূরে ঠেলে ফেলে। ভুলিয়ে
দেয়, আদৌ কোনো এক সময়ে কেউ এমনটা করেছিল। যখন অবাক হয়ে ভাবি কোনো এক রাতের আঁধারে
কিম্বা সকালের প্রথম সূর্যে সেই আদিতম শিল্পী গুহার গায়ে এঁকেছিল তার শিকারের
গল্প। আলতামিরার গুহার চিত্রে আমরা পেলাম হাজার হাজার বছর আগের আমাদের পূর্বজদের কথা।
আমরা পেলাম যূথবদ্ধতার রেখাচিত্র। আমরা পে্লাম আশ্চর্য আগুনের ব্যবহারের নিদর্শন।
অজন্তার গুহায় পেলাম সেই সময়ের শিল্পীদের মনের ছোঁওয়া। তা সে ঈশ্বরের কাহিনী
হোক...কিম্বা কোনো শ্রমণের মনের এক শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ।
এইসব এখন বহুল আলোচিত। উচ্চশিল্পের
অংশ। এইগুলিকে আমরা ধারণ করে রেখেছি পৃথিবীর ক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস হিসেবে।
কিন্তু আমার স্কুলের দেওয়ালে বাসুর মনকেমনের তালগাছের ওপর নিশ্চই এই কুড়ি বছরে বার
সাতেক চুনের পোঁচ পড়েছে। পল্টুর গোঁফ খুঁজে পাওয়া যায়নি তার কিছুদিন পরেই। সারা ঘর
হলুদ রঙ করে দিয়ে হেড স্যার বলেছিলেন দূষণ মুক্ত দেওয়াল তিনি আমাদের উপহার
দিলেন। তখন মোবাইল ছিল না। ডিজিটাল যুগ আসেনি। আলেকজান্দার আস্ত্রুকের ভবিষ্যত
বানী, “ক্যামেরা-লেখনী” তখন আমাদের থেকে বহুদূরে। কাজেই আদিমকালের তোড়ায় বাঁধা
ঘোড়ার ডিমকে আমরা কিছুতেই কোথাও ধরে রাখতে পারিনি। বলতে পারেন সংরক্ষিত হয়নি পল্টু
কিম্বা বাসু। নিছকই মনের খেয়াল বলে আমরা দেওয়াল মুচেছি বারবার। কিন্তু দেওয়ালের
লেখা পড়তে পারিনি অনেকেই।
হঠাৎ সেবার শীতের ঝরা পাতার মরশুমে
দাঁড়িয়ে পড়ি চারুকলার প্রবেশ দ্বারের মুখে। দেওয়ালের কোনে কেউ একজন যেন লিখে
রেখেছে “রেভলিউশান কামিং”। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু কবি পারভেজ চৌধুরী। ঘুরে তাকিয়ে
পারভেজ ভাইকে বললাম, “ দেখেছেন পারভেজ ভাই?” বাইরে তখন ঢাকার হরতাল। শাহবাগের মুখে
জমাট বেঁধে আছে তরুনরা। অনেকে মেতেছেন কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তর্কে। দেবালয়
কলকাতা থেকে ফোন করছে। তুই কোথায়? ঠিক আছিস তো? মা চিন্তিত। আমরা চুমুক দিচ্ছি
মধুদার ক্যান্টিনের কড়া লিকার চায়ে। কিম্বা মধ্যরাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি ঢাকা শহরের
রাস্তায়। ভোরের কুয়াশা মেখে আমি আর ফাহমিদ ফুল দিয়ে আসছি ভাষা শহীদের বেদীতে। আর পারভেজ বলে
চলেছেন একের পর এক গল্প। স্বাধীনতার, স্বাধীকারের...সত্তর দশকের...মুক্তি যুদ্ধের।
একদিন হঠাৎই আমার সামনে তাঁর দামী ফোনটা দেখিয়ে বললেন, “কিছু জিনিস আপনাকে দেখাই
কল্লোল”। আমি চমকে গেলাম। মনে মনে বললাম কোথা থেকে ফিরে এলো বাসু? কোথা থেকে ফিরে
এলো পল্টু? কোথা থেকে আমাকে ফেরত দিচ্ছেন পারভেজ ভাই আমার কৈশোরের দিন গুলি? আমি
চেয়ে রইলাম সেই দামী মোবাইলের স্ক্রিনে। আমি দেখলাম সাদা দেওয়ালে শ্যাওলার দাগের
পাশে কারও একটা বিষণ্ণ মুখ। নোখের আঁচড়ে কিছু অবয়ব। কিম্বা কয়েকটা লাইনে কিছু
ব্যাক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা। পারভেজ ভাই হাসলেন। “কখোনো এফ ডি সি...কখোনো অফিসের
পাশের দেওয়াল। কখনো পথ চলতি দেওয়াল থেকে তুলেছি ছবি গুলো। দেওয়াল মনের কথা বলে তাই
না কল্লোল?” আমি বলি শুধু মনের কথা নয়। তার থেকেও অনেক...অনেক কিছু বলে এই ছবি। আপনি
সংরক্ষণ করছেন এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের ভাস্কর্যকে।
আমরা যখন আমাদের জীবনের স্ট্যাটাস
রক্ষা করি দামী ফোনের সেলফিতে। ঠিক তখনি পারভেজ ভাই ফেসবুক আর হোয়াটস আপের
ভার্চুয়াল জগতের বাইরে এই টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়েছেন কিছু মানুষের হারিয়ে যাওয়া
সময়ের, মনের কথা গুলো সংরক্ষণ করতে। হোক না সেটা স্বল্প পরিসর। হোক না সেটা নাম না
জানা, না চেনা তথাকথিত উচ্চতর শিল্প। কিন্তু দেওয়ালের লেখা পড়ার পক্ষে কি যথেষ্ট
নয়? যে দেওয়ালের রেখা অনেক সময়ে আমরা পড়তে পারি না বলে চলে যাবার আগে কোনো দাগই
কেটে যেতে পারি না। পারভেজ ভাই সেই দেওয়ালের দাগ গুলো চিনে নিচ্ছেন, বুঝছেন।
সংরক্ষণ করছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা একটা অনন্য প্রচেষ্টা। মনে হয়েছে হারানো
সময়ের ভাস্কর্য নিভৃতে ‘মেটা-ডেটা’ ফাইলের মতো কোথাও না কোথাও জমা হচ্ছে ভবিষ্যত
ইতিহাসের জন্য।আর সেই ইতিহাসের বেশ কিছুটা থেকে যাচ্ছে পারভেজ ভাইয়ের নিরলস ছবি তোলার আগ্রহে...আনন্দে। তার সেই অনেক আলোর...আর মজার যাত্রায় আমিও যে কিছুদিন সামিল ছিলাম। আপনি ভালো থাকুন পারভেজ ভাই। অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।
ছবি সৌজন্য-
পারভেজ চৌধুরী ।
খুব ভাল লাগল।
উত্তরমুছুন