ঠাকুর আনতে গিয়ে



আকাশ মেঘলা। তার সাথে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ দেখে বোঝার উপায় নেই এটা শরত না বর্ষা?  ঘনি তার ইলিশ মাছ ধরার নৌকো নিয়ে চলেছে বাগবাজারের বিচালি ঘাটের দিকে। ওখানেই গঙ্গাপ্রসাদ রুদ্র পালের স্টুডিও, ওখান থেকেই কুমোরটুলির শুরু। আমাদের যাত্রাপথ সেইদিকে। 

নৌকা একটু বেশি দুলছে মনে হচ্ছে ঘনি?

সারা রাত না ঘুমোনো চোখে ঘনি বলে আজ জলের টান থাকবে ব্যাপক। মাকে ঠেলে তুলতে হবে নৌকায়।

যাচ্ছি ভাঁটার টানে ফিরবো জোয়ারে। আমাদের পেছনে বেশ বড় দুটো নৌকো। সেগুলোতে আছে পাড়ার আরো ছেলেরা, ঢাকি, কুড়কুড়ি। পুজোর বেশ কিছুদিন বাঁকি কিন্তু ঠাকুর আনতে যাওয়ার এই তোড়জোড় আমাদের সেই আদ্দি কালের। এখনও গঙ্গার ওপর দিয়ে, নৌকা করে ঠাকুর আনার হাতে গোনা যে কটা ঐতিহ্য টিকে আছে তার মধ্যে বালী বারাকপুর সার্ব্বজনীন দুর্গা পুজো একটি। ঠাকুর কুমোরটুলি থেকে নৌকো করে আসে এপারে। এই ঠাকুর আনতে যাওয়া নিয়ে কত ঝগড়া, বায়না, কান্না-কাটি ছোটবেলায়। সেটাও তো প্রায় ইতিহাস হতে চললো।
বেলুড়মঠ ছাড়ালেই হুগলী নদী যেন তার আশে পাশের বহরে একটু বেড়ে যায়। মাঝ নদীতে এলে সার সার বন্ধ কারখানার দিকে নজর পড়ে। এক সময় স্বর্ণ তন্তুর যুগে রমরম করতো হুগলী নদীর বাণিজ্য পথ!
হায়! সেদিন আর কোথায়? 
তবু এখন অল্প বিস্তর মিলিটারি জলযান, সরকারি লঞ্চ, আর ঘনিদের মতো ছোট ছোট মৎস্যজীবীরা হুগলী নদীর বুকে ভাসে। অনেক রাতে যদি কোনোদিন জেলে ডিঙিতে বালী থেকে বাগবাজার আসেন তাহলে দেখতে পাবেন শুধু এই নদীপথটুকুকে কেন্দ্র করে বেঁচে আছে কত মানুষ, কত রকমভাবে। কিন্তু সে অন্য গল্প। অন্য উপাখ্যান‍!
তেড়ে বৃষ্টি আসে। একহাতে ছাতা অন্য হাতে ক্যামেরা। নৌকা দুলছে। ঘনি গজ গজ করছে। মোবাইল বেজে ওঠে। স্টার আনন্দ থেকে রত্না করছে। ওবি ভ্যান এসে গেছে ঘাটে। সরাসরি সম্প্রচার। আর কত দেরি? বলি এই তো চলে এসেছি দেখতে পাচ্ছি ঘাট! 

ক্যানিং থেকে এসেছেন রামু দাস, গফর মিঞা, হারু মন্ডল আরো অনেকে। ঠিক এই সময়ে জমিতে ধান রুয়ে শরতের মেঘকে বলে আসে ধারাপানি দিও না মেঘ, থুয়ে থুয়ে রেখো ফসলেরে। জনা পঞ্চাশের এই দল পুতুল ওঠানো নামানোর কাজ করে থাকেন।

হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, আমরা যেমন প্রতিমা বলি কুমোরটুলিতে বলা হয় পুতুল। আর এঁদের বলা হয় পুতুল নামানোর দল। নৌকায় এরা ঠাকুর তুলে দেবে, তারপর আবার ঘাট থেকে প্যান্ডেলে নিয়ে যাবে। এত কসরতের পর পারিশ্রমিক পাবে যাট কিম্বা সত্তর টাকা। বৃদ্ধ চরণদাস মেঘের দিকে তাকিয়ে বলেন নেন এবার পুতুল তোলার তোরজোর শুরু করেন। মেঘ কাটলো বলে। তখোনো আমাদের মাথায় এক কালো মেঘের বোঝা গুম হয়ে বসে আছে। মনে মনে ভাবি ইশ অতোই সোজা এই মেঘ কাটার। ইয়ার্কি নাকি? আজ হয়তো ঠাকুর নিয়েই যেতে পারবো না। মাঝ নদীতে বৃষ্টি এলে? কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনলো না। চরণদাস বলে দিয়েছে মানে পুতুল ওঠাতে হবে। যারা চালচিতরি, ঠাকুরের অস্ত্র, চাঁদমালা কিনতে গিয়েছিলো তারা সব কেনাকাটা করে ফিরে এসেছে। স্টার আনন্দ লাইভ টেলিকাস্ট শুরু করে দিয়েছে। ঘাটে বাজছে কুড়কুড়ি আর ঢাক। বেশ কয়েকজন নেমে পড়েছে ধুনুচি নাচের আসরে। ছবি তোলার হুড়োহুড়ি। আর ঠিক এর মধ্যে জোয়ার এসেছে নদীতে, চরণদাসের কথা মতো মাথার ওপর কালো মেঘের বোঝা কোথায় যেন পাততারি গুটিয়েছে। হালকা মেঘের পাশ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে শরতের সোনালী রোদ। 

দুটো নৌকো জোড়া লাগানো হয়েছে পাশাপাশি। আগে উঠলেন মা দুর্গা, তারপর লক্ষ্মী, তারপর সরস্বতী, তারপর গণেশ সব শেষে কার্তিক। এটা নিয়ম। 

নৌকা যখন ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনি কোথা থেকে গঙ্গার পাড়ের কোনো এক মন্ডপ থেকে ভেসে আসছে সানাই। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে আর সবাই চিতকার করে বলে উঠছে বলো দুর্গা মাকি। জয়! সমবেত আওয়াজ ঘুরপাক খাচ্ছে হুগলী নদীতে।

চরণদাস ঘাট থেকে মাকে প্রনাম করে। এবার তার সমস্ত ধান ভেসে গেছে বন্যায়। ছোটো মেয়েটা মরেছে সাপের কামড়ে। নাতিটার পরনে ছেঁড়া জামা। সেও এসেছে দাদুর সাথে পুতুল তুলতে। ক্লাস এইটে পড়ে। ফিরবে লক্ষ্মীপুজোর পরে। হাঁটু পর্যন্ত কাদা মাখা লোকগুলো টপাটপ নৌকায় উঠে পড়ে। মাঝিদের তাড়া লাগায়। কারণ ফিরে এসে আবার একটা পার্টি ধরতে হবে। না হলে গ্রামে ফিরে পুজোর পর হাঁড়ি চড়বে না। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিতে হবে। চরণদাসের নাতির হয়তো আর স্কুলে যাওয়া হবে না। 

প্রত্যেক বছর ঠাকুর আনতে গিয়ে যে মানুষগুলোকে দেখি তাদের গল্প কোনোদিন পালটায় না। কিন্তু আমাদের ঠাকুর, আমাদের প্যান্ডেল, আমাদের থিম পাল্টাতে থাকে। মোটা অঙ্কে বাড়তে থাকে পুজোর বাজেট। তাই আশি হাজার টাকার ঠাকুরের জেল্লার পাশে কোথায় যেন হারিয়ে যায় চরণদাসের ছেঁড়া গেঞ্জি, কাদা মাখা পা।

ঘনির ডিঙার সাথে দুই বড় নৌকা খুব নিরাপদে মা দুর্গার সপরিবার সমেত আমাদের নামিয়ে দেয় গন্তব্যে।
  
না। মাঝপথে কোথাও এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি।
না।  মাঝ পথে কোথাও দুলে ওঠেনি নৌকা।
না। তার পরের বছর কিম্বা তারপরেও আমি চরণদাস আর তার নাতিকে খুঁজে পাইনি।
পেয়েছি অন্য চরণদাসদের। অন্য নাতিদের। প্রতি বছরের এক গল্প নিয়ে।
তবু সেই এক গল্পের খোঁজ পেতে...সেই মানুষগুলোকে দেখতে...আমি এখোনো যাই এই নদী পথে। শুধু সময়টা পালটে যেতে থাকে। আর বয়েসটাও। 

 লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল মাই আনন্দবাজার ডট কম-এ। সাল-২০১১।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি