স্মৃতির কেনাকাটা
এক
মাধ্যমিকের পর থেকে পুজোর সময় আর নতুন জামা প্যান্ট কিনিনি কোনোদিন। পরিনি
নতুন জামা কাপড় পুজোর সময়। এখোনো পর্যন্ত সেই নিয়ম বহাল আছে দিব্বি।
কোনো বিশেষ কারণে নয়।
বাবার শরীর আরো ভাঙছিলো, আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের খুব
কাছের মানুষটা এবার বিদ্যাধরীর, ইচ্ছামতীর সব রূপ রস গন্ধ স্পর্শ নিয়ে চলে যাবে
আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে। গিয়েও ছিলো মানুষটা সেই রকমের এক মন কাড়া আশ্বিনের দুপুরে।
তিস্তার চরে যখন শাদা হয়ে থাকে কাশফুল। ঘাসের ওপর হিমেল হাওয়ায় পড়ে থাকে শিউলি,
স্থল পদ্ম আস্তে আস্তে রঙ ফোটায় বেলা বাড়ার সঙ্গে। বাবার চোখ সেই ফুলের ছটা, শরতের
আলো দেখতে পেয়েছিলো কিনা জানিনা। আমাদের ঘরগুলো ছিলো স্যাঁতস্যেঁতে, অন্ধকার।
বাবার অর্ধ নিমিলীত স্থির চোখ চেয়েছিলো আমাদের দিকে। তার কিছুক্ষণ আগে মামারবাড়ি
থেকে এসেছে বৎসরান্তের পুজোর জামা কাপড়। না সে বছর মায়ের লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে সন্ধি
পুজোয় প্রদীপ জ্বালানো হয়নি। বরণ করে সিঁদুর পরিয়ে মা দুগগার কানে কানে বলা হয়নি ‘আসছে
বছর আবার এসো মা’। নতুন জামা কাপড় গুলো পড়ে ছিলো। বিজয়ার পরদিন ঢাকি এলে দাদা সব
দিয়েছিলো তাদের।
কিন্তু শুরুটা এমন ছিলো না মোটেই, যে লোকটাকে শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী বলে
ইলেকট্রিক চুল্লীতে দিয়ে এলাম সেই লোকটাই বিশ্বকর্মা পুজোর অনেক আগে, কোনো এক রাতে
টিউশানি থেকে উঠেই বলতো ‘টুকনু রেডি হয়ে নাও, হারুবাবুর কাছে যাবো’। দাদাকে গিয়ে
চুপি চুপি বলতাম দাদা, বল না বাবাকে, এবার আমার একটা ফুলপ্যান্ট চাই। দাদা বলতো বিরক্ত
করিস না, দেখছিস না কারেন্ট নেই, হ্যারিকেনের তেলটুকু শেষ হয়ে যাবে, অঙ্ক শেষ হবে
না আমার। দাদা যায় না, অঙ্ক করতে থাকে। দাদার এবার প্যান্ট হবে না। গতবারের দুটো
আছে। আমারো হতো না, নেহাত স্লিপ খেয়ে খেয়ে ছিঁড়ে গেছে সব কটার পেছন, বোতাম গুলোও
ঠিক নেই, সেলাই এর পর সেলাই করে মাও ক্লান্ত।
হারুবাবু বালীবাজারের অনেক দিনের লোক। আশির দশকের সেই গোড়ায় মিঠুন আর অমিতাভের
রমরমা। বালীগ্রাম তার থেকে বাদ যাবে কেউ ভাবতে পারে? বাদ যায় না। তাই কেউ গোল চোঙা
প্যান্ট, কেউ টাইট লম্বা। কারো জামার বুকের ওপর তিনটে বোতাম বেমালুম হাওয়া। আমাদের
অত শত বলতে হতো না হারুবাবুকে। গিয়ে দাঁড়ালেই হারু বাবু কানে গোঁজা পেন্সিলটা বের
করে নিয়ে ফিতে দিয়ে মেপে মেপে মাপ লিখে নিতেন। আর কী অবাক করে দেওয়া ভঙ্গিতে বলতেন
মাষ্টার মশাই এবার পোলাটার ফুলপ্যান্ট হইবো তো? বাবা বলতো আচ্ছা করুন। হারুবাবু
কথা থামাতে পারতেন না। একের পর এক কথা বলে চলতেন, আইচ্ছা শুনলুম রাজশাহীতে নাকি
ধুন্ধুমার কান্ড বাধাইছে। ঢাকার অবস্থাও তো কহতব্য নয়। হারু বাবুর তিন মেয়ে দুই
ছেলে। দুই মেয়ে বাবার সাথে সেলাই করে, বড় ছেলে আলাদা, ছোটো জুটমিলে কাজ করে। অনেক
রাতে বাজার থেকে ফেরবার পথে ভীমদার দোকান থেকে গরম বাতাসা কিনে বাড়ি ফেরা। চোখ
বন্ধ করলে আমার নিজের পুজোর বাজার ঠিক এইটুকুই সিপিয়া টোন নিয়ে হাজির হয় স্মৃতির কেনাকাটায়।
তখোনো প্রাথমিক শিক্ষকদের নতুন পে কমিশন বসে নতুন মাইনে শুরু হয়নি। স্কুলের
দয়া দাক্ষিন্যের ওপর চলতে হতো। বাবাদের মাইনে পেতে পেতে মাসের শেষ। আর পুজো যদি
আগে পড়তো তাহলে হয়তো পঞ্চমীর দিন। এবার সবাই মিলে ছুটতাম বালী জনতা স্টোর্ষ। খুব
কম দামী শাড়ি, ধুতি, ফতুয়া, দাদার প্যান্ট সব কেনা হতো এখান থেকে। ফেরার সময় আমাকে
আর দাদাকে অবাক করে দিয়ে বাবা জানতে চাইতেন আইসক্রীম খাবি তোরা? আমার মুখ দিয়ে
কোনো কথা বেরোতো না। সেই কারেন্ট অফের দিনে গলা গলা আইস্ক্রিমের কাগজের বাটিগুলো
পর্যন্ত খেয়ে নিতে পারলে আমার আর দাদার শান্তি হতো।
বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলো, কারণ পুজোতে বাবা দাদাকে দিয়েছে ‘আম আঁটির ভেঁপু’। দাদা
চিতকার করে করে পড়তো, আমি শুনতাম, পিসি শুনতো, কাকু শুনতো, আমার ঝেঠতুতো দাদা
শুনতো একটা লম্বা চাটাইয়ের বিছানায় ওপার থেকে আসা মানুষগুলো সারা দিনের ক্লান্তি
নিয়ে অপুর সাথে পথ চলতে চলতে ঘুমিয়ে পড়তো। দাদা ফিসফিস করে কানের সামনে এসে বলতো,
ভাই ঘুমিয়ে পড়, কাল সক্কালে আবার পিসির জন্যে শিউলি ফুল কুড়োতে যেতে হবে।
দুই
বাইরে ঝমঝমে বৃষ্টি। থার্মোমিটারে বলছে একশো দুই জ্বর। চার তলার ওপরে দাদার
ফ্ল্যাট। ঝোড়ো হাওয়া এসে লাগছে মুখে। ভালো লাগছে বেশ, কাঁপুনী ধরা একটা শীত। যে
লোক গুলো গায়ে গা দিয়ে একসময় দশফুট বাই দশফুট ঘরে শুয়ে বসে থাকতো আজ তারা প্রায়
কেউ নেই, কিন্তু রয়ে গেছে বালী জনতা স্টোর্ষ, হারুবাবুর ভাঙা বাড়ি, আর সেই মন
কেমনের পুজোর বাজার। আমার জ্বর কপালে কে যেন হাত ছোঁওয়ায়। চোখ খুলে দেখি আমার বছর ছয়ের
ভাইঝি শ্রী। কিছু বলবি? শ্রী বলে পূর্বাশা ম্যামকে একটা ফোন করোতো, বলো এপ্রিল
মাসে যে রকমের টপ আর কেপ্রিটা কিনে দিয়েছিলো ওর থেকেও ভালো একটা টপ আর কেপ্রি আমার
চাই। আর হ্যাঁ, টপটা পিঙ্ক কালারের। আমি
হাসি। আচ্ছা বলে দেবো তোর ম্যামকে। চলে যাচ্ছিলো শ্রী, ফিরে তাকায়, বলে, কাকা। আমি
বলি কী? তোমার জ্বর ভালো হয়ে গেলে বাবা বলেছে আমরা একদিন জনতা স্টোর্ষে যাবো। আমি
উঠে বসি। কেনো? শ্রী বলে বারে কাজের পিসি, ভারী কাকুর, ধূপ দিদার শাড়ি, জামা কিনতে
হবে না?
অনেক রাতে চোখের ওপরে শুধু ভাসতে থাকে আমার পিসির জনতা স্টোর্ষের নতুন শাড়ি
পড়া হাসি মুখ। মায়ের কষা পাড়ের লাল পেড়ে শাড়ি। বাবার একটু লালচে পেড়ে ধুতি। সে
রাতে আমার আর ঘুম আসে না। মনে মনে কোথাও বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ি পুজোর বাজারে।
হ্যাঁ আমি জানি সামনেই পিতৃপক্ষ, কোথাও না কোথাও বাবা আমার খুব কাছেই আছে। হাতটা
এগোই, কিন্তু সত্যি আজ ধরার জন্যে কেউ বাড়িয়ে দেয় না। এফ এমের ঘোষিকা মাঝ রাতে
ঘোষণা করেন, এবার কলকাতায় রেকর্ড সংখ্যক পুজোর বাজার করেছে মানুষ।
অনেক পুরোনো লেখা। মাই আনন্দবাজার ডট কম-এ প্রকাশিত। ২০১১ সাল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন