পুজোর মিষ্টি স্মৃতি



জীবনের অনেক রকম স্মৃতি আমাদের মনে ঘুরে ঘুরে পাক খায়। তাদের মধ্যে কোনোটা মিষ্টি, কোনোটা তেতো, আবার কোনোটা নোনতা। তবে আজ আমি আসন পেড়ে, কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে, পাথরের থালাতে যে ব্যঞ্জন সাজাতে বসেছি তার মধ্যে আছে শুধুই পুজোর মিষ্টি স্মৃতি।
এবার মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে এটা কী পুজোর সময়ের স্পেশাল মিষ্টি? দোকান ঘুরে ঘুরে?
না মশাই, আমি বড্ড কুঁড়ে  আর ভোজন রসিক। সারা বছর ঘুরে ঘুরে যে মিষ্টি খাই, সেই মিষ্টিগুলোকে চাই পুজোর কদিন। কারণ যেটা বড় প্রিয়, যেটা বড় মন কেমনের, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্প সেগুলো সামনে না পেলে পুজোটাই মাটি।

নতাই শালপাতার প্লেটে গরম ছানার জিলিপি এগিয়ে দেয়। আমি আলতো করে কামড় দিই।  রাতের জি টি রোডের ওপর দিয়ে এখন শুধু বড় বড় ট্রাক আর কলসেন্টারের গাড়ি গুলো হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। খেয়া ঘাটের শেষ খেয়াটাও পেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এই সময় সারাদিন পর আমি রাস্তায় নামি। একটু হেঁটে গেলেই প্রদীপ পালের স্টুডিও। কাঁচা রঙের গন্ধটা বড় চেনা লাগে। এখন স্প্রে মেশিনে রঙ হয় ঠাকুর। অসুরের রঙ হচ্ছে। ঘষা কাঁচের চশমা পরা প্রদীপদা ব্যস্ত, শেষ পর্যায়ের কাজ গোটাতে। তার মধ্যে জানতে চাইলেন রাত দেখা হলো?

এখোনো তেমন ভাবে হিম পড়তে শুরু করেনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই  উত্তর চব্বিশ পরগণার আড়বেলিয়া গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। এতো রাতেই তো বসে কাঁচা গোল্লার কড়াই। সবাই গল্প করতে করতে পাক দেয় দুধে। মামার সাথে সেই ছোট্টবেলার গ্রামে ফিরে যাই। বড়ঠাকুমা  বসে আছে রোয়াকে, একটু শীত শীত, করছে না? চুসির পায়েস খাবি টুকনু? ছোটো ছোটো একদম সরু সরু আটার লেচি করছে বড় ঠাকুমা। চুসিগুলো ফুটবে দুধের সাথে, দুধ প্রায় ক্ষীর হবে, ভেসে থাকবে ওপরে চুসি গুলো। সঙ্গে ভাসবে কিসমিস, কাজু। একটু বেশি ময়ানে, হালকা আঁচে, গাওয়া ঘিয়ে ভাজা নরম তুলতুলে লুচি ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাবো, আর কনুই দিয়ে গড়িয়ে পড়বে দুধের শেষটুকু।
এবার পুজোয় আমার চুসির পায়েস চাই।
অনেক বছর বড়ঠাকুমা নেই। মামার বাড়ির দালানে এখন বাদুড়ের বাসা।


কারেন্ট অফ। হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে অসুস্থ বাবা একটা পাতলা চটি বই ওল্টাচ্ছেন। কাছে গিয়ে জানতে চাই কী পড়ছো বাবা? বাবা বলে, এটা তোর ঠাকুমার ব্যাগ থেকে পেয়েছি, দেশ থেকে আসার পর যে ব্যাগটা আমাদের কাউকে ছুঁতে দিত না। বলতো দেশের মাটি আছে! ঠাকুমা নেই, ব্যাগের মালিক বাবা। কিন্তু বইটা তো লক্ষ্মীর পাঁচালী। বাবা হাসেন। তারপর একটা অনেক পুরোনো লাল হয়ে যাওয়া কাগজ বের করে বলেন বানান করে পড় তো টুকনু। আমি পড়ি খাগের কলমে লেখা, আঁকা বাঁকা অক্ষরে রাবরি তৈরীর সহজ উপায়। আমার ঠাকুমা নবদ্বীপের মেয়ে ছিলেন। শোনা যায় খুলনার কোলাপোতার লাহিড়ী বাড়ির বড় ছেলেকে বিয়ে করে অজ পাড়া গাঁয়ে এসে নাকি টানা দুমাস কেঁদে ছিলেন। তারপর নানান ঝড় সামলে সেই মহিলা যখন সংসারের রীতিমতো কর্ত্রী হয়ে উঠলেন, তখন কোথা থেকে যেন তাঁর হেসেলে এসে লাগলো নবদ্বীপের হাওয়া।
আমাদের অসুস্থ বাবার সেই রাতে মনে হয়েছিল একটু রাবড়ি করার। সেই নিরন্ন সংসারে দুধ জোগাড় হয়েছিলো দাদার ভাঁড় ভেঙে। কয়লার আঁচে, দুধ ফুটিয়ে তালপাতার পাখার হাওয়ায় জমছিলো সর। আমি আর দাদা ঝুঁকে পড়ে দেখছিলাম সর গুলোকে। আর বাবা কোথাও খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তার হারিয়ে যাওয়া মাকে। সেটাও ছিলো কোনো এক শরতের রাত। সেই রাতেও হিমেল হাওয়া ছিলো। আর ছিলো শিউলি ফুলের গন্ধ।
এবার পুজোয় আমার রাবরি চাই।
যদিও অনেক বছর বাবা আর নেই। দাদার বিশাল বড় ফ্ল্যাটের অনেক দামি ফ্রিজে এখন অনেক মিষ্টি থাকে। একমাত্র রাবড়ি ছাড়া।

নিউ আলিপুরের জ্যোতিষ রায় রোডের বাড়িতে গেলেই আমার জন্যে ধরা বাঁধা থাকতো মুখোরচক পরোটা। আমি যে সেটা খেতে ভালোবাসতাম কাকিমা তা জানতেন।  বেশ ভালো করে ময়ান দিয়ে তার মধ্যে অল্প জোয়ান ছড়িয়ে দেওয়া একটু কড়া করে ভাজা সুস্বাদু পরোটা। সঙ্গে আলুর দম, আর ক্ষীরের চমচম। এই ক্ষীরের চমচম একটু স্পেশাল। দোকান থেকে প্যাক করার আগে খদ্দেরের পছন্দের মতো তার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হবে হাল্কা ক্ষীরের আস্তরণ আর পেস্তার গুড়ো। আমরা সবাই তৃপ্তি করে খেতাম। পূর্বাশা উত্তরপাড়া আসার সময় এক টিফিন কৌটো ভর্তি করে নিয়ে আসতো। আর খালি কৌটো ভর্তি করে নিয়ে যেত, ছানা বড়া কিম্বা ছানা পোড়া দিয়ে। এটা ওর ফেবারিট।

যে তিন মহিলা আমার জীবনে পরের পর পুজো গুলোকে মিষ্টি স্মৃতি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন তিন জনেই জন্মসূত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ছিলেন বহরমপুরের। আমার দিদার পৈতৃক বাড়ি ছিলো হাজার দুয়ারির প্রায় কাছ ঘেঁষে। সেই সূত্রে আমার মায়ের মামার বাড়ি সেখানেই। আর কি অভাবনীয় ত্রহ্য স্পর্শ, পূর্বাশার মামার বাড়ি বহরমপুর।
তিন জনেই ভাজা মিষ্টি খেতে ওস্তাদ। তিন জনেই ঠিক ছানা বড়ার মতো। ওপরের আস্তরণে শক্ত, ভেতরটা নরম তুলতুলে। তিনজনের রাগ আমাকে তাড়া করে বেড়াতো। বেড়ায় এখোনো এতো বয়েসেও।
তাই এবার পুজোয় আমার জ্যোতিষ রায় রোডের ক্ষীরের চমচম চাই।
তাইএবার পুজোয় ছানা বড়া, ছানা পোড়া চাই।
যদিও জানি এগুলো একটাও আমি পাবো না এবার।
অনেক দিন আগে দিদা তারাতলার পোর্টের কোয়াটারে অনেক অভিমান নিয়ে একা একা থাকতে থাকতে কোন এক শরতের ভোরে চলে গেছেন।
মায়ের শরীর রুগ্ন। রক্তে চিনির পরিমান বেশি। অতএব মিষ্টি বন্ধ।
আর আমি?
সে না হয় অন্যদিন....
কাঁধের ওপর হাতের স্পর্শ পেলাম মনে হলো। পেছন ফিরে দেখি নতাই। দাদা অনেক রাত হলো। বাড়ি ফিরবেন না? আমি হাসি, এবার যাবো। নতাই বলে যান। না হলে আপনাদের ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি আপনাকে আবার চিনতে পারবে না। আমি এবার বাড়ি ফেরার পথে ঘুরি। নতাই বলে দাদা। দাঁড়াই। নতাই এসে শালপাতার প্লেটে আবার একটা কি দেয়। এক গাল হেসে বলে এক্ষুনি হলো। কাল সকালে শোকেসে আসবে। আমি খুলে দেখি একটা বড় সাইজের চন্দ্রপুলি। ঠিক নতাইয়ের মতোই সমস্ত আনন্দ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।  আর বলছে পুজো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে তার মিষ্টি স্মৃতি নিয়ে।
অনেক পুরোনো লেখা। মাই আনন্দবাজার ডট কম-এ প্রকাশিত। সাল-২০১১। 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি