গাট্টু



ছোট্ট ছেলে গাট্টু ঘাড় উঁচু করে দেখে মাথার ওপর দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। আর সেই আকাশে নানা রঙের ঘুড়ির ঝাঁক। উত্তরাখন্ডের রুরকির এক ঘিঞ্জি বস্তিতে বাবা-মা হীন গাট্টু্ কাকুর কাছে থাকে। কাকুর কাছে ডাস্টবিনের জিনিস বাছাই, ওজন, বিক্রি করার কাজ শেখে অনাথ ছোট্ট গাট্টু। সকালে ঘুম থেকে উঠেই জল খাবার তৈরী করে। ঘর পরিষ্কার করে। পোষা ভেড়া টাইগারকে দুধ খাওয়ায়। তারপর নোংরা বস্তাটাকে নিয়ে কাজে বেড়িয়ে পড়ে গাট্টু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে যায় আকাশে, সেখানে ঘুড়ির ঝাঁক। নীল আকাশ গাট্টুকে ডাকে। গাট্টু ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য কাকার টাকা চুরী করে। মিথ্যে কথা বলে। যে করেই হোক আকাশে ওড়া ওই কালো রঙের বড় ঘুড়ি কালীকে কাটতেই হবে। কারণ তাদের অঞ্চলে যারা ঘুড়ি ওড়ায় কালী তাদের কাছে ত্রাস। কালী সব ঘুড়িকে কেটে দেয়। কালী আকাশের অনেক উঁচুতে ওড়ে। কালী মেঘের কাছাকাছি থাকে। গাট্টু ঠিক করে সে কালীকে কাটবে। কিন্তু তার জন্যে একটা উঁচু ছাদ চাই। এই অঞ্চলে এক মাত্র স্কুলের ছাদটাই উঁচু। গাট্টু কোনোদিন স্কুলে যায়নি। গাট্টুকে কেউ কোনোদিন স্কুলে ভর্তি করেনি। গাট্টু লেখাপড়া জানে না। কিন্তু সেই গাট্টুই একদিন শুধু মাত্র ঘুড়ি ওড়ানোর লোভে পাশের বাড়ির তারই বয়সী এক ছেলের জামা কাপড় চুরী করে স্কুলে ঢুকে পড়ে। আর এই প্রথম গাট্টু আবিষ্কার করে মাছি ঘিন ঘিন নোংরা বাছাইয়ের বাইরেও একটা অন্যরকমের জগত আছে। একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধান পায় গাট্টু। গভীর রাতে ঘুম আসে না তার। সে কাকুকে জিজ্ঞেস করে তার বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাকে কি স্কুলে ভর্তি করতো? তার জন্মদিন কবে? কাকু বিরক্ত হয়। যে নিজে কোনোদিন স্কুলে যায়নি সে কী করে গাট্টুকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে? কাকু নিজেই জানে না নিজের জন্মদিনের খবর তাহলে সে কী করে গাট্টুকে তার জন্মদিনের কথা বলবে? গাট্টুর মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা যখন আর একটা বিয়ে করে চলে যাচ্ছিলো তখন এই কাকুই তার কাছ থেকে গাট্টুকে কিনে নেয়। নিজের কাছে রাখে। কোনো এক রাতে গাট্টু যখন কাকার কাছে এই খবর জানতে পারে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়না। বরাবরের মতো এবারেও সে চোখের ওপর হাতটা দিয়ে ভাঙা সোফার ওপর কুন্ডুলী পাকিয়ে শোয়।

ছোটোদের অন্যান্য ছবির থেকে পরিচালক রাজেন খোশার গাট্টু ঠিক এখানেই তার নিজস্বতা আর স্বতন্ত্রতার দাবী করে। গাট্টু স্বপ্ন দেখে না। গাট্টুর তেমন কোনো বন্ধু নেই। গাট্টু মিথ্যে কথা বলে, গাট্টু চুরী করে, ঠিক অন্যান্য রাস্তার ছেলের মতোই বেড়ে উঠতে থাকে গাট্টু। কিন্তু তার আশে পাশের বন্ধুর থেকে তাকে আলাদা করে রাখে তার একটামাত্র ইচ্ছা। সে আকাশের ওই কালীকে কাটবেই। এটা তার ইচ্ছা…এটা তার জেদ…আর এই ইচ্ছা আর জেদের ডানায় ভর দিয়ে গাট্টু একদিন পৌঁছে যায় স্কুলের দোড়-গোড়ায়। সবার কাছে লুকিয়ে সে স্কুলের ক্লাসে বসে। সে একটু একটু করে চিনতে শুরু করে এক অন্য পৃথিবীকে। পরিচালক খুব মুন্সিয়ানার সাথে গাট্টুর দুই জগতকে আলাদা করে দেখান। ছোটো ছোটো দৃশ্যগুলো বড় সহজ সরল আর অসাধারণ হৃদয় স্পর্শী অনুভূতিতে টলমল করে। এর আগে অনেক ছবিতে ঘুড়ি ওড়ানো মুখ্য বিষয় হিসেবে এসেছে। আমরা দেখেছি ঘুড়িকে কেন্দ্র করে কিভাবে জমে উঠছে গল্পের প্লট তার দৃশ্যায়ণ। কিন্তু এই ছবিতে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্যগুলো মনে রাখার মতো, অসাধরণ তার চিত্রগ্রহণ, গ্রাফিক্সের কাজ এবং তার সঙ্গে সম্পাদনা। একছুট্টে দর্শককে নিয়ে যাবে তার ছোট্টবেলার রাস্তায়। গাট্টু শেষ পর্যন্ত কালীকে কাটতে পারে। গাট্টু শেষ পর্যন্ত স্কুলে ভর্তি হয়…কিন্তু কেমন করে? না সেটা আমি বলবো না। তার জন্যে আপনাকে বাড়ির পুঁচকেটাকে নিয়ে হলে যেতে হবে। আর বিরাশি মিনিটের এই গাট্টুকে উসাহ দিতে হবে। এরকম ছবিকে উৎসাহ না দিলে আমাদেরই বিপদ। জানবেন ভবিষ্যতে ছোটোদের কথা ভেবে…ছোটোদের জন্যে ছবি নির্মাণের আগ্রহ কমছে আমাদের ভারতে। অন্যান্য দেশের চিত্রটা অবশ্য খুব একটা আশা ব্যঞ্জক তেমনটা নয়।

এর আগে ঠিক কবে চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি অব ইন্ডিয়া তাদের নির্মিত ছবি রিলিজ করেছিলো, বা আদৌ করেছিলো কিনা সেটা আমার জানা নেই। ইন্টারনেটে সেই তথ্য জানার জন্যে তন্য তন্য করে ঘেঁটেও খুঁজে পেলাম না। কিন্তু কলকাতার যে কটা হাতে গোনা হলে ছবিটা মুক্তি পেয়েছে সব হলেরই শো টাইম সকালে। ঠিক সেই সময় যখন স্কুলগুলো খোলা থাকে। ঠিক সেই সময় যখন কোনো ছোটোরাই তাদের বড়দের সাথে সিনেমা দেখতে যায় না। আমার কাছে এই পরিস্থিতিটা খুব অপমানজনক মনে হয়েছে। আজ পর্যন্ত একটা ছবিকে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না। শোনা গেছে গাট্টুকে কর মুক্ত করা হয়েছে আরো বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছোনোর জন্যে। আরো বেশি সংখ্যক গাট্টু যাতে এই ছবিটা দেখে একদিন সত্যি তারা স্কুলে ভর্তি হতে পারে। তাদের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়। কিন্তু “সত্য মেবো জয়তের” দেশে সরকারী পলিসি গুলোই ফাইলে থাকে। কোনো কাজের কাজ হয় না। গাট্টুর স্কুলের দেওয়ালেও বড় বড় করে লেখা থাকে উক্ত বানী। গাট্টু পড়তে পারে না, কিন্তু সে হৃদয় দিয়ে একদিন সেটা উপলব্ধি করতে পারে। তাই একদিন সত্যি সত্যি স্কুলে ভর্তি হয় সে। সবার সাথে এক লাইনে দাঁড়িয়ে গাট্টুও গলা ছেড়ে গায় “সারে জাঁহাসে আচ্ছা”। 
শহরের এক বিলাসবহুল হলে মাত্র চারজন দর্শকের সঙ্গে  গাট্টু দেখতে দেখতে ভাবি...বিশ্বের তাবড় কিছু ফিল্ম ফেস্টিভালে গাট্টু, পরিচালক আর প্রযোজকের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে। অনেকে পছন্দ করেছে গাট্টুকে। কিন্তু যে দেশের রাস্তায় অসংখ্য গাট্টু বড় হচ্ছে...তাদের ইচ্ছাপূরণের গল্প বলতে বসে...তাদের কাছে না পৌঁছোনোটাও কিন্তু আর এক নতুন গল্পের ইঙ্গিতের সূচনা করে। ছবির শেষটা আমার কাছে তাই বড় দায় সারা মনে হয়। যেভাবে গাট্টুকে তার পরিচালক নির্মাণ করছিলেন, ছবির প্রেক্ষাপট তৈরী হচ্ছিলো...ছবির শেষে হঠাতই যেন তাড়া লাগে। শুধু মনে থাকে একটা ছেলের ইচ্ছাপূরণের গল্প। যা ভারতের হাজার হাজার গাট্টু রাস্তায় শুয়ে প্রতিদিন দেখে।


পরিচালক – রাজেন খোশা। প্রযোজক- চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি অব ইন্ডিয়া। চিত্রনাট্য- অঙ্কুর তিওয়ারী, কে ডি সত্যম, রাজেন খোশা, দিলীপ শুক্লা। চিত্রগ্রহণ- সত্য রাই নাগপাল। সম্পাদনা- অন্তরা লাহিড়ী। সঙ্গীত- সন্দেশ সান্ডিল্য।

অভিনয়ে-মহম্মদ সামাদ (গাট্টু), সরভেসা, নরেশ কুমার আর আরো অনেকে যারা এই প্রথম ছবিতে অভিনয় করলো। যাদের অভিনয় মনে রাখার মতো।
 

প্রকাশ-আনন্দবাজার ডট কম। ২০১২।   

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি