এখানেই শেষ নয়


মেখলা আসবে বাঁশদ্রোনী থেকে। বিক্রম আর এষা উঠবে দমদম থেকে। আদি আসবে নুঙ্গি থেকে। আর মৌন অফিস ফেরতা। আর কেউ হয়তো আসতে পারবে। আর অনেকেই আসতে পারবে না। দেবালয় মন খারাপ করে এডিট শ্যুটে। পুজোর আগে ছবির কাজ শেষ করার তাড়া। মন যদিও রবীন্দ্রসদনে। সকাল থেকে বৃষ্টি...। সকাল থেকে মিছিলের প্রস্তুতি। সকাল থেকে অনেকদিন পর আবার একসাথে হাঁটার প্রস্তুতি নেওয়া। এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা জানতে চায় “এখন মিটিং? মেগা সিরিয়ালের?” আমি একটু হেসে বলি না, মা। মিটিং নয়। মিছিল। রবীন্দ্রসদন থেকে রাজভবন। দরজার সামনে মা। চৌকাঠের বাইরে বৃষ্টি। আর জি টি রোডে পরিবহন ধর্মঘট। আজ শনিবার।

দমদম মেট্রো স্টেশনে এমন ভিড় দেখা যায় হামেসাই। যাত্রীর ভিড়। উতসবের ভিড়। জোর করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে ব্রিগেডে সামিল করার ভিড়। সেই ভিড় গুলো চেনা আমার। মুখ গুলো...হাঁটা গুলো...চলার রকমফের গুলো। দেখার যত উপায় আছে তা নিয়ে এদের চিনতে আর নতুন করে চিহ্ন মাধ্যম লাগে না। পড়তে সময় লাগে না। বিরক্ত হতেও দেরী লাগে না একটুও। কিন্তু শনিবারের দমদম মেট্রো অন্যরকমের। দুপুর একটা নাগাদ যে ভিড়টা দেখলাম, তাদের বয়স সবার আঠারো থেকে বাইশের মধ্যে। তাদের সবার হাতে ছাতা। কেউ বা বর্শাতির আড়ালে। কেউ বা ভিজে কাক-চান। এরা কি সবাই রবীন্দ্র সদনে নামবে? কাকু...আসুন আপনার হাতে লিখে দিই বহিরাগত? একটা ছেলের ডাকে ফিরে তাকাতেই দেখলাম বছর একুশের একজন যুবক। তার হাতে একটা স্কেচ পেন। আমি একটু কিন্তু কিন্তু করতেই ছেলেটি বললো বেশ...। আপনি বরং মাথায় এইটা দিতে পারেন। এগিয়ে দেয় ফেট্টিটা আমার দিকে ছেলেটি। আমি হাতে নিই। লেখা আছে “হোক কলরব”। এই শব্দবন্ধটি আমার বেশ কয়েকদিনের চেনা। ফেসবুকের দৌলতে। অনেক অনেক পোস্টের আপডেটে। অনেক জমা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে। কিন্তু এটা তো আর্টপেপারে। এক্ষুনি মেট্রো থেকে নামলে ভিজে যাবে। ছেলেটি একটু মিইয়ে যায়। বলে ঠিকই তো...দেখুন না...ওদের গুলো এখনি কেমন হয়ে গেছে। একটু দূরে কয়েকজন তরুনের মাথায় সেগুলো রঙে...নক্সায়...জলে একাকার। ঠিক রঙীন প্রজাপতি। বিপ্লবের নতুন সংজ্ঞা। জানেন..., ফিরে তাকাই আবার ছেলেটির দিকে।  কয়েকজন বন্ধু মিলে কাল অনেক রাত জেগে তৈরী করেছি সব। আমি বললাম দাও। হাতে নিলাম। মেট্রোর ভিড়ে...সেই প্রচন্ড ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল ছেলেটা আর খুঁজে পেলাম না। কিন্তু প্রবীন বয়স্কদের সিটের সামনে পেলাম এক পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিকে যিনি যাচ্ছেন রবীন্দ্রসদন। যিনি ঠিক করেছেন হাঁটবেন। আমরা আস্তে আস্তে জড়ো হচ্ছিলাম। গাছের তলায়। আমরা আস্তে আস্তে জড়ো হচ্ছিলাম চায়ের দোকানে। ছোটো জটলা যখন গগন ভেদ করে স্লোগান দিলো...হোককলরব...। তখন কেঁপে উঠলো নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্ত্বর। অসুস্থ শরীরে একটা ছাতা নিয়ে পার্থদা এসে সামনে দাঁড়ালো। আর অমায়িক হেসে বললো...কল্লোল...কি যে ভালো লাগছে বলতে পারবো না। আমার হাতটা তখন পার্থদা শক্ত করে ধরে আছে। 

কোনো কোনো বন্ধু ফোন করছে। কোনো কোনো বন্ধু জানতে চাইছে আসলেই এটা হুজুক? তার আগে আমার অনেক ‘সেলিব্রিটি’ বন্ধু নানান কথার চমকে। নানান কথার মারপ্যাঁচে...নানান লোকের ব্লগের লেখার দৃষ্টান্ত তুলে দিয়ে প্রমান করতে চাইছেন এই মিছিল অসাড়। এই মিছিল আসলেই কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। অথচ তাঁরাই সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় পরিবর্তন এনে এখন পরিবর্তনের সুবিধা ভোগ করছেন। ছাতা মাথায় দূরে কে হেঁটে যায়। স্যার দেখুন অঞ্জন দত্ত। এদের কি আসার কোনো দরকার ছিল? অনেকের কাছেই কথাটা ঘুরপাক খায়। আবার কোথায় যেন থিমিয়ে যায়। প্রবল জোরে বৃষ্টি আর স্লোগানে ঢাকা রাজপথে। অসংখ্য তরুণের স্বতস্ফূর্ত কলরবে। জেহাদে।

মিছিলের মধ্যে...অনেকের সাথে পায়ে পায়ে চলার সময়, জোরে স্লোগান দেওয়ার সময় কিম্বা বন্ধুদের ক্যামেরায় ‘বিপ্লবী ফটো সেশনে’র সময় আমার মনে হয়েছে এটা কী জীবনের আর এক উতসব...? হ্যাঁ উতসব। এও এক নিদারুণ আনন্দের উতসব। ওই তো ওই ছেলেটা...ওই মেয়েটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সেদিন রাতে পুলিশের লাঠিতে ওদের লেগেছে কারো পায়ে। কারো শিড়দাঁড়াতে। ওরা হাঁটছে। হ্যাঁ...এই বর্ষণস্নাত বৃষ্টির মিছিলের উতসবে। পা টেনে টেনে...। যন্ত্রণায় কুঁচকে যাওয়া মুখ নিয়ে অথচ অসীম সাহসে। দৃপ্ত ভঙ্গিতে। আমার মনে হয়েছে এটা প্রতিরোধের উতসব...। আমার মনে হয়েছে এটা প্রতিবাদের উতসব। কেন এই মিছিল। কিসের জন্য এই মিছিল। সেই সব বৃত্তান্ত জানা। নতুন কিছু জানানোর নেই। দিল্লীতে...অন্ধ্রতে...সব জায়গায় আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিরোধ...প্রতিবাদ। এখন গিটার দেখেও ভয় পাচ্ছে ওরা। বেহালাতে মনে করছে আছে বোম। বাঁশির সুরকে মনে করছে তীক্ষ্ণ ছুড়ির ফলা। যদিও ওদের হাতে আছে মাইনে করা শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, ডাক্তার, খেলোয়াড় প্রায় সবাই। আর আমাদের কাছে আঠারোর স্পর্ধা...। আমাদের কাছে রাজপথ। আমাদের কাছে আছে সেই সেইসব তরুণের স্বপ্ন যারা নিজেদের পিঠ পেতে দেয় পুলিশের লাঠির কাছে। যাদের শায়েস্তা করতে পাঠাতে হয় পুলিশ মধ্যরাতে। যাদের শায়েস্তা করতে নিভিয়ে দিতে হয় আলো...মধ্যরাতে। যাদের শায়েস্তা করতে প্রশাসনের ওপর মহলকে কদর্য মিথ্যে বুলি আওড়াতে হয়। বার বার। অসংখ্যবার। আমরা দেখি। আমরা পড়ি। আমরা কাগজ মুড়ে রাখি। কিম্বা এই এখনকার মতো একটা ছোটো নিবন্ধ লিখে ‘লাইকের’ সংখ্যা গুনি।

একটা হাত এগিয়ে আসে খুব কাছে। আপনি কাঁপছেন। ঠান্ডা লাগছে আপনার? ছেলেটি আমার দিকেই তাকিয়ে। ওই গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। কিম্বা হাতে হাত রেখে ব্যারিকেডে। ওখানে বৃষ্টির ছাঁট কম। জীবনে একবার প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা ভিজেছিলাম নিজের একটা কাজের জন্য বক্সার গভীর গহন অরণ্যে নিজের শ্যুটিং টিমের সাথে। আর শনিবারের ভেজা? আমার ভিজে যাওয়া প্রায় অকেজো মোবাইল বলছে ঘড়ির কাঁটা ছটার ঘরে। আমি ভিজছি...আমরা ভিজছি দুপুর দেড়টা থেকে কেউ আবার তারও অনেক অনেক আগে থেকে। হ্যাঁ আমি শীতে কাঁপছি। আমরা কাঁপছি। কিন্তু কোথাও আর নড়তে পারছি না। আটকে গেছে পা। আমি তো ওই স্লোগানের মধ্যমণি হয়ে বসে আছি। তারুণ্যের যে হল্কা আমার গায়ে এসে আছড়ে পড়ছে...আমি তা যত্নে কুড়িয়ে নিচ্ছি। আমার চালশের শরীর বলছে আরো অনেকবার...অসংখ্যবার হাঁটার প্রস্তুতি নাও। সন্ধ্যের রাজপথ বলছে এখানেই শেষ নয়...এবার শুরু।

ভাবছ যারা ভিজছি মোরা বোকার মতন
তাদের চিবুক একটু ধরে নাড়িয়ে বলি
আজকে সবাই ভিজেই গেছে রাজার কাছে
কালকে বারুদ শুকিয়ে নেওয়ার মুরদ আছে
হোক কলরব
...” (বিক্রমজিত গুপ্ত)

ফিরছি বাড়ির পথে...। বাংলাদেশ থেকে ছাত্র...বন্ধু প্রতীম হীরক বলছে দাদা একটা লিখেছি...আপনাকে পাঠাই? সারাদিন ঢাকাতেও তো বৃষ্টি। কিন্তু কলকাতার উত্তাপ লেগেছে ঢাকার বৃষ্টিভেজা রাস্তাতেও...। আমি বলি ঠিক...শহাবাগের উত্তাপ যেমন ছিল কলকাতাতে...। ফিরে এসে হীরকের বৃষ্টিভেজা চিঠি পেলাম।
আগুন ওখানে জ্বললে এখানেও লাগে তার আঁচ
এক মু
ঠো এক ছায়া ছুঁয়ে একবার একাকার হয়ে বাঁচ
দু'চোখে স্বপ্ন সুরমা পলকেই হয়ে যায় লাখ লাখ
এইবার হাত ধরে মাথা তুলে ঠিকঠাক বাঁচা যাক
ওপাড়ের দ্রোহে এপাড়ের দ্রোহে জেগে থাক অনুভব
হৃদয়ে হৃদয়ে ছায়ায় কায়ায় হোক শুধু কলরব ।
(আহমেদ খান হীরক)

অনেক রাতে বেশ গায়ে যখন জ্বর একটা এস এম এস মনটা ভালো করিয়ে দিল। দেবর্ষি বললো গানটা রেডি স্যার। সোমবার আপলোড করবো। সবাই শুনবে। এটাই আমার প্রতিবাদ। আমার চালশের জরো শরীর বললো একটা ক্যালপল খেয়ে নাও কল্লোল। এখানেই তো শেষ নয়...এবার অনেকবার এমনি বৃষ্টিভেজার শুরু...।

মনে মনে...ভাঙা গলার স্বর তুলে বললাম হোককলরব।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি