ঈদের চিঠি
সিরাজুল,
অনেক দিন পর একটা বড় লম্বা চিঠি পেয়ে ঘুম থেকে উঠছি। আর আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি তুমি নামাজ পড়তে চলেছো নতুন জামা আর প্যান্ট পড়ে। আনন্দী চুল বেঁধেছে লাল ফিতে দিয়ে। বড় বড় দুটো লাল ফুলের বিনুনী তার যে খুব প্রিয়। তার নতুন ফ্রকের গোলাপী প্রজাপতি গুলো যেন তোমাদের বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি রাগ করেছো সেটা বুঝতে পারছি। আর টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে আমার ওপর একটু একটু রাগ করে রাখা তোমার হাসি মুখটা জবা গাছের পাশ দিয়ে, বড় মাঠের দিকে সবুজ হয়ে আসা ধান ক্ষেতটার পাশ দিয়ে, মনা দের বড় কল তলার পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে মসজিদের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে রফিকুল, সাদেক মিঞা, ফজরুলের সাথে গল্প করতে করতে... আরো অনেকের ভিড়ের মাঝে।
তোমাকে বেশ চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছি সিরাজুল। তোমার মাথায় নক্স করা টুপিটা বেশ মানিয়েছে তোমাকে। আর চোখে সুরমা দিতে যে লজ্জা পাচ্ছিলে সেটা আমি আগেই জেনেছি আনন্দীর কাছ থেকে। না তাই বলে ভেবো না...সূদূর সুন্দরবনের একটা ছোট্ট গ্রামের একটা সুন্দর বাড়ির চারপাশে আমি ফেলুদার মতো ঘুরে ঘুরে গোয়েন্দাগিরি করছি। আমি শুধু মন কেমনের চাদরটা গায়ে দিয়ে ভাবছি এই যে আমার সিরাজুল একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছে...। নাকের নীচে ঠোঁটের ওপরে তার গোঁফের রেখা লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ আয়নায় দেখছে। সে কেন আমাকে আর নীল খামে ভরে চিঠি দেয় না? কেন আমি আজ অনেকের সাথে নামাজ পড়ে সুন্দরবনের ছোট্ট খাড়িতে সেই আগের মতো নৌকা বাইবো না? কেন আমাকে আজ করিম চাচা সেই দুষ্টু কুমীর আর বাঘের গল্পটা বলবে না? কেন আমাকে তোমার আম্মা এসে বার বার বলবে না...কল্লোল এই ভাপা পিঠেটা খাও...কাল অনেক রাতে মাটির সরায়...ঢিমে আঁচে বানিয়েছি। কিম্বা আনন্দী এসে বলবে না...চলো সবাই মিলে ঈদের মেলায় পুতুল নাচ দেখি।
এইসব রঙীন চুড়ি...ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি...তোমার দাদীর তেঁতুলের আচারের বয়াম যখন খুঁজতে গেলাম মনে মনে, তখন দেখলাম তাই তো...আমি কী করে যাবো তোমার বাড়িতে? তোমার গ্রামে? তোমার কাছে যাওয়ার আমার সেই ম্যাজিক নৌকা তো চাঁদের বুড়ির কাছে জমা রাখা। তার সাথেও তো আমার অনেক দিন কথা নেই, চিঠি নেই। এবার কী হবে? শুধু তোমার কাছে মনে মনে উড়ে যাবো বলে সিরাজুল এই সক্কালে দু-দুটো চিঠি লিখছি। একটা চাঁদের বুড়িকে। আমার হারানো নৌকার তল্লাশিতে। আর একটা তোমাকে, শিমাইয়ের পায়েসে লোভ দেওয়ার জন্য। রাগ করেছো বুঝতে পারছি। নতুন কম্পিউটারে তুমি কেমন বাঘের ছবি এঁকেছো সেটাও তো দেখা হয়নি সিরাজুল। তোমার হাতের বাংলা টাইপ খুব ভালো হয়েছে। আর তুমি যে চাঁদের বুড়ির জন্য একটা ছড়া দেবে বলেছো তাতেও মনটা ঘুড়ির মতো আকাশে উড়ছে। আর হাসনাহানা ফুল গাছটার মতো চারিদিকে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে বলছে আজ সিরাজুল আমাকে অনেক অনেক রাতে একটা বড় চিঠি লিখবে।
ইতিহাস স্যার প্রবীর বাবু তোমাদের ক্লাসে যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে বলতে গিয়ে গাজার কথা বলেছেন শুনে ভালো লাগলো। আরো ভালো লাগলো এটা ভাবতে, আমার সিরাজুল স্কুলের ছুটির পরও গাজা্র সম্বন্ধে জানতে কম্পিউটার লাইব্রেরীতে চলে গেছে পড়া শুনো করতে। আমি জানি সিরাজুল তুমি কষ্ট পেয়েছো। আমি জানি অনেক অনেক রক্তাক্ত ছবি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। গোটা পৃথিবীতে জমি দখলের জন্য মানুষ মানুষকে মারছে। তুমি বলেছো তোমার জমি দখল করে বাঁধ ছাপিয়ে উঠে আসা নোনা জল। নষ্ট করে দেয় ফসল, জমি। আর ওখানে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে জমি দখল করছে মানুষ। মানুষের জীবন দিয়ে মানুষই আর একটা জমি দখল করছে। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই বলে তোমারা যে পোস্টার বানিয়েছো সেটা শুনে ভালো লাগছে। জানো তো...আমার মনে হয়...কলকাতার কোনো স্কুলে এখনো তোমার মতো এমন পোস্টার করার কথা কেউ ভেবে উঠতে পারেনি। সেদিক থেকে তুমি প্রথম সিরাজুল। বরাবরের মতো। এই যে আজকের মতো এমন পবিত্র দিনে তুমি বলতে পারছো আমরা যুদ্ধ চাইনা, শান্তি চাই। এই যে তুমি নিজেকে সেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অনেক স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের সাথে মিশিয়ে দিতে পেরেছো সেটাই আমার কাছে তোমার কাছ থেকে পাওয়া ঈদের অনেক বড় উপহার। তবে তাই বলে ভেবো না, এরপরে যখন তোমার বাড়ি যাবো তখন তুমি আমাকে চাল ভাজা খাইয়ে নৌকায় তুলে দেবে। আজ তোমরা যা যা খাবে সব কিন্তু আমার চাই। আমি সব কড়ায় গন্ডায় হিসেব করতে করতে উসুল করে নেবো। আর আম্মার উঠোনে, উনুনের পাশে বসে ডালের বড়া খেতে খেতে সজনে গাছের ভূতের গল্পটা শুনবো। ইশ ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে সিরাজুল। কিন্তু কি আর করা যাবে?
তবে আজকের জন্য তুমি আর আনন্দী আমার হয়ে এক বাটি শিমাই একটু বেশি খেয়ো। আমি আমার উত্তর পাড়ার খেয়া ঘাটের চিলেকোঠার জানলা দিয়ে বেশ দেখতে পাবো তোমাদের দুজনকে। ছোট্ট নদী দিয়ে ঘেরা গ্রামটাকে। বিকেলের মেলাকে। আর অনেক অনেক স্বপ্নকে, যাদের আমি অনেক দিন আগেই ইচ্ছামতীর পাল তোলা নৌকায় বসিয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করেছি। ভালো থেকো সিরাজুল...।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
কল্লোল।
***ঈদের দিনে ইচ্ছামতীর বিশেষ রচনায় প্রকাশিত।***
অনেক দিন পর একটা বড় লম্বা চিঠি পেয়ে ঘুম থেকে উঠছি। আর আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি তুমি নামাজ পড়তে চলেছো নতুন জামা আর প্যান্ট পড়ে। আনন্দী চুল বেঁধেছে লাল ফিতে দিয়ে। বড় বড় দুটো লাল ফুলের বিনুনী তার যে খুব প্রিয়। তার নতুন ফ্রকের গোলাপী প্রজাপতি গুলো যেন তোমাদের বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি রাগ করেছো সেটা বুঝতে পারছি। আর টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে আমার ওপর একটু একটু রাগ করে রাখা তোমার হাসি মুখটা জবা গাছের পাশ দিয়ে, বড় মাঠের দিকে সবুজ হয়ে আসা ধান ক্ষেতটার পাশ দিয়ে, মনা দের বড় কল তলার পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে মসজিদের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে রফিকুল, সাদেক মিঞা, ফজরুলের সাথে গল্প করতে করতে... আরো অনেকের ভিড়ের মাঝে।
তোমাকে বেশ চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছি সিরাজুল। তোমার মাথায় নক্স করা টুপিটা বেশ মানিয়েছে তোমাকে। আর চোখে সুরমা দিতে যে লজ্জা পাচ্ছিলে সেটা আমি আগেই জেনেছি আনন্দীর কাছ থেকে। না তাই বলে ভেবো না...সূদূর সুন্দরবনের একটা ছোট্ট গ্রামের একটা সুন্দর বাড়ির চারপাশে আমি ফেলুদার মতো ঘুরে ঘুরে গোয়েন্দাগিরি করছি। আমি শুধু মন কেমনের চাদরটা গায়ে দিয়ে ভাবছি এই যে আমার সিরাজুল একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছে...। নাকের নীচে ঠোঁটের ওপরে তার গোঁফের রেখা লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ আয়নায় দেখছে। সে কেন আমাকে আর নীল খামে ভরে চিঠি দেয় না? কেন আমি আজ অনেকের সাথে নামাজ পড়ে সুন্দরবনের ছোট্ট খাড়িতে সেই আগের মতো নৌকা বাইবো না? কেন আমাকে আজ করিম চাচা সেই দুষ্টু কুমীর আর বাঘের গল্পটা বলবে না? কেন আমাকে তোমার আম্মা এসে বার বার বলবে না...কল্লোল এই ভাপা পিঠেটা খাও...কাল অনেক রাতে মাটির সরায়...ঢিমে আঁচে বানিয়েছি। কিম্বা আনন্দী এসে বলবে না...চলো সবাই মিলে ঈদের মেলায় পুতুল নাচ দেখি।
এইসব রঙীন চুড়ি...ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি...তোমার দাদীর তেঁতুলের আচারের বয়াম যখন খুঁজতে গেলাম মনে মনে, তখন দেখলাম তাই তো...আমি কী করে যাবো তোমার বাড়িতে? তোমার গ্রামে? তোমার কাছে যাওয়ার আমার সেই ম্যাজিক নৌকা তো চাঁদের বুড়ির কাছে জমা রাখা। তার সাথেও তো আমার অনেক দিন কথা নেই, চিঠি নেই। এবার কী হবে? শুধু তোমার কাছে মনে মনে উড়ে যাবো বলে সিরাজুল এই সক্কালে দু-দুটো চিঠি লিখছি। একটা চাঁদের বুড়িকে। আমার হারানো নৌকার তল্লাশিতে। আর একটা তোমাকে, শিমাইয়ের পায়েসে লোভ দেওয়ার জন্য। রাগ করেছো বুঝতে পারছি। নতুন কম্পিউটারে তুমি কেমন বাঘের ছবি এঁকেছো সেটাও তো দেখা হয়নি সিরাজুল। তোমার হাতের বাংলা টাইপ খুব ভালো হয়েছে। আর তুমি যে চাঁদের বুড়ির জন্য একটা ছড়া দেবে বলেছো তাতেও মনটা ঘুড়ির মতো আকাশে উড়ছে। আর হাসনাহানা ফুল গাছটার মতো চারিদিকে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে বলছে আজ সিরাজুল আমাকে অনেক অনেক রাতে একটা বড় চিঠি লিখবে।
ইতিহাস স্যার প্রবীর বাবু তোমাদের ক্লাসে যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে বলতে গিয়ে গাজার কথা বলেছেন শুনে ভালো লাগলো। আরো ভালো লাগলো এটা ভাবতে, আমার সিরাজুল স্কুলের ছুটির পরও গাজা্র সম্বন্ধে জানতে কম্পিউটার লাইব্রেরীতে চলে গেছে পড়া শুনো করতে। আমি জানি সিরাজুল তুমি কষ্ট পেয়েছো। আমি জানি অনেক অনেক রক্তাক্ত ছবি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। গোটা পৃথিবীতে জমি দখলের জন্য মানুষ মানুষকে মারছে। তুমি বলেছো তোমার জমি দখল করে বাঁধ ছাপিয়ে উঠে আসা নোনা জল। নষ্ট করে দেয় ফসল, জমি। আর ওখানে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে জমি দখল করছে মানুষ। মানুষের জীবন দিয়ে মানুষই আর একটা জমি দখল করছে। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই বলে তোমারা যে পোস্টার বানিয়েছো সেটা শুনে ভালো লাগছে। জানো তো...আমার মনে হয়...কলকাতার কোনো স্কুলে এখনো তোমার মতো এমন পোস্টার করার কথা কেউ ভেবে উঠতে পারেনি। সেদিক থেকে তুমি প্রথম সিরাজুল। বরাবরের মতো। এই যে আজকের মতো এমন পবিত্র দিনে তুমি বলতে পারছো আমরা যুদ্ধ চাইনা, শান্তি চাই। এই যে তুমি নিজেকে সেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অনেক স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের সাথে মিশিয়ে দিতে পেরেছো সেটাই আমার কাছে তোমার কাছ থেকে পাওয়া ঈদের অনেক বড় উপহার। তবে তাই বলে ভেবো না, এরপরে যখন তোমার বাড়ি যাবো তখন তুমি আমাকে চাল ভাজা খাইয়ে নৌকায় তুলে দেবে। আজ তোমরা যা যা খাবে সব কিন্তু আমার চাই। আমি সব কড়ায় গন্ডায় হিসেব করতে করতে উসুল করে নেবো। আর আম্মার উঠোনে, উনুনের পাশে বসে ডালের বড়া খেতে খেতে সজনে গাছের ভূতের গল্পটা শুনবো। ইশ ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে সিরাজুল। কিন্তু কি আর করা যাবে?
তবে আজকের জন্য তুমি আর আনন্দী আমার হয়ে এক বাটি শিমাই একটু বেশি খেয়ো। আমি আমার উত্তর পাড়ার খেয়া ঘাটের চিলেকোঠার জানলা দিয়ে বেশ দেখতে পাবো তোমাদের দুজনকে। ছোট্ট নদী দিয়ে ঘেরা গ্রামটাকে। বিকেলের মেলাকে। আর অনেক অনেক স্বপ্নকে, যাদের আমি অনেক দিন আগেই ইচ্ছামতীর পাল তোলা নৌকায় বসিয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করেছি। ভালো থেকো সিরাজুল...।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
কল্লোল।
***ঈদের দিনে ইচ্ছামতীর বিশেষ রচনায় প্রকাশিত।***
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন