ফিল্মিস্তান
পরিচয়ের
প্রশ্নচিহ্ন
১৯৪৭ সালের
১৫ অগাষ্ট আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তিনশো বছরের ইংরেজের গোলামীর পুরষ্কার স্বরূপ
আমাদের উপমহাদেশটি দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। যে ভারতীয়রা স্বাধীনতার যুদ্ধে লুকিয়ে,
অন্যপথে, মারাত্মক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াইয়ের পন্থায় স্বাধীনতা নিয়ে আসার চেষ্টা
করেছিলেন তাঁদের আমরা “আতঙ্কবাদী”, “টেররিস্ট”, “ডাকাত”, “সহিংসবাদী” নানা
ব্যাখ্যায় ভূষিত করেছিলাম। অপর একজনকে বলেছিলাম “তোজোর কুকুর”। তাকে এমন একটা
প্লেনে তুলে দিয়েছিলাম যাতে সে কোনো দিন আর দেশে ফিরে আসতে না পারে। তবুও
স্বাধীনতা এলো। মধ্য রাতের ভাষণে নেমে এলো স্বাধীনতা আমাদের দেশে। আর ঠিক তার
সাথেই দেশ হলো রক্তাক্ত। দ্বিখন্ডিত। ভাই ভাইকে মারলো। ধর্ষিত হলো ঘরের
মেয়ে...ঘরের মধ্যেই। নিজের দেশের মা সেই সব কিছু লক্ষ্য করেছিলেন নিভৃতে। রাতারাতি
অসংখ্য মানুষের কাছে যে দেশে তাঁরা থাকতেন, যে মাটিতে তাঁদের বাড়ি ছিলো সেটাই
বিদেশ হয়ে গেলো। আমরা মেনে নিলাম এই দিখন্ডতা। আমরা মেনে নিলাম এই স্বাধীনতা।
জাতির নামে, ধর্মের নামে ভাগ হয়ে গেল দুটো দেশ। আমরা কী সত্যিই মেনে নিয়ে ছিলাম?
নাকি আমাদের মাথার ওপর যাঁরা ছিলেন তাঁরা আমাদের মানতে বাধ্য করেছিলেন? আমরা অনেক
কিছুই না জেনে কিম্বা জেনে মেনে নিয়ে ছিলাম। আমাদের পরিচয় হীনতা কিম্বা এতোদিন
যাকে স্বদেশ বলে মনে করতাম তাকে রাতারাতি বিদেশে পরিণত করার আকূতি আর ভয় কোথাও যেন
মজ্জায় অন্তর্গত রক্তের স্রোতে খেলা করে বেড়ালো। এখোনো কি বেড়ায় না? প্রশ্নটা আমরা
নিজেরাই নিজেদের করতে পারি। এই প্রশ্ন খুব একটা ওঠে এমন নয়। উঠলেও তার ঘোরালো
মারপ্যাঁচ পূর্ণ অন্ধ জাতীয়তা আমাদের নিমেষে নিয়ে ঠেলে অন্ধকার কালো ঘরের মধ্যে।
যেখানে হাতড়ে বেড়ালেও আলোর কোনো সূচনার হদিশ পাওয়া যায় না। অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য
সেন তাঁর বই ‘পরিচিতি ও হিংসায়’ বললেন “দুঃখের বিষয় হল যে, আমাদের পরিচয় নির্বাচন
করার স্বাধীনতা নেই- এমন ধারনার ফলে হিংসা বন্ধ করার বহু সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত
প্রয়াস ব্যাহত হয় এবং হিংসাকে পরাজিত করার ক্ষমতার তীব্র ক্ষতি করে।” কিন্তু এই
পরিচয় কিসের পরিচয়? আমার জাতীয়তার পরিচয়? আমার ধর্মের পরিচয়? আমার রাষ্টের পরিচয়?
আমার নাগরিকত্ত্বের পরিচয়? নাকি বহু ভাষা ভাষির দেশে নিজের স্বাতন্ত্রের পরিচয়? বস্তুত,
“আমাদের পরিচিতির যে বহু পৃথক অনুষঙ্গ আছে, এবং আমরা পরস্পরের সঙ্গে নানা ভিত্তিতে
সংযোগ স্থাপন করি” সেটা অনেক সময় আমাদের বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা
হয়। ভুলিয়ে দেওয়া হয় প্রশ্ন করার, প্রশ্ন তোলার নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাকে...কিম্বা
ধ্বংস করে দেওয়া হয়। যে পরিচিতির আড়ালে বহু পৃথক অনুষঙ্গের কথা আমরা আলোচনা করছি
সেই একক পরিচিতি মানুষকে যখন তার রাষ্ট্রের সামনে দাঁড় করায়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
কথা বলায় কিম্বা আনুগত্য স্বীকার করায়, অথবা প্রশ্ন তোলার সাহস যোগায় সেই পরিচিতি
অনেক পরিচিতির মুখোশের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েও সজাগ থাকে। কাজেই স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশ
মাতৃকার শৃঙ্খলা মোচনে যে পরিমান রক্ত ঝরেছিল, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হবার জন্য যে
পরিচয়ের আকাঙ্খা মনের মাঝে সুপ্ত ছিল, তার থেকেও বেশি পরিমান রক্তের দাম দিতে হল
স্বাধীনতার মুহূর্তে। আমাদেরই আর এক পরিচয়ের উৎস সন্ধানে। একে অপরের পরিচয়ে ছুরি
বসালাম। একে অপরের হাতে মাখলাম রক্ত। পরিচয় এল ঘুর পথে অনেক প্রশ্ন নিয়ে। মূল
ভখন্ডের এই দ্বিখন্ডতা যে পরিচয়ের সামনে দাঁড় করালো আমাদের সেই পরিচয় আর পরিচয়
হীনতা নিয়ে বয়ে চলতে হলো আজীবন...স্বাধীনতার এতোদিন পরেও...। জানি এর শেষ নেই এর
শেষ কেউ দেখেনি। এই ঘা সারবার নয়।
ঠিক যতটা
দুরূহ মনে হল এই পেছন ফিরে তাকানোটা। সিনেমাটা ঠিক তেমন জটিল নয়। হাসির আবরণের
পরতে পরিচালক তাঁর প্রথম ছবিতে সাজিয়ে রেখেছেন মারাত্মক সব যুক্তি, প্রশ্ন এবং
প্রতি উত্তর। হ্যাঁ অনেক দিন পরে অন্যভাবে আমাদের দেশভাগ, আমাদের হিন্দি ছবিতে।
অন্য প্রাসঙ্গিকতায়। মজার ছলে। ঠান্ডা মাথায় চোখে আঙুল তুলে দেখানোর এক নির্ভিক
প্রতিবেদন। সাহসটা আছে। আর মজাটা আছে কারণ দুই দেশের এই রক্তাক্ত পথে একমাত্র যোগ
সূত্র হল সিনেমা। তাই যে পরিসর পরিচালক নির্মাণ করেন। স্থপতির মতো সময়, স্থান প্রতিরূপায়ণ
করেন তা এক স্বপ্নের পরিসরের জন্ম দেয়। ভালোলাগা, ভালোবাসা উজাড় করে থাকে সিনেমার
পটভূমিকায়। সিনেমা তাই এখানে বর্ডার মানে না। সিনেমার এখানে সীমান্ত নেই। সিনেমা
তাই কোথাও চোরাগোপ্তা পথে দুই দেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। সেই নেই দেখা, না
ছোঁওয়া স্পেসটার নাম ফিল্মিস্থান। ছবিটা মাত্র কয়েকদিন হলো আপনার কাছের সিনেমা হল
গুলোতে এসেছে। আরো বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশের আগে তারই এক ঝলক।
কী মনে হল?
সেটা আমাকে না বললেও চলবে। শুধু বলে রাখি এই ট্রেলার দেখে একটা জিনিস নিশ্চই
স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এই ছবি আমাদের জনপ্রিয়
দুনিয়ার ছবি থেকে একটুও আলাদা নয়। সেই পৃথকীকরণের রাস্তায় হাঁটেননি পরিচালক নিতীন
কক্কর। তবুও একটা পৃথকীকরণ থেকে যায় ছবির বিষয় বস্তুতে। ছবির প্লট ভাবনায়। ছবির
চরিত্র নির্বাচনে। আর ওই যে শুরুতে আলাপ করছিলাম আপনাদের সাথে “পরিচয়ের”
প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। সেই পরিচয় বারবার ঘুরে ফিরে, আড়ালে আবডালে এই ছবির রাস্তা তৈরী
করে। এই ছবি নারীচরিত্র হীন। কোনো মহিলাকে এই ছবিতে প্রধান, উপ প্রধান কোনো অংশে
পাওয়া যায় না। পরিচয় তাহলে কী এখানে পুরুষের অঙ্গ? নাকি যে এই ছবির
হিরো...নায়ক...সে একই অঙ্গে বহন করে চলেছে গুরুদত্ত থেকে অমিতাভ...রাজেশ থেকে আমির
সলমান হয়ে হেমা মালিনী...মাধুরী দিক্ষীত সবাইকে। কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়লেন তো? আসলে
এই ছবির হিরো সে একজন কৌতুক শিল্পী। যার কাজ হল সবাইকে নকল করা। আসলে এটা সে
কোনোদিন হতে চায়নি। তার ইচ্ছে ছিল সে একদিন একজন বড় স্টার হবে। শহরের রাস্তায়,
মহল্লায়, পাড়ার অলিতে গলিতে তার অভিনয়ের জয় জয়কার হবে। কিন্তু মানুষ যেটা চায় সেটা
আর কি কখোনো হয়? নায়ক সানির ভাগ্যেও সেটা হয়নি। কাজেই প্রথমে হতাশ, তারপর মেগা
সিরিয়ালের সহকারী পরিচালক আর ঠিক তারপরেই তার হাতে মোক্ষম সুযোগ আসে এক আমেরিকান
তথ্যচিত্র পরিচালকের জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠের কাজের ডাক। সানি ডলারে পেমেন্ট
পাওয়ার আশায় আর নিজের স্বপ্নের বুননে রাজী হয়ে যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না।
রাজস্থানের ধূসর ঊষর কাউ বয়ের পট ভূমিতে অমিতাভের ডায়লগ বলা সানিকে ভুল করে অপহরণ
করে কিছু দুষ্কৃতি। আর সানি বুঝতে পারে যে জায়গাটায় সে প্রবেশ করেছে সেটা ভারত নয় সেটা পাকিস্তান। তার আর নিজের দেশের
ফেরাটা ঠিক এখন সিনামার স্বপ্নের মতোই ঘোর বাস্তব। ছবির শুরুর দশ মিনিটের মধ্যে
পাকিস্তানের যে পটভূমি রচনা করেন পরিচালক মাত্র কয়েকটা ঘর, একটা ঊষর ভূমি, মাত্র
চার-পাঁচটি চরিত্রকে সম্বল করে। আর এদের সবাইকে দিয়ে ফিল্মের সংলাপের সাথে গল্পের রুদ্ধশ্বাস
এগিয়ে যাওয়া। মুন্সিয়ানা রাখে। আমরা যারা ছবির জগতে নানা রকম করে খাই ...তাদের হিংসার জায়গা হতে পারে
নীতিন কক্করের প্রথম ছবি ফিল্মিস্তান।
সানি তার বন্দি দশায় নিছকই পরিচয়ের অস্তিত্ত্বহীনতা টের
পায়। যে সানি নিজের একই অঙ্গে এতো রূপের মতো গোটা বলিউডের সমস্ত স্টারকে বয়ে নিয়ে
বেড়াতো সেই একদিন কোনো এক সকালে বিস্ময়ে জানতে চায় এটা কী করে সম্ভব? তোমরা দেখতে
এক...ভাষা এক...নাক চোখ কান মুখ সব এক...তোমরা পাকিস্তান...আর আমরা হিন্দুস্তান? যে
দুটো দেশ আগে একটা দেশ ছিল...যে দুটো দেশ আগে এক সাথে খেত উঠতো বসতো সেই দুটো দেশ
এখন আলাদা। সেই দুটো দেশের আগে এখন সীমান্ত। সেই সীমান্ত পার করতে লাগে পাসপোর্ট।
কিন্তু সেই সীমান্তর চোখে মরুভূমির বালি দিয়ে ঢুকে পড়ে ম্যায়নে পেয়ার কিয়া। কুছ
কুছ হোতা হ্যায়। ঢুকে পড়ে মোগাম্বো খুশ হুয়া। কিম্বা সেই কাঁটা তারের বেড়ার মধ্যে
দিয়ে ঢোকে দেশ ভাগের করুণ কাহিনী। সানি সেখানে একা হয়ে যায় না। তার সিনেমার, তার
স্বপ্নের দোসর জুড়ে যায়। আফতাব সীমানা পার করে, কাঁটাতার পেরিয়ে নিয়ে আসে পাইরেটেড
বলিউড ফিল্ম। তারও স্বপ্ন একদিন ললিউড (লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ) থেকে বলিউডের
মতো জনপ্রিয় ছবি নির্মাণ হবে। সে সেই ধূষর ঊষর প্রায় বিদ্যুৎহীন গ্রামে বসে স্বপ্ন
দেখে একদিন বিখ্যাত পরিচালক হওয়ার। এই দুই সিনেমা পাগল বন্ধু হয়। আর একদিন আফতাব,
সানিকে পালাতে সাহায্য করে। কিন্তু পারে না। শেষে সত্যিই একদিন শর্ত মেনে নেয়
ইসলামী জঙ্গি সংগঠনটি। গ্রামের মানুষের আর্জিতে তারা ছেড়ে দিতে রাজী হয় সানিকে। সানি তখন তাদের কাছে চলা ফেরা করা একটা সিনেমা হল। তাই গ্রামের লোকেরা চায় বলিউডের ছেলে ফিরে যাক তার মায়ের কাছে। যার দাদু কোনো এক সময়ে লাহোরে ছিল। যার দাদু লাহোরের বাড়ির কথা চিন্তা করতে করতে একদিন মারা গেছেন।
বর্ডার
পার করার দায়িত্ত্ব নেয় আফতাব। কিন্তু সত্যি কি সানি বর্ডার পার করতে পারে? আফতাব
কি তাকে সত্যিই বর্ডার পার করিয়ে দিতে সক্ষম হয়? তখন সাদা পর্দা জুড়ে অফ ভয়েজে
বেজে চলেছে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ অগাষ্টের দুই সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র প্রধানের ভাষণ।
একদিকে নেহেরু অন্যদিকে জিন্না। মাঝখানে সীমান্তের কাঁটাতারের মাঝে অজস্র বুলেট
বৃষ্টির মাঝে কোনো এক সময়ের-অবিচ্ছ্যেদ্য রাষ্ট্রের দুই সিনেমা প্রেমিক পাগল। সানি আর
আফতাব। প্রাণপনে চেষ্টা চালাচ্ছে একে অপরের সাহায্য করতে। দুই সাধারণ মানুষ তাদের পরিচয়ের ভিন্নতা নিয়ে একই প্রশ্নের মুখোমুখি। তারা অনেকদিন পর চাপা পড়ে যাওয়া প্রশ্নটাকে যেন টেনে তুলছে। দেশভাগ সামনে আসছে এক অন্য পরিসরে...সংকটের আবহে। তারা অনেক দিন চাপা দেওয়া পরিচয়ের অংশীদার।
উইকিপিডিয়া বলছে বুশান, মুম্বাই, কেরালা এবং আরো অনেক
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উতসবে ছবিটি সাড়া ফেলেছিল সেই দুহাজার বারো সালেই। পুরষ্কার
জুটেছিল রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক। তারপরেও এতোদিন লেগেছে এই ছবিটি মুক্তির আলো
পেতে, দর্শকের সামনে আসতে। হ্যাঁ এটাও আমাদের এখনের একটা পরিচয়। এটাও আমাদের এখনের
একটা শাসন। কোনটা দেখানো হবে আর কোনটা নয়। জনপ্রিয়তার পরিসর অবশ্য অন্য কথা বলছে।
জানি না ছবিটা কতদিন হলে থাকবে। জানি না ছবিটা কতদিন আপনারা দেখতে পারবেন। কিন্তু
অনেক দিন পরে দর্শকের সাগ্রহ উপস্থিতি নজরে পড়েছে পিভি আর এ। প্রতিটি দৃশ্যের
তীব্র অনুভূতি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অনেক দিন এমন অনুভূতি স্পর্শ করেনি হৃদয়। অনেকদিন
কেউ তো এমন করে মনে করিয়ে দেয়নি...একদিন...এইদেশটা একছিল। পূর্বজদের কাজের স্মৃতি
সসন্মানে মনে রেখে বললাম। আমরা সাধারণ লোকরা সত্যি কি চেয়েছিলাম দেশভাগ? তাহলে কেন
হলো? তাহলে আমরা কোন পরিচয়ের শিকার হলাম?
ছবি গুগুল ইমেজ এবং ইউ টিউবের সৌজন্যে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন