ভালো থেকো ঋতুদা
জীবনের প্রথম চাকরীর ইন্টারভিউটা
দিতে গিয়েছিলাম ইন্দ্রানী পার্কের ‘তাসের ঘর’ নামের বাড়িটায়। যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে মাত্র তখন চলচ্চিত্রবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে নানা
দিকে ঘোরাঘুরি করছি কাজের সন্ধানে। অনেককে বলেছি। মাঝে মাঝেই জ্বালাতন করছি প্রিয়
শিক্ষদের। চাকরীর আবেদন নিয়ে সংবাদপত্র থেকে শুরু করে ঘুরে বেড়াচ্ছি ছোট ছোট
প্রোডাকশান হাউজ গুলোতে। কিন্তু কিছুতেই কিছুর সুযোগ মিলছে না। অনেকে ফ্রিতে
লিখিয়ে নিচ্ছেন অনেক কিছু। কেউ কেউ ছাপছেন সেই লেখা। কিন্তু পয়সা কোথায়? ঠিক এমনি
এক সময়ে যখন আমার ফিল্ম স্টাডিজটা লোকের কাছে ফিল্ড স্টাডি হবার উপক্রম একটা আশা
সূচক ফোন পেলাম আমার প্রিয় শিক্ষক মৈনাকদার কাছ থেকে। বলাবাহুল্য সেই নব্বই দশকের
শেষের দিকে মোবাইল ছিল না। ছিলনা ফেসবুক। বাড়িতে কম্পিউটার না। এমনকি চলমান দুরাভাষ তখন রূপকথা। একটা এস এম এস করে পালটে দেওয়া যেত না
জীবনের সিদ্ধান্ত। প্রায় সবকিছু। যাইহোক, মৈনাকদা জানালো পরিচালক ঋতুপর্ণ লোক খুঁজছেন তাঁর নতুন টিভি
চ্যানেলের জন্য। আমি যেন যোগাযোগ করি। কিন্তু ঋতুপর্ণর সাথে যোগাযোগ? সেটাই বা
মফস্বলে বালীর মতো জায়গায় থাকা কারো পক্ষে কী করে সম্ভব? মৈনাকদাই সব ব্যবস্থা করে
দিয়েছিলেন। সময় ঠিক ছিল সকাল সাতটা ইন্দ্রানী পার্কের বাড়ি। ভোর সাড়ে চারটের সময়
রওনা দিয়েছিলাম মনে আছে। ঠিক পৌনে সাতটার সময় তাঁর বাড়ির সামনে। আর ঠিক সাতটার
ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ডাক পড়লো নীচের বসার ঘরে। বাড়ির কোনো এক সহযোগী এসে দরজা খুলে
দিল। সেই সকালেও এক আধো আলো আধো অন্ধকারের ঘরের মধ্যে দেখলাম সামনে বসে আছেন পরিচালক। ততদিনে
দেখা হয়ে গেছে হীরের আংটি। ঊনিশে এপ্রিল। দহন। বাড়িওয়ালীর পোস্ট প্রোডাকশান চলছে।
আমাকে বসতে বলে খবরের কাগজে মন দিলেন তিনি। মুখে মাখা আছে ফেসিয়ালের আনুষাঙ্গিক
কিছু। একটু অদ্ভুত লাগলো। মিনিট পাঁচেক চুপচাপ বসে থাকলাম। পরিচালক খবরের কাগজ
পড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন এর আগে আমি কোনো কিছু কাজ করেছি কিনা।
আমার না বলাতে উনি খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না। আমার বাড়ির দূরত্ব নিয়ে সন্দিহান
প্রকাশ করলেন। ওঁর ধারনা হলো আমি সুদূর বালী থেকে এসে কলকাতায় কাজ করতে পারবো না। সময়ে আসতে
পারবো না। কিন্তু ওকে বোঝাতে চাইলাম না একটুও...আজও আমি সময়ে এসেছি...এই এতো
সকালে। যাইহোক কাজটা আমার হলো না।
কিন্তু সেই আমিই যখন আবার বছর সাতেক
পরে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সিগনেচার ছবির নির্মাণের বরাত পেলাম
বন্ধু বিক্রমজিতের সাথে, মাত্র একমিনিটের একটা জার্নির চিত্রনাট্য করতে গিয়ে মনে
পড়লো এক একা হয়ে যাওয়া বাড়িওয়ালীর কথা। ঠিক তখনি মনে হলো যে ধারাবাহিকতায় পথের
পাঁচালী থেকে শুরু করেছি আমরা সেই ধারাবাহিকতায় ঋতুদাকে দিয়ে শেষ করবো আমাদের
জার্নি। ২০০৭ সালে আমার হাতে তখন মুঠো ফোন। ঋতুদার নম্বর জোগাড় করতে অসুবিধে হল
না। একটা এস এম এস করে রাখলাম। আপনার বাড়িওয়ালীর কয়েকটা দৃশ্য চাই। একঘন্টার পরে
নিজেই ফোন করলো ঋতুদা। ওটা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ অনুপম খেরের সাথে ঋতুদার ঝগড়া।
দেবে না প্রযোজক ব্যবহার করতে। অগত্যা আমরা ঠিক করলাম চোখের বালী দিয়ে শেষ করবো
আমাদের সিগনেচার ছবি। সেই ছবির টুকরো পেতে আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। সহজে পাওয়া
গিয়েছিল। না ঋতুদার সাথে দেখা করতে হয়নি। যেতে হয়নি তার বাড়িতে। কোথাও যেন এই
ছবিটা দেখে একটা এস এম এস পেয়েছিলাম ভালো হয়েছে গোছের।
তারও অনেক দিন পরে। প্রায় বছর চারেক
পরে আমি যখন লেখা লেখির জগতে আরো বেশি প্রবেশ করতে চলেছি। আমার চাকরীর
সত্ত্বা, আমার তথ্যচিত্র নির্মাণের সত্ত্বা যখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্টার জলসার
শুভঙ্কর আর দীপজয় যখন ঠিকই করে নিয়েছে আমাকে দিয়ে আর কিছু না হোক একটু আধটু মেগা
সিরিয়াল লেখানো যাবে ঠিক সেই সময় আবার আমার ডাক পড়লো সেই ইন্দ্রানী পার্কের
বাড়িতে। এবার সকাল সাতটা নয়। সকাল আটটা। এবার আমি একা নই সঙ্গে যীশু ও নীলাঞ্জনা
সেনগুপ্ত এবং দীপজয়। দেখা করার আয়োজনের সূত্র কিছুদিনের মধ্যেই যে সিরিয়ালটা
সম্প্রচারিত হতে চলেছে তার সম্বন্ধে আলোচনা। আর যিনি এই সিরিয়ালের লেখক তার সঙ্গে
পরিচয় করা। অপরাজিতর চিত্রনাট্য পড়ে ভালো লেগেছিল শুনেছিলাম ঋতুদার। কিন্তু আমার
সামনে কোনোদিন কিছু বলেননি। সেদিন আমার সঙ্গে একটা কথাও না। আমিও চুপ করে ছিলাম। শুধু ভুল
গুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এবং বেশ প্রকট আর প্রখর ছিল সেই সমালোচনা। কয়েকটা
জিনিস মানতে বলেছিলেন। মনে আছে রাগ করে একটাও মানবো না বলে ঠিক করেছিলাম। ফিরে
এসেছিলাম মুখ গোমড়া করে বাড়িতে।
একবছর চলেছিল অপরাজিত। একটা পুরষ্কার
পেলাম। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য। পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার আগে পেলাম ঋতুদার শুভেচ্ছা
বার্তা। আর তার ঠিক কয়েকমাস পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা ফোন। ব্যোমকেশ নিয়ে একটা
ছবি করবো ভাবছি। তুমি লিখবে আমার সাথে? প্রথমে হ্যাঁ বলিনি ঋতুদাকে। না বলেছিলাম।
কারণ জলসা মুভিজে আমি তখন প্রমো এবং কনটেন্ট রাইটার। ঋতুদা বললো কার কাছ থেকে
পারমিশান আনতে হবে আমাকে বলো। শেষপর্যন্ত কারো কাছ থেকে পারমিশান জোগাড় করতে হয়নি।
বলেছিলাম মাত্র তিনদিন আমার হাতে সময় আছে। আপনি লিখতে পারবেন তো? বলেছিলেন আমি
না আমরা লিখবো। বেশ...। ফোন রেখে দিয়েছিলাম। বুকের মধ্যে দুরমুশ পিটছিলো কেউ।
সরস্বতী পুজোর দিন মাঘের শীত গায়ে মেখে আমি আবার
ঋতুদার বাড়ির সামনে ঠিক সকাল সাতটায় নয় বেলা দশটায় কলিং বেল টিপলাম। আর প্রথম
গিয়েই ঋতুদার বসার ঘরে ঢুকে দেখতে পেলাম সব জানলা খোলা। শীতের আলো ঠিকরে পড়ছে
ঋতুদার নানা রকমের দামী এ্যান্টিক জিনিসের বিচ্ছুরণ থেকে। সেই চোখ ধাঁধানো আলোর
মধ্যে বসে আছে ঋতুদা। বিড়বিড় করে মনে মনে কী যেন বলছে আর লিখছে তার প্যাডে। আমাকে
দেখতেই বললো...বাহঃ...একদম সময়ে এসে গেছিস? এই নে...আমার প্যাড আর কলম আজ থেকে
তোর। ছ্যাঁক করে উঠেছিল কথাটা শুনে। আমি একটু সরে এসে বললাম আমি বহুদিন পেনে
লিখিনা। টাইপে অভ্যস্ত। শুনে মনে হল খুশি হল লোকটা। বাহঃ তাহলে আমরা রোজ...একটা
করে প্রিন্ট নিতে পারবো। লেখা শুরু হলো আমাদের।
ঋতুদা বলে...আমি লিখি। লেখা থামিয়ে
আমার কাছে জানতে চায়। আমার মতামত বললে লক্ষ্য করি পছন্দ করছে না লোকটা। খালি বলছে
আমি টেলিভিশন রাইটার। তাহলে আমাকে কেন? একদিন যখন ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে পড়েছি...তখন সব
কিছু ঢাকা দেওয়ার জন্য বললো ফুচকা খাবি? আমি অবাক...দুপুরে ওই অতো কিছু খাবার পরে
ফুচকা? সকালেই তো দেখলাম ইনজেকশান নিচ্ছে। আমি খাবো না বলাতে...জোর করলো না।
নিজের জন্য আনালো। সেদিন আর লিখলাম না আমরা গল্প করলাম। ব্যোমকেশ আর অজিতকে নিয়ে
বারবার বললাম উড়িষ্যার জঙ্গলে যে রাজবাড়িটা পাচ্ছো সেখানে যাও। ঋতুদার আপত্তি ছিল
সব কিছুতে। ছিল গরমে ভয়। এক রুক্ষ অরণ্য ছিল কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে। আমার কাছে
জানতে চাইতো এই যে ব্যোমকেশ...একে তুই কেমন করে দেখছিস? বলতো নিজের ব্যোমকেশের
কথা। চোরাবালি গল্পটাকে দুমড়ে মুচড়ে পালটে দিয়েছিল। মূল গল্পে যে রানী এক লাইনে
ছিলেন সেই রানী হলেন ঋতুদার ছবিতে প্রধান চরিত্র। পাখি শিকার আমি লিখবো না জেদ
ধরেছিলাম। তোমার ব্যোমকেশ আর অজিত ঠ্যা ঠ্যা করে পাখি শিকার করবে...এ কেমন বোকা
বোকা সব জিনিস। উত্তরে বলেছিল বুঝছিস না...সময়টা দেখ...। তোরা না আজকালকার
টেলিভিশন রাইটাররা সব মুখ্যু...। তবুও...শেষ পর্যন্ত পাখি শিকার থাকে নি।
চিত্রনাট্য যত শেষের দিকে যেতে শুরু করলো আমাদের চারপাশে বইয়ের সংখ্যা বাড়তে
লাগলো। অনেক রেফারেন্স...অনেক মানুষকে ফোন...পোষাকের ডিটেল নিয়ে লিখতে লিখতে ঋতুদা
কথা বলতো। এক-একটা চরিত্র অভিনয় করে করে ডিটেলে লিখতো।
তবে শেষের দিনের ঝগড়াটা ছিল বানান
ভুল নিয়ে। তাড়াতাড়ি অভ্রতে টাইপ করতে গিয়ে অনেক কিছু বানানের গন্ডগোল হয়। বলেছিলাম
সব ঠিক করে দেবো। ঋতুদা শোনেনি। গোড়ায় যে ছেলের গলদ...তাকে নিয়ে তিনি পথ চলবেন কী
করে? সত্যান্বেষীর প্রথম ড্রাফট দিয়ে তাই আর ফিরে তাকায়নি ইন্দ্রানী পার্কের বাড়ির
দিকে। পয়লা বৈশাখে একটা এস এম এস এসেছিল। “নতুন বছরের অনেক আদর”। তারপর ৩০ শে মে।
সবাই বললো ঘুমের মধ্যেই চলে গেছে মানুষটা। তার সাথে নাকি সবার খুব কাছাকাছির সম্পর্ক ছিলো। বেশিরভাগ লোক কান্না
কাটি করলো। অফিসে বসে দেখলাম। আর মনে পড়লো ইন্দ্রানী পার্কের বাড়িতে দোতলার বসার
ঘরের জানলার কাছটা। একটা লোক চুপ করে বসে আছে। বারবার হাতড়ে দেখছে মোবাইল। কেউ কি টেক্সট করলো তাকে? ম্আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো এতো চুপচাপ থাকিস কী করে তুই?
কেউ ফোন করে না তোকে?
প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবার জানলার
দিকে তাকায় ছোট করে চুল ছাঁটা লোকটা। বিড়বিড় করে বলে এবার গরমটা যদি খুব বেশি পড়ে
তাহলে কাজ করতে খুব অসুবিধে হবে। দেখতো তোর পাশের ফোনটা কী বাজছে? এগিয়ে দিই
মোবাইলটা। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে ঋতুদা। না বাজছে না। আমাকেও অনেকক্ষণ কেউ ফোন
করেনি জানিস। যাক মরুক...ভুলে যাওয়াই ভালো।
এখোনো আমার ফোনে ঋতুদার ফোন
নাম্বারটা আছে। ডিলিট করিনি। গুগুলের চ্যাট বক্সে পেন্ডিং আছে রিকোয়েস্ট।
মরলেই ভুলে যাওয়া যায় না...এই
লেখাটাই হয়তো তার প্রমান ঋতুদা...।
যেখানেই থাকো ভালো থেকো।
অনেক আদর...।
ছবি সৌজন্য গুগুল, প্রদীপ্ত।
ভালো থেকো ঋতুদা।
উত্তরমুছুনআহা।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনDuronto experience,pore khub valo laglo, inspiring !
উত্তরমুছুন