দেখার যত উপায়
দেখার যত উপায়
আমি ওকে দেখি রোজ...উত্তরপাড়ার খেয়া
ঘাটে ময়লা কাগজ তুলে বস্তায় ভরতে। ধর্মতলার মোড়ে গাড়ির সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়াতে।
হাওড়া স্টেশনে বুট পালিশ করতে। দমদম বিমানবন্দরের গেটের পাশে চায়ের দোকানে কাপ
ধুতে। ঢাকা শহরের অভিজাত ধানমন্ডির সুখাদ্য স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টের রাস্তায়
রিক্সা টানতে। আসলে আমি ওকে রোজ দেখি। ওকে দেখতে হলে আমাকে কষ্ট করতে হয় না। এমনি,
ইচ্ছে করলেই ওকে দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের গাল ভরা অভিধানে ‘ও’ খুব
সামান্য জায়গা জুড়ে থাকে। খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়। মুছে ফেলা হয় নোংরার মতো ‘ও’কে
শহরের মাঝখান থেকে। আমরা ওর জন্য অনেক কিছু করার সংকল্প নিই। আমরা চাই ‘ও’ আমাদের
অনুকম্পা নিয়ে বড় হোক। বড় হতে হলে যে শ্রমটুকু লাগে সেটা রাষ্ট্রকে দিক। একটা
শিশুর রক্ত ভেজা ঘামে পরিপুষ্ট লাভ করুক আমার স্বদেশ ভূমি। হ্যাঁ এটা এখনও ঘটে
চলেছে আমাদের উপমহাদেশের প্রতিটি কোনায়। এটা ‘ঘটমান-বর্তমান’ প্রতিটি নগরে।
সভ্যতার আনাচে কানাচে।
এতোদূর পড়ে এসে আপনি থমকে যেতে
পারেন। বিরক্ত হয়ে চলে যেতে পারেন অন্য ব্লগে। কিম্বা নিরস মুখে বন্ধ করে দিতে
পারেন ব্রাউজারের পাতা। কিন্তু এই এতোসব কিছু করার আগে আমি আপনার কাছে জানতে
চাই...অর্জুন হরিশচাঁদ ওয়াগমারেকে আপনি চেনেন কী? কোনোদিন রাস্তায় যেতে গিয়ে আপনার
সাথে তার দেখা হয়েছে? বুট পালিশ করে দেওয়ার ফাঁকে...? চায়ের গ্লাস এগিয়ে দেওয়ার
সময়...? অফিস টাইমে রিক্সায় উঠে...? কিম্বা নিছকই বাড়ি যাওয়ার পথে কোনোদিন কোনো
ছোট্ট ছেলের কাছে জানতে চেয়েছেন কি সে কী খায়? কোথায় থাকে? কেনো এই কাজটা করছে?
কেনো সে পড়াশুনো করে না? এই যে আমাদের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার কোটি কোটি টাকা
খরচ করে ‘স্কুল চলে হাম’ এর বিজ্ঞাপন নির্মাণ করলো তার কী হলো? এই যে স্কুলে মিড
ডে মিল দেওয়া হল; কেনো অনেক বাচ্চাকেও স্কুলের অভিমুখে ফিরিয়ে আনা গেলো না? কেনো
আইন করেও শিশু শ্রম বন্ধ করা গেল না? এই এতোসব প্রশ্ন আপনি নিজের মনে করতে পারেন।
আবার নাও পারেন। আসন্ন মন্ত্রি সভা গঠন নিয়ে সকালের প্রাতরাশে দুপুরের খাবার মেনু
ঠিক করতে পারেন। কিম্বা বৃষ্টিহীন দিনে কৃত্রিম বৃষ্টিতে স্নান করার লোভনীয়
প্যাকেজ হাতড়াতে পারেন। সেটা আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। এতে কোনো অভাব অভিযোগ নেই
কারো। থাকতেও পারে না। কারণ আমরা জানি ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা নিয়ম
বিরুদ্ধ। তা রাষ্ট্রের পক্ষে নেতিবাচক ভূমিকার পরিচয় বহন করে। যদিও সামনে যা দেখে
চলেছি...যা ঘটে চলেছে তা এক্কেবারে অন্য কথা বলে। যাইহোক এবার এই ছবির ট্রেলারটিকে
মন দিয়ে দেখুন তো। ভাষা বুঝতে পারবেন না। কারণ ছবিটা মারাঠী। নাম ফ্যান্ড্রি। আক্ষরিক
অর্থ মারাঠী গ্রাম্য গালাগালি “ বুনো শুয়োর”। মন দিয়ে দেখুন...আর মনে করার চেষ্টা
করুন এই যে ছেলেটাকে আপনি দেখছেন একে জীবনের কোনো রাস্তায়... কোনো কানা গলিতে
দেখতে পেয়েছেন কিনা।
ধরে নিচ্ছি হয়তো পাননি এর দেখা পাননি।
ধরে নিচ্ছি এই যে ছেলেটি জাব্য...তাকে গ্রামের লোক ফ্যান্ড্রি বলে খেপায়। দলিত বলে
গ্রামের বাইরে শুয়োর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। স্কুলের পড়ার ফাঁকে মা, বাবা, বোনদের
সাথে কাজ করতে হয় মাঠে, বাজারে, লোকের বাড়ির উঠোনে। তবুও জাব্য স্কুলে যায়। উচ্চ
বর্ণের একটি হিন্দু মেয়েকে তার ভালো লাগে। তার আসা যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে জাব্য। চেয়ে
থাকে কারণ সে বিশ্বাস করে তার জীবনের এই যে প্রথম একটা প্রেম এসেছে...সেটাকে
সার্থক করে তুলতে সে যা খুশি করতে পারে। কিন্তু কী করতে পারে জাব্য? আইসক্রিম
বিক্রি করে একটা জিনসের প্যান্ট সে কিনতে চায়। শহরের রাস্তায় ম্যানিকুইন দেখে
দাঁড়িয়ে যায় জাব্য। তার সরু নাকের গঠনের কাছে নিজের নাক বড় মোটা মনে হয়। দিনে
কাজের শেষে বা শুতে যাবার আগে সদ্য প্রেমের অনুভূতি পাওয়া জাব্য তাই নিজের নাকে
আটকে রাখে কাপড় শুকোতে দেওয়ার প্লাস্টিকের ক্লিপ। মেয়েটা কী ফিরে চায়? নাহ,
কোনোদিনও না। একটা চিঠি লেখে জাব্য...তাও তো সাহস করে দেওয়া হয় না। তবুও এক বাস্তব
আর স্বপ্নের মিশেল ছুঁইয়ে যান পরিচালক নাগরাজ মঞ্জুলে। কালো ফিঙে পাখি শিকার করে
তার ছাই যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় ভালোলাগা মানুষটার গায়ে...তাহলে সে নাকি বশ মানে।
গ্রাম্য মিথ নিয়ে এক বিশাল ক্যানভাসে ধূসূর রঙের জমিতে পাতাহীন গাছে গাছে চোখ
ফেরায় জাব্য। এ যেন আমার আদিম ভারতীয় অরণ্য ভূমিতে এক প্রাচীন জনজাতির পদচারণ।
শুধু তফাতটা থেকে যায় অন্য জায়গায়। এই ব্যাধ...এই শিকারের প্রক্ষালণ জীবন ধারণের
ক্ষুদার জন্য নয়। এই বাঁচা...এই জীবনের তাপ পুইয়ে নেওয়া শুধু অস্ত্বিত্তের সঙ্কট
নিরসনে। বন্য শুয়োর জাব্যর ভাগ্যে প্রেম জোটে না। জোটে না দুবেলার আহার। তবুও
গ্রামের স্কুলে প্রার্থনা সভায় জাতীয় সঙ্গীতের মাঝে শুয়োর তাড়াতে তাড়াতে ক্লান্ত
জাব্য ঢুকে পড়ে। এক আর্য সংস্কৃতির সঙ্গে অনার্য সংস্কৃতির ভারতকে পরিচালক,
চিত্রনাট্যকার নাগরাজ মঞ্জুলে ধরিয়ে দেন উত্তর আধুনিকতার উত্তর-পূর্ব মানসিকতায়।
আর ঠিক সেই খানে অন্য আর অনেক চরিত্রের মাঝে জাব্য আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। শুকনো রুক্ষ...
এক বৃষ্টিহীন গ্রামের ছেলে আমার পাশে ঘোরে। স্কুলে পড়তে চায়। প্রেমে পড়তে চায়।
কখোনো কখোনো আমার দিকে আঙুল তোলে। জীবনকে রূপকথার মতো গল্পে ভরিয়ে তোলে জাব্য। যে
রূপকথা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। জানে বেরিয়ে আসলে বাস্তবের যে কালো মেঘের
সামনে পড়বে সেখানে থাকবে না পাওয়ার বেদনা। সেখানে থাকবে শুয়োর চড়িয়ে ঘরে ফেরার কথা।
সেখানে থাকবে টাকার অভাবে দিদির বিয়ে না হওয়ার গল্প। সেখানে থাকবে উঁচু আর নীচু
জাতির এক বিরাট পাঁচিল। জাব্য বেরোয় না সেই চক্রব্যুহ থেকে বেরোতে পারবে না সে
কোনোদিন। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাকে চিরকাল সেই গ্রামের বন্য শুয়োর করে রাখবে। আর দলিত
পরিবার আরো অন্ধকারের মধ্যে ডুবতে থাকবে। আর অপেক্ষা করবে...যদি ক্ষণিকের প্রতিবাদ
একদা বিল্পবের চেহারা নেয়।
ফ্যান্ড্রির জীবনকে দেখার ভঙ্গির
সাথে অর্জুন হরিশচাঁদ ওয়াগমারের জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। অর্জুনের কথা
দিয়ে শুরু করেছিলাম। প্রশ্ন করে আপনাকে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলেছিলাম। তার কারণ
আছে। ফ্যান্ড্রিকে এই মুহূর্তে আপনার হলে দেখার সুযোগ নেই। কোনো হলে চলছে না। টোরেন্টে
চোরাগোপ্তা পথে কোথাও কোথাও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে ফ্যান্ড্রির। রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার
তার গলায় বিজয়মাল্য পরালেও আসল ফ্যান্ড্রিরা থেকে গেছে অনন্ত অন্ধকারে। অন্য এক
রূপকথার রাজ্যে। ফ্যান্ড্রিকে দেখার সুযোগ নেই ধরে নিলাম। কিন্তু অর্জুনকে দেখার
সুযোগ আছে তার একটা গাড়ির সাথে। গাড়িটার নাম হাওয়া-হাওয়াই। আলোচনায় যাওয়ার আগে
নীচে এক ঝলক অর্জুনকে আর তার বন্ধুদের দেখে নিন।
এক সব খোয়ানো তুলা চাষীর ঘরের ছেলে
অর্জুন। যে বাবা ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিল মাথার ওপর সেই বাবা মারা যাবার পর অর্জুনকে
চলে আসতে হয় মায়ের সাথে ছোট ছোট ভাইবোনদের হাত ধরে কাজের শহর মুম্বাইতে। অর্জুন
এসে চায়ের দোকানে কাজ নেয়। আর অর্জুন আবিষ্কার করে স্কেটিং এর মতো খেলাকে। গরীব
লোকের ছেলের বড় লোকের খেলায় ইচ্ছে হলে যা হয়...তাই এখানে ঘটতে থাকে। কিন্তু অর্জুনের
পাশে এসে দাঁড়ায় তার বন্ধুরা। এক জনপ্রিয় পরিসরে অর্জুনের স্বপ্নকে জিতিয়ে দেন
পরিচালক অমল গুপ্তে। স্ট্যানলি কা ডাব্বার পরিচালক এখানে স্বপ্নের মায়ায় অর্জুনকে
আচ্ছন্ন করে রাখেন যতটা তার চেয়েও বেশি তার বন্ধুরা তাকে সাহস দেয়। প্রেরণা দেয়।
আর যেন কোথাও ছোট বেলায় পড়া মতী নন্দী উঠে আসেন। মনে হয় যুগ যুগ ধরে জিতে যাওয়ার
গল্প গুলো কি একই সুতোয় বোনা? অর্জুন শুধু তার নিজের জন্য জেতে না। অর্জুন জেতে
তার বন্ধুদের জন্য। অর্জুন জেতে তার কোচের জন্য। অর্জুন জেতে তার মায়ের জন্য।
বাবার মৃত্যুর অপমানের দুঃখ ভুলতে অর্জুন জিতে যায়।
অর্জুন জেতে। কিন্তু দর্শক হিসেবে
আমরা কতটা জিতিয়ে দিতে পারি এদেরকে? আদৌ কি খবর রাখি এইসব সিনেমার? বাড়িতে বাচ্চা
থাকে। তাদের পড়ার চাপ থাকে। তাদের টেলিভিশন দেখা নিয়ে থাকে হাজারো নালিশ, পেটানি।
থাকে অল্পতে বকে যাওয়ার মতো হাজারো কৈফিয়ৎ। কিন্তু আমরা আমাদের বাচ্চাদের কি নিয়ে
যেতে পারছি সেই সব সাদা পর্দার বাচ্চাদের কাছে? যাদের জীবন দেখার উপায় বদলে দিচ্ছে
গোটা ছাত্র জীবনকে? কিম্বা যাদের যত দেখার উপায় নিরীক্ষিত হচ্ছে আমারই হারিয়ে
যাওয়া ভালো ছবির পরতে ভারতীয় সিনেমায়? একটু ভেবে দেখবেন কী? এখোনো ছবিটা হলে আছে।
পারলে বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যের সাথে ঘুরে আসুন। দু ঘন্টা কিভাবে কেটে যাবে বুঝতে
পারবেন না। আর অর্জুনকে বন্ধু হিসেবে পেলে জীবনটাকে এবার থেকে সত্যি হয়তো অন্যভাবে
দেখবে আপনার বাচ্চা। তখন আর হাত তুলে...মুখ গম্ভীর করে শাসন করতে হবে না।
ছবির ট্রেলার, গান ইউ টিউবের সৌজন্যে। আর ছবির স্টিল গুগুল ইমেজের কৃতজ্ঞতায়...।






মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন