গোরানকশাল (পাঁচ)
গোরা নকশাল
একজন কিশোর ছিল, একেবারে একা
আরও একজন ক্রমে বন্ধু হল তার।
দুয়ে মিলে একদিন গেল কারাগারে;
গিয়ে দেখে তারাই তো কয়েক হাজার!
(জেলখানার কবিতা/বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়)
পাঁচ
জানলা গুলো ছিল একদম ঘরের মাথার
কাছে। মানে যেখানটায় কড়িকাঠ। ওখান দিয়ে দিনের প্রথম আলো এসে পড়ে। এক ফালি আলো
মেঝেতে লুটোচ্ছে। দিনের প্রথম সূর্যের আলো। একটা লোক দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
আধো আলো আধো অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না তাকে। লোকটার ঠোঁটের পাশ দিয়ে মানে কষ
বেয়ে পড়ছে রক্ত। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে শরীরটা। আবার স্থির হয়ে যাচ্ছে। ঘরের কোনে
জলের কল থেকে টিপ টিপ জল পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। মাথা তোলে লোকটা। তার কি জল পিপাসা
পেয়েছে? কিন্তু সে তো জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। সে এগোচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত
দিকে। যেখানটায় সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে সেখানে। ভাঙাচোড়া, দোমড়ানো মোচড়ানো
শরীরটাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে লোকটা সেই এক ফালি টুকরো আলোর দিকে। ঘেঁষটে ঘেঁষটে
এগিয়ে যাচ্ছে রক্তে ধোওয়া শরীরটা। মনে হচ্ছে একটা সরীসৃপ যেন এগিয়ে চলছে এক টুকরো
আলোর দিকে। ডানহাতটা আলোর প্রসারিত টুকরোর ওপরে রাখে লোকটা। আর ঠিক তখনি সারা ঘরটা
যেন কেঁপে ওঠে নবজাতকের কান্নার আওয়াজে।
“কাকে নিয়ে লিখছিস টুকনু?” বড়মা আমার
দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। আমি রহস্য সৃষ্টি করি। বলো তো কাকে নিয়ে লিখছি? “তোর
সিরিয়ালের কিছু?” আমি হাসি। না। “তাহলে?” গোরা নকশালকে নিয়ে! বড়মা আস্তে আস্তে উঠে
চলে যায় পাশের ঘরে। আমি পিছু নিই। সঙ্গ ছাড়ি না। বড়মার এখন মনে থাকে না কিছু। খুব
তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। আবার যখন বলতে শুরু করে গড়গড়িয়ে বলে চলে। এতোটুকু ক্লান্তির
ছাপ পড়ে না বিরাশি বছরের চোখে মুখে। ভালো লাগলো না তোমার? বড়মা দাঁড়ায়। ফিরে তাকায়
আমার দিকে। “মনে আছে গোরাকে তোর এখোনো?” আমি মাথা নাড়ি। হ্যাঁ। “কেউ তো আর মনেই
রাখে না তাকে। একটা লোক যে ছিল...ভুলে গেছে সবাই।” আমি ভুলিনি বড়মা! জানলা দিয়ে
আসা মাঘের শেষবেলাকার রোদ এসে পড়ছে বড়মার গায়ে। শাদা চাদর আর শাড়িতে উজ্জ্বল হয়ে
উঠেছে জায়গাটা। আমার ফাস্ট হওয়া দাদার ঝকঝকে ফ্ল্যাটের মেঝে থেকে বিচ্ছুরিত আলোয়
বড়মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে “বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা তোর মনে আছে টুকনু?”
কোনটা বড়মা? “ওই যে...ওই যে...বল না...। বল না...।” বড়মা হাতড়াচ্ছে...বড়মা মনে
করছে...কিছু স্মৃতি পরতের টানে ফিরে আসছে আর কিছু লোপাট হয়ে যাচ্ছে চিরটাকালের
মতো। শীতাভ রোদের বিরাশি বছরের এক প্রাচীন মানুষ আমার কাছে জানতে চাইছে একটা
কবিতা... আর আমি ছুটছি...আমি ছুটছি ফ্ল্যাশব্যাকে। আমি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি
আমার বাসাটাকে। ওই তো...ওই তো...বাবা বসে আছে...ওই তো হাঁদা দোকান বন্ধ করে
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে এলো...। দাদার হাতে ওটা কী? ওই চটি বইটা কোথা থেকে পেলো?
গোরা নকশাল দিয়েছে। লেখা আছে ‘প্রথম হওয়ার উপহার...’। ইশ...খালি তো একটা চটি বই
তার ওপর আবার প্রথম হবার উপহার। দেখবি আমাকে এই এত্তোবড় একটা আরব্য রজনীর বই দেবে
গোরা নকশাল। সামনেই আমার জন্মদিন কিনা। টেনে নিতে যাই দাদার কাছ থেকে বইটা। ছিঁড়ে
যায় ওপরের মলাট। আমার গম্ভীর দাদা কিছু বলে না। পাশ থেকে একটা থাপ্পড় এসে আমার
গালে পড়ে। মায়ের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না আমার। রাগ হয়। কেউ এসে বলে না “বাচ্চাদের
মারবেন না। বাচ্চাদের গায়ে হাত দিতে নেই।” বলার লোকটা চলে গেছে। শোনা যাচ্ছে
সুশান্তকে পুলিশ মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে পুড়েছে। চটকল কবে খুলবে ঠিক নেই। দাদা
বলেছে আর কোনোদিন সুশান্ত প্রেসিডেন্সিতে পড়তে পারবে না। দাদা দুঃখ পেয়েছে। আর
গোরা নকশাল চুপ করে গেছে বেশ কিছুদিন।
“কী রে পেলি?”
খুব সহজে কী পাওয়া যায় অতীতকে বড়মা? ভ্যাগিস দাদা
গোছানো। আমার মতো বাউন্ডুলে উড়নচন্ডী না।
সেই ছেঁড়া মলাটের পাতলা বইটা আমার
হাতে। কোন কবিতাটার কথা বলছিলে তুমি? বড়মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে “কবিতার কথা
বলছিলাম নাকি? আমি তো সূচ খুঁজছিলাম। একটা ফুল তুলবো রুমালে। তোর বাবা বলেছিল একটা
ফুল দেওয়া রুমাল লাগবে স্কুলে।”ভুলে গেছে বড়মা। ভুলে গেছে বাবা অনেক দিন বেঁচে
নেই। ভুলে গেছে এই মুহূর্তকাল আগে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামটা নিজেই আমাকে মনে
করিয়ে দিয়েছে। আমাকে ডাকছে আমার ল্যাপটপ। আমাকে বলছে আর একবার শোনাও তো মিছিলের
কবিতাটা। ব্লগ স্পট বলছে এখনি লিখে ফেলতে হবে পাঁচ নম্বর অধ্যায়টা। আর সেই কবেকার
কবিতার বইটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছে “মনে আছে টুকনু আমাকে?”
সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে
মাত্র কয়েকটি পুরনো মুখ;
আর যারা, একাবারেই কিশোর
আর যারা, জেলের অন্ধকারে বহুদিন
হারিয়ে যাওয়া শিশুগুলির
কেউ মা, কেউ বোন...।
চুপ করে থাকে গোরা নকশাল। তখনও
কবিতার রেশ ছেয়ে আছে সারা ঘরে। দাদার হাতে খোলা কবিতার চটি বইখানা। কিছুক্ষণ আগে
সুশান্তকে পুলিশ মারতে মারতে নিয়ে গেছে জুটমিলের সামনে থেকে। আর আমি দেখেছি ছিটকে
পড়েছে ছিপপছিপে রোগা ছেলেটার চোখ থেকে চশমা। লাঠির আঘাতে কুঁচকে গিয়েছে শরীর। তবু
একফোঁটা চিৎকার করেনি সে। ঠাম্মা বেরিয়ে এসেছে। বাবা ছুটে গেছে স্কুল থেকে। কারো
কথা শোনেনি ওরা। পুলিশের জিপে দুমড়ে মুচড়ে তুলে নিয়ে গেছে তাকে। আমি শুধু দৌড়ে
গিয়ে হাতে দিয়ে আসতে পেরেছিলাম কাঁচ ভাঙা চশমাটা। আমি জানতাম চশমা ছাড়া সুশান্ত
দেখতে পায় না। কিন্তু সুশান্তকে যে আমি আর কোনোদিন দেখতে পাবো না সেটা তখনো জানতাম
না।
গোরানকশাল?
ফিরে তাকায় কোঁকড়াচুলের দাড়িভর্তি
ফরসা মুখের লোকটা।
ওরা সুশান্তকে কোথায় নিয়ে গেলো? আমার
প্রশ্নে গোরা নকশালের চোয়াল শক্ত হয়। গঙ্গার ধারের চিলেকোঠার ঘরের মধ্যে এখন উড়ে
বেড়াচ্ছে চড়ুইয়ের বাচ্চা গুলো। ওরা বড় হয়ে গেছে। ওরা উড়তে শিখেছে। গোরা নকশাল আমাকে
ইশারায় ডাকে। আমি এগিয়ে যাই। ফিসফিস করে বলে “ওই ওখানে রাখা বাটিটা নিয়ে আয়।” আমি
খুব খুশি মনে তাড়াতাড়ি যাই। নিশ্চই কালকের মতো কোনো সন্দেশ রেখে দিয়েছে গোরা
নকশাল। খুলনার কলাপোতার চিট সন্দেশের নামে সবাইকে পাগল করে দিয়েছিলাম আমি। বাটিটা
হাতে নিতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। একি এটা তো আটা মাখা। মুখে কিছু বলি না। এগিয়ে দিই
গোরা নকশালের দিকে। “আজ আমার চড়াই গুলোকে একটু খাওয়াতো টুকনু...বাইরে নিয়ে
যা...অল্প অল্প করে আটার ডেলা বানিয়ে ছুঁড়ে দে... দেখবি ওরা কেমন টুপ টুপ করে এসে
খাবে!” মনের সাথে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আমার। একে বাড়িতে আছে হাঁদার নকশাল। সে
প্রায়ই আমার পড়ার এ্যালুমিনিয়ামের বাক্সটাতে সবুজ হাগু করে রাখে। তখনই বাড়ির লোকের
টনক নড়ে আমি নাকি অনেক দিন পড়িনি। এক নম্বরের শত্রু হল হাঁদার নকশাল। আর এখন আবার
চড়াই! পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে গোরা নকশাল। “আচ্ছা টুকনু আমি যখন থাকবো না...তখন
আমার এই চড়াইদের কে খাবার দেবে?” আমি বিরক্তি নিয়ে বলি... “আমি পায়রা, চড়াই এদের
কাউকে ভালোবাসি না...। এরা সব সময় আমার আমার পড়ার বাক্সতে হাগু করে রাখে। আর মা
বলে আমি নাকি অনেক দিন বাক্সই খুলিনা...আমি পড়ি না...।” হো হো করে হেসে ওঠে গোরা
নকশাল। চেপে ধরে আমাকে। আমিও কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ি। আমি কেমন যেন একটা গন্ধ
পাই লোকটার গায়ে। যে গন্ধ জড়ানো থাকে লেপের মধ্যে...শীতের চাদরের কুন্ডুলীতে...
দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া মানুষগুলোর সার বেঁধে রাতে শোয়ার স্বপ্নের মধ্যে। হাঁদা, ঠাম্মা,
মণি সবার গায়ের গন্ধ...জেলের গন্ধ...আমার মন কেমন করায়। আমার ঘুম পায়। আমি ঘুমিয়ে
পড়ি।
তাকিয়ে থাকে লোকটা অপলক টুকনুর দিকে।
তার ছোট্ট জোড়া ভুরুর দিকে। কান রাখে গোরা নকশাল টুকনুর বুকে। ওখানে শুনতে পায়
ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ। ওখানে প্রান আছে...ওখানে ক্ষিদে আছে...ওখানে আছে অধিকার বুঝে
নেওয়ার বীজ মন্ত্র। বারবার ফিরে ফিরে গোরা নকশাল একই কথা বিরবির করে। আর করেব নাই
বা কেনো? বুকে কান রাখলে গোরা নকশাল যেন শুনতে পায় ধামসার ডিমি ডিমি দ্রুম দ্রুম
শব্দ। হঠাত যেন সামনে চলে আসে সেদিনের সেই সকালটা। যন্ত্রনায় যখন কুঁকড়ে যাচ্ছে শরীর।
ভোরের আলো যখন প্রথম এসে পড়েছে প্রায় অন্ধকার খুপরিরি মেঝেতে ঠিক তখনি গোরা নকশাল
শুনতে পেয়েছে একটা নবজাতকের চিৎকার। তাহলে অমিয়ার সন্তান জন্ম নিলো আজ এই মারাত্মক
সকালের রক্তভেজা আলোর বিচ্ছুরণের মধ্যে দিয়ে? অমিয়া কি জানে তার সন্তানের বাবা
প্রিয়াংশু নিহত হয়েছে এই কিছুক্ষণ আগে পুলিশ কাস্টডিতে! অমিয়া কি জানে প্রথমে ওরা
প্রিয়াংশুর চোখটা খুবলে নিয়েছে তারপর গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিয়েছে। ছিটকে লেগেছে
ঘিলু গোরা নকশালের গায়ে। গোরা নকশাল চিতকার করে উঠেছে প্রি...য়াং...শু...। গোরা
নকশাল দেখেছে কেমন করে যেন ছুটছে ওরা দুজনে একটা সরু গলির মধ্যে দিয়ে। পেছনে ছুটে
আসছে পুলিশের একটা বড় দল। সামনে একটা পাঁচিল...। দুজনে টপকাতে যাচ্ছে। কিন্তু
পারছে না প্রিয়াংশু। “ধরা দিয়ে দিন কমরেড গোরা...। না হলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।
অমিয়া প্রেগনেন্ট...আমি চলে গেলে ওকে...” কথা শেষ করতে পারে না প্রিয়াংশু। সামনে
পাঁচিলের ওপর পুলিশের আর এক দল। ওদের হাতে বন্দুক। তাক করা দুই বন্ধুর দিকে। “চক্রব্যুহর
মধ্যে ঢুকে অভিমন্যু কি বলেছিল মনে আছে আপনার?” প্রিয়াংশু ফিসফিস করে বলে। গোরা
কোনো জবাব দেয় না। “আমার বড় অমিয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে গোরা।” ততক্ষণে পিছমোড়া করে
বাঁধা হয়ে গেছে ওদের। ঘেষটে ঘেষটে তোলা হচ্ছে দুই ছেলেকে। আশে পাশের বাড়ির লাইট
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা কোনো কিছুর সাক্ষী থাকবে না। ওরা থাকতে চায় না। ওরা চায় সুখী
গৃহকোণ।
কিন্তু প্রিয়াংশু কী চেয়েছিল? একটা
খুলি ওপড়ানো মৃতদেহের দিকে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে যেতে থাকে গোরা নকশাল। কারণ গোরা নকশাল
স্পষ্ট দেখছে প্রিয়াংশুর ঠোঁট নড়ছে এখনও । প্রিয়াংশু কিছু বলছে। “এ্যাই প্রিয়াংশু...এই
প্রিয়াংশু...কী বলছেন...কী বলছেন...।” নখ বিহীন রক্তাক্ত আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এগোয়
গোরা নকশাল। যতবার এগোয় ওরা ততবার গোরার পায়ে লোহার রড দিয়ে মারতে থাকে। চিতকার
করে ওঠে গোরা নকশাল। “প্রিয়াংশু কিছু বলতে চায়...আপনারা শুনতে পাচ্ছেন কী? এই যে
সরুন...সরুন...ও কিছু বলতে চায়...।” পুলিশ গুলো হাসতে থাকে। “এই যে শুনছেন
প্রিয়াংশু কিছু বলতে চায়...”। অপলক তাকিয়ে আছে প্রিয়াংশু...। গোরা নকশাল কোলের ওপর
তুলে নিয়েছে খুলিহীন একটা মাথা। “প্রিয়াংশু কিছু বলছে আপনারা শুনুন...প্রিয়াংশু
বলছে আপনারা মানুন...কমরেড...কমরেড বুঝতে পারছেন না কেন...ওর একটা বাচ্চা হবে...ওর
স্ত্রী আসন্ন প্রসবা...এ্যাই প্রিয়াংশু কিছু বলছেন কি আপনি? কমরেড প্রিয়াংশু...।”
সংজ্ঞা হারিয়ে যায় গোরা নকশালের। সেদিন কেন গোরা নকশালের খুলি উড়িয়ে দেওয়া হয়নি
সেটা সে ভেবে উঠতে পারে না। এক উদ্বাস্তু মরে গেলে তার মা ছাড়া আর কেউ কাঁদার থাকে
না। কিন্তু প্রিয়াংশুর ছিল। অনেকে ছিল।
তারও অনেকদিন পরে গোরা নকশাল জানতে
পেরেছিল সেদিন ভোরে যখন প্রিয়াংশুর খুলি ছিটকে পড়ছে দেওয়ালের আর এক দিকে। ঠিক তখনি
মিনিট পাঁচের দূরত্ত্বের সেলে জন্ম নিচ্ছে তার মেয়ে আনন্দি। লেকের মাঠে সকালে
প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে এক অবসর প্রাপ্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পুলিশকে ফোন করে জানাচ্ছে
“খুলিহীন এক মৃত দেহ লেকের জলে ভাসছে।” তিনদিনের বাসি পচা গলা দেহকে প্রিয়াংশু বলে
সনাক্ত করে আনন্দির মা প্রিয়াংশুর বউ অমিয়া। কোথাও কোনো প্রমান ছিল না এতোদিন প্রিয়াংশু
জেলে ছিল না বাইরে। সেদিন ভোরে কী বলতে চেয়েছিল প্রিয়াংশু? শীত করতে থাকে গোরা
নকশালের। জীবনের, পরম প্রাণের উষ্ণতাটুকু নেওয়ার জন্য প্রানপণে জড়িয়ে ধরে ঘুমন্ত
টুকনুকে। প্রিয়াংশু সেদিন কী বলেছিল টুকনু জানিস...? গোরা নকশাল আকাশের দিকে মাথা
তোলে। তার চোখের কোন থেকে বেরিয়ে আসে একবিন্দু জলের ধারা। সুশান্তকে পুলিশ উঠিয়ে
নিয়ে যাওয়ার জন্য তার এই দুঃখ নাকি প্রিয়াংশুর জন্য...? এই মুহূর্তে লেখক তা জানে
না। লেখকের সব কিছু জানা থাকে না। কেউ তাকে জানিয়ে দিয়ে যায় বারবার।
ঘুমন্ত ছেলের কপালের ওপরের চুল গুলো
সরাতে সরাতে গোরা নকশাল বিড় বিড় করে...প্রিয়াংশু অমিয়াকে নিয়ে ঘর করতে
চেয়েছিল...প্রিয়াংশু দেখতে চেয়েছিল আনন্দির মুখ...প্রিয়াংশু দেখতে চেয়েছিল সবাই
দুবেলা পাবে দুমুঠো ভাত...সবাই পাবে পরার কাপড়...মাথা গোঁজার ঠাই...শিক্ষার
প্রাথমিক অধিকারটুকু...। প্রিয়াংশু দেখে যেতে পারেনি...প্রিয়াংশুকে আমরা উপহার
দিয়েছে এক খুলি বুলেট। গোরা নকশালের চোখের টিপ টিপ জল টুকনুর কপালে বৃষ্টির ধারার
মতো ঝরে পড়ে। ওখানেই যেন কোথায় লিখে রাখা হয়ে যায় টুকনুর ভবিষ্যতের ললাট লিখন...
“দিনের পর দিন রক্তের সমুদ্রে
সাঁতরিয়ে মানুষ জেনেছে/ভালোবাসার আরেক নাম ঘৃণা;/ রাতের পর রাত স্পর্ধার পাহাড়ে
আছাড় খেতে খেতে সে জেনেছে,/ ভালোবাসার আর এক নাম প্রতিবাদ”...। (ক্রমশ)
ঋণ
নির্বাচিত কবিতা/বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়/দেজ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন