গোরা নকশাল (দুই)
গোরা নকশাল
“যাদের
সামনের পথটা অজানা...আর পেছনের পথটা বিস্মৃত...তারাই গোলকধাঁধার পথে অন্তরীণ...”
দুই
হাতে ধরা
আমার মুঠো ফোন বিপ বিপ করে বেজে ওঠে। শীতের রাত চিরে ছুটছে সেদিনের শেষ ডানকুনি
লোকাল...আমি ছুটছি বাড়ি...সারাদিন আমাকে ক্লান্ত করে রেখেছে কয়েকটা
মিটিং...সারাদিন ক্লান্ত আমি না করা কাজের চাপে। মুঠোফোন বেজে যায়। ওপার থেকে ভেসে
আসে খুব কাছের এক বন্ধুর গলা...
“হাতে কিছু
কাজ আছে?”
মানে?
“না...কোনো
কিছু করছিস কি এখন?”
বাড়ি
যাচ্ছি...।
“উফ...তুই
বড্ড এঁড়া টাইপের ছেলে মাইরি...জানতে চাইছি এখন ব্যাস্ততা কেমন?”
কেনো বলতো?
“শোন...ওই
যে তোর একটা ছোট লেখা বেরিয়েছিলো না...।”
ফিল্মের
রিভিউ?
“উফ
না...না...।
মেগা
সিরিয়াল?
“সেটাও
আজকাল ছাপাচ্ছিস নাকি? পাবলিক মাইরি তুই...”
কোনটা
বলতো...ঠিক বুঝতে পারছি না...আমার ব্লগে?
“সেটা আমার
মনে থাকলে তো হয়েই যেত...। ওই যে যাত্রা নিয়ে লেখার সময়...কে একজন মারা গেলেন
না...”।
শান্তি
গোপাল?
“রাইট...হ্যাঁ
হ্যাঁ...। ওই লেখাটা।”
তোর চাই?
“না। শোন
আগে কথাটা...ওই লেখাটাতে... খুব ছোট করে লিখেছিলিস...ওই যে তোর কাকা না কে...নকশাল
নকশাল...!”
গোরা নকশাল?
“হ্যাঁ...হ্যাঁ...একদম
ঠিক...শোন ওই লোকটাকে নিয়ে ছবি করতে চাই...”
ফিল্ম?
“একদম...।”
হঠাৎ? আর
কোনো সাবজেক্ট পাচ্ছিস না বুঝি?
“তোকে এতো
কিছুর জবাব দিতে পারবো না ফোনে...আর তেমন কিছু তোকে করতেও হবে না। শুধু নিজের মতো
করে লিখে যেতে হবে।”
লিখে যেতে
হবে মানে?
“আরে একটা
পার্সোনাল জার্নি...সহজে কিছু বোঝানো যায় না তোকে”।
গোরা
নকশালকে নিয়ে?
“রাইট...বেঁচে
আছে না লোকটা এখোনো?”
হ্যাঁ...মানে...না...মানে...
“কী মানে
মানে করছিস?”
আসলে সবটা
সত্যি নয়...।
মানে?
মানে ওটা
একটা গল্প...কিছু মানুষের...। যাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ছিলো দেশ ভাগ... যারা
ভেবেছিলো আবার একদিন তারা ফিরে যেতে পারবে নিজের দেশে...নিজের গ্রামে...। কিন্তু
হয়নি...। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের নায্য দাবীতে যারা একসময় পথে নেমে ছিল...যাদের
কাছে বেঁচে থাকাটা পুরোটাই স্বপ্ন আর স্মৃতি...
“থাক...থাক...পলিটিকাল
এজেন্ডা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিস তো..এর মধ্যে গোরা নকশাল কোথায়...?”
আছে...।
“স্বপ্নে না
স্মৃতিতে?”
সিনেমায়...।
“লিখবি?
সত্যি তুই লিখবি আমার জন্য?”
হ্যাঁ...।
ফোন কেটে
যায়। বালী বিজ্রের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে আমার
চোখে মুখে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমাদের লোড শেডিং এর দিন গুলোয়...ফিরে যাচ্ছি সেই
বয়েসটায় যেখানে বড় হওয়ার বড্ড তাড়া ছিলো। মা থার্মোমিটারটা আমার মুখ থেকে নিয়ে
নিচ্ছে...। একটু হাসছে...। জ্বর আর নেই...। তিনদিনের পরে আমার তপ্ত গা ঠান্ডা হয়।
সারা রাত জাগা মায়ের মুখটা অনেকদিন পরে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ট্রেন থেকে নেমে আমি
বাড়ি যাই। আর ওদিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হয় গোরা নকশালকে। এক
মাঘের শীতের রাতে, জমকালো আঁধারে। খোঁড়াতে
খোঁড়াতে গোরা নকশাল এসে বসে খেয়া ঘাটে। যেখানে মাঝিরা শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন
জ্বা্লিয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে সবাই। বুড়ো শিব প্রামানিক সেই আগুন আলোর
ধোঁওয়ার মধ্যে গোরা নকশালকে ঠিক চিনে নেয়। গোরা না? হ্যাঁ তাই তো...। কবে এলো এই
মানুষটা? কবে ছাড়া পেলো? সেই যে একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে লোকটাকে নদী পার করে
দিয়েছিলো শিব...। তারপর আর দেখেনি কোনোদিন। শুনেছিলো জেলে আছে। পচছে। এর মধ্যে
কতকি তো ঘটে গেলো। কত কচি কচি ছেলের লাশ গঙ্গা দিয়ে ভাসতে দেখলো শিব। কংগ্রেস
গেলো...যুক্ত ফ্রন্ট এলো...আবার কংগ্রেস...। এখন আবার লাল পার্টি এসেছে। শিব একবার
লরি করে ময়দানে গিয়েছিল। বিশাল জমায়েত দূর থেকে অনেক উঁচু মাঁচার ওপর এক লোককে
দেখেছিল শিব। বেঁটে খাটো চশমা পরা লোকটা নাকি এবারের মুখ্যমন্ত্রী। গরীবের বন্ধু...।
“হাঁ গা...লোকটার নাম কী?” রুটি ভেলিগুড় দেওয়া অল্প বয়স্ক ছেলেটা তাকিয়ে ছিল এক
মুহূর্ত তার অনেক পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে। “উনি কমরেড জ্যোতি বসু।” শিব অনেক দূর
থেকে গরীবের বন্ধুকে দেখেছিল। সব কথা বুঝতে পারেনি সেদিন...। শিব সব কথা বুঝতে
পারে না। আবার আগের মতো গঙ্গায় মাছ এলেই হয়...। ইলিশের মরশুমে তেমন তো মাছ উঠলো
না...। বউটা অসুস্থ, ছেলেটার জুটমিলে কিসব গন্ডগোল শুরু হয়েছে। খুব টাকার দরকার
শিবের।
গোরা নকশাল নদীর
রাস্তার দিকে তাকায়। একদল মানুষ গোল হয়ে বসে আগুন পোহায়। সেই কবে থেকে যেন মানুষ
এমন করেই আগুনের ধারে বসে আছে। সেই কবে মানুষ জোট বদ্ধ হলো। তাদের নিজেদের কথা নিজেরাই
গুছিয়ে বললো। ভাবতে গেলে মাথা টনটন করে গোরা নকশালের। কতদিন পরে সে জেলের বাইরে পা
রাখলো। গল্প শুনতে ভালো লাগে তার। মানুষ গুলোর মাঝে এসে বসে। আগুনের সামনে। খোলা
আকাশের দিকে তাকায়। অনেক দিন পর সে রাত দেখছে...অনেক দিন পর সে ঠান্ডা বাতাসে।
অনেকদিন পর সে মানুষের ঘামের গন্ধ শুঁকছে। অনেকদিন পর সে বুঝতে পেরেছে...আসলে সব
কিছু পাল্টে দেওয়া যায় না। সব কিছু পালটে দিতে দেয় না মানুষ।
হাঁটু মুড়ে
বসতে পারে না গোরা। শিব এগিয়ে এসে ভাঙা একটা টুল এগিয়ে দেয়। শিব বলে “চিনতে পারছেন
কত্তা?” গোরার চোখ চিক চিক করে ওঠে। শিব নৌকা বাইছে...আর পেছনে পুলিশের লঞ্চ...।
গোরা কি ঝাঁপ দিয়েছিলো জলে? নাকি শিব পার করে দিয়েছিলো তাকে? গোরা মনে করার চেষ্টা
করে। পারে না। অনেক কিছু মনে নেই তার। অনেক কিছু ভুলে গেছে। মাথায় ওরা লোহার বাঁট
দিয়ে মারতো...। মাথাটা নীচের দিকে করে পাটা ঝুলিয়ে দিতো...। চোখের সামনে জ্বেলে
দিতো একটা বাল্ব...। চোখের সামনে সেই উজ্জ্বল ধাঁধার নির্যাতিত আলোতে গোরা নকশাল
দেখতে পেতো খুলনার প্রাথমিক স্কুলটাকে...গোরা নকশাল দেখতে পেতো একুশে ফেব্রুয়ারীর
অলৌকিক ভোর...। গোরা নকশাল দেখতো স্বাধীন বাংলা দেশ। গোরা নকশাল শুনতে পেতো “তোর
পিঠে কাঁটা তারের দাগ”। এক উদ্বাস্তু নকশাল হয়েছে বলে পুলিশ গুলো হাসাহাসি করতো।
গোরা নকশাল অজ্ঞান হয়ে যেত। পাশের পুলিশ অফিসারের কাঁচা কাঁচা খিস্তি তার আর কানে
এসে পৌঁছোতো না...। গোরা নকশাল অন্ধকারের মধ্যে শুধু টপকাতে থাকতো একের পর এক
মাঠ...। পালটে দিতে হবে সব কিছু। ওই সব হারানো মানুষগুলোর সব কিছু ফেরত দিতে হবে।
দেশ...কাল...স্বাধীনতা...অধিকার...। বাঁচার অধিকার। ঝোলার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতো পিস্তল...।
আর গোরা নকশাল হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত...বারবার...। কিছুতেই পেরোতে পারতো না অন্ধকার সেই
মাঠটা। যে মাঠটার উলটো দিকেই আস্তে আস্তে ভোরের আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। ওখান থেকেই
দিনের প্রথম আগুন রঙা সূর্য উঠবে।
শিব প্রামানিক এসে দেখে
গোরা নকশাল ঘুমিয়ে পড়েছে টুলে বসেই। একটা মানুষ কেমন ছিলো আর কি হয়েছে। তাগড়া
মানুষটার সমস্ত শরীর যেন চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে কেউ এই এতগুলো বছরে। শিব নৌকো থেকে নিয়ে
আসে একটা ছেঁড়া কাঁথা। গোরা নকশালের গায়ে চাপিয়ে দেয়। ঘুমোক। জেলে কি ঘুম হয়? তাও
তো ওর লাশটা অনেকের মতো গঙ্গা দিয়ে ভেসে যায়নি। অনেকের মতো বৈঠা দিয়ে ঠেলে ফেলে
দিতে হয়নি জলে, কুকুরে খাওয়া সেই সমত্ত ছেলেটার লাশটার মতো। “ঘুমোও কত্তা...ঘুমোও।
কাল সকালে তোমায় দিয়ে আসবোনি তোমার বাবার বাড়ি।” সকালে উঠে শিব দেখেছিলো গোরা
নকশাল আর সেখানে নেই। প্রথম সূর্যের আলোয় পড়েছিল ভাঙা টুলটা। গতরাতের ছেঁড়া কাঁথা
আর অল্প অল্প ধোঁওয়া ওঠা আগুনের শেষ আঁচটুকু। গোরা নকশাল সেই অলৌকিক ভোরে আসতে
আসতে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলেছিল রবি মাষ্টারের বাড়ির। নিজের বাড়ি বলে ভুল করে ঢুকে
পড়েছিলো সে।
ভুল করে
ঢুকে পড়েছিলো? নাকি গোরা নকশাল খুঁজতে গিয়েছিলো তার ছোটোবেলাকে...তার মাকে...ওপার
বাংলার মানুষগুলোর গায়ের গন্ধকে। যা অনেককাল আগেই জেলের ছোট্ট খুপরিতে সে হারিয়ে
ফেলেছিলো। গোরা নকশাল দেখেছিলো একটা ছোট্ট ছেলেকে। গোরা নকশাল দেখেছিলো রক্তে ধুয়ে
যাচ্ছে ধরণী। কেউ যেন কবে একটা বলেছিলো “তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের
স্বাধীনতা দেবো”। কোথাও যেন শুনেছিলো “সশস্ত্র বিপ্লবই আমাদের একমাত্র পথ”। গোরা
নকশাল ছুট্টে গিয়েছিলো ছোট্ট ছেলেটার কাছে। আঁকড়ে ধরেছিলো ছটফট করতে থাকা ছেলেটাকে।
ডাক্তার কিস্কু তার মাথায় সেলাই করেছিল। গোরা নকশালের শাদা পাঞ্জাবী ভিজে গিয়েছিলো
তাজা রক্তে। অনেক দিন পর রক্তের ঝাঁঝটা গোরা নকশালের নাকে এসে লেগেছিলো। একটা ছোট্ট
তাজা প্রানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো গোরা নকশাল। আর সেই প্রানের যাবতীয় স্পন্দন যেন
নিজের ভাঙা শরীরটার মধ্যে সঞ্চারিত করে নিচ্ছিলো সে। আর ঠিক তখনি...হ্যাঁ তখনি...
জঙ্গলের মধ্যে একটা লাল পতাকে উড়তে দেখেছিলো গোরা নকশাল। সকাল হয়ে আসছিলো। কারা
যেন গেয়ে উঠছিলো “একদিন সূর্যের ভোর...”। কারা যেন শিস দিচ্ছিলো। আর খেপা কুকুরের
মতো ঝাঁক ঝাঁক গুলি এসে লাগছিলো সতীর্থদের গায়ে। গোরা নকশাল চোখ বন্ধ করে। কোলের
মধ্যে ছেলেটা ছটফট করছে। ওখানে প্রান আছে, ওখানে ক্ষিদে আছে, ওখানে আছে অধিকার
বুঝে নেওয়ার বীজ মন্ত্র।
গোরা নকশাল
কি তাহলে আরো একবার বাঁচতে চাইছে? সেটা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সেই মুহূর্তে দেখতে
পাওয়া যাচ্ছে বড় উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে গোরা নকশালের মুখে।
কোঁকড়ানো কালো দাড়ি ভর্তি ফরসা মুখটা অমলিন হাসিতে টুকনুর দিকে তাকিয়ে আছে। টুকনু
রেগে যাচ্ছে...। টুকনু ভয় পাচ্ছে।..টুকনু চিনতে পারছে না গোরা নকশালকে...। চিনবে কী করে? তার বাবার জ্যেঠতুতো ভাইকে তো এই
প্রথম দেখলো সে। তখনও টুকনু জানে না একদিন সে গোরা নকশালকে নিয়ে ইয়াবড় একটা ‘কাল্পনিক’
গল্প ফাঁদার চেষ্টা করবে! (ক্রমশ...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন