গোরা নকশাল (চার)


গোরা নকশাল 
 
“গাছেরা ঘুমিয়ে পড়লে কি ফুলেরাও ঘুমিয়ে পড়ে?”
 
চার

খেলার মাঠে হরেক রকমের আচার নিয়ে আসে চুনু হজমিওয়ালা। তার নানারকম কাচের বয়ামের মধ্যে থাকে টক জলে চোবানো লাল কুল। মাটির ডেলার মতো লাল হজমি। তেঁতুলের আচার। বিলাতী আমড়া। কারেন্ট নুন। এগুলো প্রত্যেকটাই আমার কাছে খুব লোভনীয়। প্রত্যেকটি আমার বায়নার জিনিষ। এদের কোনো না কোনটা আমার রোজ বিকেলের সঙ্গী না হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঠিক আজ যেমন হয়েছে। ঠাম্মার কাছে পয়সা চাইতে যাওয়ার সময়ের একটু গন্ডগোল হওয়াতেই বিপত্তিটা ঘটেছে। ঠিক এমনটা হতো না, যদি না ঘুমটা আমার ঠিক চারটের সময়েই ভাঙতো। “আজ তিরিশ মিনিট লেট”। ঘুম থেকে উঠতেই দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দাদা বলে দিয়েছিল। দাদা সময়ের কাঁটা ধরে চলে। সময়ে পড়তে বসে। সময়ে খায়। সময়ে স্কুলে যায়। সময়ে ঘুমোয়। এবং সময়ে ঘুম থেকে ওঠে। ওকে সময়ের মধ্যে বসিয়ে দিয়ছে বাবা। চিনিয়ে দিয়েছে সময়ের কাজ সময়ে শেষ করার রাস্তা। দাদা খুশি মনে সময়ের নক্সীকাঁথা গায়ে দিয়ে বাবার নির্দেশ পালন করে। কারণ দাদা জানে তাকে অনেক তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে। অনেক তাড়াতাড়ি সংসারের হাল ধরতে হবে। অনেক তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলতে হবে উদ্বাস্তু তকমা!

ঠাম্মার ঘরের দিকে যেতে গিয়েই এক্কেবারে মায়ের সামনে পড়ে যাই। “রোজ রোজ পয়সা দিয়ে ওর বারোটা আর নাই বা বাজালেন!” মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঠাকুমাকে। শীতের পড়ন্ত বিকেলের অন্ধকার ঘরের কোন থেকে... ছানি না কাটা চোখের কোঠর থেকে ভেসে আসে তীব্র মমতা। “থাক না বৌমা...মোটে তো দশ আনা!” মা হার স্বীকার করে না। “ওই দশ আনাই দশ দিনে একটা টাকা! আমার এক ব্যাগ কয়লার সাশ্রয়!...হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছো কী? হয় বেরোও...না হলে হ্যারিকেন জেলে দিচ্ছি পড়তে বোসো।” অন্ধকারের কোণ থেকে ভাঙা গলায় একটি বারের জন্য যেন ঠাম্মা শেষ খড়কুটো ধরতে চায়... “আজ ওর দাদু বেঁচে থাকলে...কলাপোতার বাজারে...ভোলা ময়রার দোকানের চিট সন্দেশ এনে দিতো...”। ঝাঁঝিয়ে ওঠে মার গলা আরো। “রাখেন আপনার ওপারের কথা...শুনে শুনে কান পচে গেলো! যা যাবার তো গেছে। আমার ছেলে গুলো উচ্ছন্নে না গেলেই হলো!” কে যেন হাত ধরে আমাকে টানে। 

সবে সন্ধ্যে নামবে নামবে করছে। দেখি দাদা গলায় জড়িয়েছে একটা মোটা মাফলার। গায়ে দিয়েছে ফুল সোয়েটার। একটুতেই ওর ঠান্ডা লাগে। নাকের নীচে ঠোঁটের ওপরে কালো রেখার জমাট গম্ভীরভাব থেকে দাদা বলে “চল মাঠে যাবি চল।” ঘরের গুমোট ভাবটা নিমেষে হাওয়া হয়ে যায়। পল্টুর লাট্টুর মতো আমি পাক খেতে খেতে দাদার আগে ছুটি। “হ্যাঁরে দাদা তুই কোনোদিন চিট সন্দেশ খেয়েছিস?” দাদা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ায়। না। খায়নি ও। “ঠাম্মা বলেছে...কলাপোতার ভোলা ময়রার দোকানে চিট সন্দেশ পাওয়া যায়।” আর কথা এগোয় না আমার। একটা লম্বা মিছিল আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। “মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। ইনক্লাব...জিন্দাবাদ...ধর্মঘট চলছে চলবে...মালিক তুমি দালাল হতে পারো না...পারো না...ভাতের বদলে রক্ত চাইতে পারো না...পারো না...”। গমগম করতে থাকে রাস্তাটা। মানুষজন সব থমকে যায়। যে লোকগুলো সারা রাতের শ্রমের স্নিগ্ধ ক্লান্তিটুকু নিয়ে হাঁদার দোকানে চা খেত সেই মানুষগুলোই কেমন যেন পালটে গেছে। মায়ের মতন খিটখিটে হয়ে গেছে। বুড়ো দারোয়ানটা আমাকে দেখলে এখন আর হাসে না। তার গ্রামের গল্প করে না। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট কমলা নদীর গান শোনায় না। সারাক্ষণ ওরা জড়ো হয়ে বসে থাকে। নিজেদের মধ্যে কি শলা-পরামর্শ করে। বুড়ো বিহারীর খুনীকে না পাওয়া পর্যন্ত ওদের যেন শান্তি নেই। কারখানার গেট না খোলা পর্যন্ত ওদের উনুনে ভাত রান্না হবে না। সবাই ছাতু খেয়ে থাকবে। আমি একদিন ছাতু খেয়ে দেখেছি। ভালো লাগেনি তেমন। গোল গোল দলা পাকিয়ে ওরা একটু একটু ছাতু খায়। মন ভালো ভালো থাকলে গুণগুণ করে গান গায়। এখন ওসবের পাট উঠে গেছে। সারাক্ষণ কারখানার সামনে একটা ভাঙা তক্তপোষে ওরা বসে থাকে। আর আশায় থাকে কবে মালিক এসে ওদের সাথে কথা বলবে। কবে ওরা ওদের ন্যায্য টাকা পাবে। কবে ওদের লিডারের খুনী ধরা পড়বে। কিন্তু তেমন কিছুই হয় না। দিন এগোতে থাকে।  

চটকলের ধর্মঘট আজ কুড়ি দিনে পড়লো। এগুলো আমার জানার কথা নয়। ছোটদের সব কিছু জানতে দিতে নেই বলে বাড়ির বড়দের যে ফতোয়া জারী হয় তাতে তারা বুঝতে পারে না পরোক্ষভাবে এতে ছোটদের লাভ হয় বেশী। তারা লুকিয়ে হোক...ঘুমিয়ে থাকার ভান করেই হোক...কিম্বা অন্য কোনো উপায়ে শুনে নেয় সব কিছু। বুঝুক আর নাই বুঝুক নিষিদ্ধ যাবতীয় জিনিসের প্রতি তাদের তীব্র টান। যে টানের জন্য টুকনু অনেক ছোট থেকে জেনে যায় অনেক কিছু। তাকে তো জানতেই হবে। ছোট থেকেই সে ঠিক করে ফেলেছে একদিন এই সব নিষিদ্ধ জিনিস নিয়েই সে লিখবে “নিষিদ্ধ এক ইস্তেহার...”। যেখানে থাকবে শুধু তার লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প শোনার কথা। আর না বলা দুষ্টুমির অঙ্ক গুলো। যদিও অঙ্কে সে প্রচন্ড কাঁচা। উলটো একে চন্দ্র লিখতে তাকে হিমসিম খেতে হয়। নামতা মুখোস্থ হতে চায় না। সেই সুযোগটার সদ ব্যবহার করতে চায় দাদা। “ভাই মিছিলে কটা লোক গোন তো। এই সামনে সারির টা গুনলেই হবে।” অতি চালাকের গলায় দড়ি দিয়ে আমিও গুনতে থাকি। তিরিশের পর খেই হারিয়ে যায়। দাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ফাস্ট হওয়া দাদা বলে ওঠে “পঁয়ষট্টি জন”।

বড় মিছিলটা সরে যেতেই মিছিলের প্রান্তে যে মানুষটাকে দেখতে পেলাম তাকে সেখানে তখনি দেখতে পাবো বলে আশা করিনি। আমার ছোট ছোট পা...আর ছোট্ট একটা মন ছুট্টে গেলো লোকটার কাছে। সেও হাত বাড়িয়ে ধরলো আমাকে! “জানো গোরা নকশাল...ঠাম্মা বলেছে কলাপোতার ভোলা ময়রার দোকানে চিট সন্দেশ ছিল...”। লোকটার কালো দাড়ির মধ্যে একটা হাসির তরঙ্গ ওঠে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে। দাদার থেকে একটু বড়। একে তো আগে কোনোদিন দেখিনি! চশমার ভেতর থেকে বড় বড় গোল গোল চোখ করে বলে “ আপনাকে নাম ধরে ডাকছে কমরেড!” ওরা দুজনেই হেসে ওঠে! আমার রাগ হয় গোরা নকশালের ওপর। চলে যেতে গেলে আমার হাত ধরে টানে ছেলেটা। “এই বুঝি আপনার টুকনু...? চে’র ছবিকে যে বলেছিল আপনার ভাই?” গোরা নকশাল হাসে। আমার রাগ আরো বেড়ে যায়। ইশ...আমার কথা গুলো আবার এই একদম কোনোদিন না দেখা একটা ছেলেকে বলে দিয়েছে? আমি আর দাঁড়াতে চাই না। ছেলেটাও আমাকে ছাড়ে না। “এই যে কমরেড টুকনু...তুমি কী জানো আজ থেকে আমি তোমাদের বাড়িতে থাকবো?” ধাক্কাটা খেতাম না। কিন্তু সত্যি যখন দেখলাম ছেলেটা আমাদের সাথে বসেই রুটি আর পেঁয়াজকলি ভাজা খাচ্ছে। খেজুরের গুড় হ্যাংলার মতো চেটে চেটে খাচ্ছে তখন রাগটা বেমক্কা গিয়ে পড়লো গোরা নকশালের ওপর। আমার পেঁয়াজকলি। আমার খেজুড়ের গুড়ে আমি কাউকে ভাগ বসাতে দেবো না। সে তুমি যতোই সাম্যবাদের কথা বলো না কেনো। কেউ আমার দিকে তাকায় না। বলে না... “আহা টুকনুর পাতে একটুও পেঁয়াজকলি নেই...ওকে একটু দাও...”। সবাই ছেলেটার সাথে কথা বলে। “শুনেছি এবার উচ্চমাধ্যমিকে স্টার নিয়ে পাশ করেছো?” মা বেশি করে পেঁয়াজ কলি তুলে দেয় ছেলেটার থালায়। আমার কান্না পায়। কিন্তু কে তাকায় আমার দিকে। বাবা বলে “পাশ কী বলছো? সোনার টুকরো ছেলে সুশান্ত! প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়তে চায় ভবিষ্যতে।” ছেলেটা লজ্জা পায়। মাথা নীচু করে থাকে। কিন্তু খাওয়াতে লজ্জা নেই। একবার তো না বল। একবার তো পেঁয়াজকলির থালাটা আমার দিকে আসুক। ছিঃ ছিঃ...এই নাকি হীরের টুকরো ছেলে। যা দিয়ে যাচ্ছে খেয়ে যাচ্ছে। ওরে না তো একবার বল। সব শেষ হয়ে গেল। “গোরার কে হও তুমি?” ঠাকুমার প্রশ্নের জবাবে এই প্রথম মাথা তুলে তাকায় সুশান্ত। “বন্ধু বলতে পারেন...! আমাদের কমরেড গোরা...।”

“অতবড় লোকটা তোমার বন্ধু কী গো?” ঠাকুমা তল পায় না। ছেলেটা বলার আগেই বাবা বলে ওঠে “ওর বাবাকেও জেলে থাকতে হয়েছিল গোরার সাথে অনেকদিন মা...আর জেলেই ওর বাবা মারা যান।” হঠাৎই নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে। ঠাম্মা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। “আহা রে...”। রাগের চোটেই হোক। দুঃখেই হোক। জেনেই হোক বা না নেজেই আমার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায়। ভিজে যায় পাশে বসা হাঁদার রুটি। জল গড়িয়ে আসন ভিজিয়ে দেয় ছেলেটার। মা মারতে উঠলে ছেলেটাই ঠেকায়। “ছোটদের মারবেন না। ওদের মারতে নেই।” মা থমকে যায়। এতো এক্কেবারে গোরা নকশালের মতো কথা বলে। আজ অবশ্য দেখেছি জুটমিলের সামনে বড় জমায়েতে কিসব বোঝাচ্ছিল ছেলেটা শ্রমিকদের। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল ছিপছিপে চশমা পড়া বছর ঊনিশের ছেলেটার কথা।

লেপের শুয়ে তলায় মন খারাপ করা রাগ নিয়ে জানতে চাই... “দাদা...ছেলেটা কতদিন থাকবে রে?” দাদা আমার দিকে পাশ ফিরে শোয়। গায়ের ওপর লেপটা ঠিক করে দেয়। আমার চোখের ওপর পড়ে থাকা লম্বা চুলটা সরিয়ে দিয়ে বলে “চলে যাবে কালকে।” “গোরা নকশালের কাছে এসেছে আমাদের বাড়ি খাচ্ছে কেন?...থাকছে কেনো?” দাদা আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না। বিড়বিড় করে বলে “প্রেসিডেন্সি কলেজ কোথায় জানিস ভাই?” আমি মাথা নাড়াই “না”। “অনেক বড় কলেজ। অনেক বড় বারান্দা। সেই ব্রিটিশ আমলের। যারা খুব খুব ভালো পড়াশোনায়...তারা ওখানে পড়তে যায়।”
“তোকে কে বলেছে?”
“গোরা নকশাল। ...আরও বলেছে...আমি যদি সত্যি সত্যি খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারি মাধ্যমিকে...উচ্চ মাধ্যমিকে...তাহলে আমি নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে পারবো।”
দাদা পাশ ফিরে শোয়। আমি জানি এখন ও কলকাতার বড় কলেজের স্বপ্ন দেখবে। প্রেসিডেন্সি কলেজের লম্বা বারান্দার ওপর দিয়ে হাঁটছে। ক্লাস করছে। কাল ভোরে উঠে আবার অঙ্ক কষতে বসবে। নকশালকে দানা খাওয়াবে। স্নান করাবে। দাদা নকশালকে ভালোবাসে। কিন্তু দাদা জানে না আসলে নকশাল হল পায়রাদের টাইটেল। “যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল”। হাঁদা আমাকে বলেছিল। সেইবার নকশাল প্রথম এসেছিল আমাদের বাসায়। হাঁদা হাতে করে দানা খাওয়াতো আর বলতো... “সময়ের সাক্ষী থাকবি তুই নকশাল...যেখানে পারবি উড়ে বেড়াবি...আমি তোর ডানার পালক কেটে দেবো না কোনোদিন”। হাঁদা কোনোদিন পালক কাটেনি নকশালের। নকশাল এখানে ওখানে উড়ে বেড়ায়। ক্ষিদে পেলে নেমে আসে উঠোনে। ঘুরে ঘুরে দানা খায়। বাড়ির সবাই ভালোবাসে নকশালকে। শুধু আমি ছাড়া। তক্কে তক্কে থাকি...কোনদিন এসে হুলোটা ওর ঘাড় মটকাবে। ঠিক হবে।
বাইরে এই এতো রাতে কারা যেন কথা বলছে। বাবা না? এখনি ঘুমোতে যায়নি বাবা? উত্তরের হাওয়ার মতোই আমার কানে কথা গুলো ভেসে আসতে থাকে।
“গোরা এগুলো কি ঠিক হচ্ছে? সুশান্ত ওই টুকুনি ছেলে... ফুলের মতো ওরা... বোঝেটাই বা কী? এখন ওদের পড়ার সময়...নিজের মতো সুশান্তর জীবনটাও তুই কি চাস জেলের পেছনে কাটুক? কিম্বা গুম হয়ে যাক? ...”
গোরা নকশাল উত্তর দেয় না। তার চোখ তখন রবিদার বাড়ির পাশে ফোটা সন্ধ্যামণি গাছটার দিকে। গাঢ় সবুজ রঙের পাতার পাশে থোকা থোকা লাল ফুটিয়ে রেখেছে গাছটা। হঠাৎ গোরা নকশাল বলে ওঠে...
“গাছেরা ঘুমিয়ে পড়লে কি ফুলেরাও ঘুমিয়ে পড়ে রবিদা?”

বাবা কোনো জবাব দিয়েছিল কিনা টুকনু জানে না। কারণ টুকনু তখন ঘুমের মধ্যে চলে গিয়েছে ঠাকুমার খুলনার কলাপোতার গ্রামে। ভোলা ময়রার দোকানটা খুঁজছে টুকনু। ওখানে নাকি ভালো চিট সন্দেশ পাওয়া যায়। (ক্রমশ)

ছবি সৌজন্য- গুগুল ইমেজ

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি