চাঁদের পাহাড়



বন্ধুদের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না তিনি। খাটো ধুতি, পাঞ্জাবী আর রঙচটে একটা ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মানুষটি। মাথায় জবজবে করে তেল। পরিপাটি চুল আঁচড়ানো। স্বভাব ভাবুক মানুষটি লেখেন। লেখাতে বেশ নাম ডাক। তবুও ছবি করিয়ে বন্ধু সাহিত্যিকরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়ে না। এই লেখক শুধু উপন্যাস ছোট গল্প এই সবই লেখেন না। সারাদিন টো টো করে ঘুরে, কলেজ পাড়ায় গিয়ে বইয়ের তাগাদা দিয়ে, ছাত্রের বাড়িতে বসে অনেকক্ষণ পড়িয়ে মেসে ফিরে এসে ছাদের এক প্রান্তে কখোনো বা নিজের একলা ঘরের কোণটিতে বসে লেখেন দিনলিপি। সেটাও কি প্রকাশক হাতছাড়া করে? মাথাখারাপ? লেখকের বাজারে বেশ কাটতি! ছাপিয়ে দেয় সবকিছু। ভাগ্যিস ছাপিয়েছিল। না হলে আমরা অন্য এক বিভূতিভূষণকে চিনতাম কী করে? ইচ্ছামতীর পাড়ে বসে কিম্বা গ্রামের পুকুরে স্নান করতে নেমে হঠাৎই নজর পড়ে কলমী ফুলের দিকে। তাকে নিয়েই তৈরী হয়ে যায় গোটা একটা অধ্যায়। কিম্বা অনেক দিন পর জনহীন বাড়িতে ঢোকার মুখে দরজার পাশে উল্টোনো একটা ভাঙা কড়া দেখে মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। সেই ছেলে যখন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে বসে, লাইটহাউজে ছবি দেখে, বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ে একটা ভিন দেশে পাড়ি দেয় তার নিজস্ব কল্পলোকে তখন কোথাও একটা তীব্র আকূতি আমার মনের মাঝেও ছলাৎ করে ওঠে। পুজোর নতুন জামা-কাপড়ের সাথে তাই সেই কবে সিপিয়া টোনের ছোটবেলাতে বাবার হাতে দেখতে পাই ‘চাঁদের পাহাড়’। দাদা সবে পাওয়া নতুন চশমা পরে লোডশেডিং এর সন্ধ্যেবেলায় গড়গড় করে পড়ে চলে শঙ্করের এক পলকহীন ঊর্ধশ্বাস বিশ্বভ্রমণের কাহিনী। হাঁ করে চেয়ে থাকি দাদার দিকে। সেই আলো আঁধারের রূপরেখায় দাদাকে মনে হয় শঙ্কর। আমাদের বালীর দশফুট বাই বারোফুটের বাসা তখন আফ্রিকার ঘন জঙ্গল।

এর অনেক পরে অর্ধেক গোঁফ যখন পক্ক। জীবন যখন এক্কাদোক্কা খেলে বুঝিয়ে দিয়েছে মানুষের প্রতি “বিশ্বাস” একটা টাইটেল হতে পারে আর অবিশ্বাসই একমাত্র পুঁজি ঠিক তখনি আমার এক প্রাণের বন্ধু দেবালয় খবর দিল... “জানিস চাঁদের পাহাড় ছবি হচ্ছে”। আমাদের জলসা মুভিজের ছোট্ট কাঁচের ঘরটা যাকে আমরা এ্যাকোরিয়াম বলতাম (হয়তো এখোনো বলা হয়) সেখানে নেমে এল আড্ডার এক নতুন সূত্র। নানাজন আমরা নানা কথায় ভরিয়ে তুললাম। প্রমো আর কনটেন্ট লেখা মাথায় উঠলো। শীতের এক বেড়াজালে আমরা মজলাম সবাই বিভূতিভূষণে।

তারও অনেক পরে। ডিসেম্বরের ঢাকা। নেহাতই অন্যান্যবারের মতো শান্ত নয়। সমীহীন নয়। বরং তপ্ত...চারিদিকে পুলিশ...র‍্যাব। তার মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে আমার রিক্সা। যাচ্ছি চিত্রনাট্যের কর্মশালায়। অনেক তরুণ...অনেক উচ্ছল ভাবুক মানুষ শোনাবেন দৃশ্য, চিত্রনাট্যের টুকরো অংশ...। সিরিয়াল লেখার কলা-কৌশল। হয়তো দিনের শেষে এক টুকরো দেখবো মেঘে ঢাকা তারা...ওই যে ওই অংশটা যেখানে বাবা মেয়েকে বলছে... “তোর নিশ্বাসে আজ বিষ...আজ এরা তোকে করুণা করে...আজ এই সংসারে তুই নাই বা থাকলি মা...”। বাবা-মেয়েকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি সবকিছু। টানা প্রায় আট ঘন্টার ক্লাস। দেবালয় আসতে আরও দু-দিন বাঁকি। ধানমণ্ডি তিন থেকে যাচ্ছি সুগন্ধা। উড়ছি হাওয়ায়...অন্য কিছুর জন্য নয়...কিছুক্ষণ আগেই ব্লগে লিখেছি “আমার বন্ধু বিভূতিভূষণ” মনটা আজ বড্ড ভালো। ক্লাসের শুরুতে যা হবার ছিল তা হল না। কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। ক্লাসের অনেকেই ব্লগের লেখাটা ইতিমধ্যে পড়েছে। আমরা অনেকটা সময় চাঁদের পাহাড় নিয়ে কাটালাম। কারণ সবে ইউ টিউবে মুক্তি পেয়েছে চাঁদের পাহাড়ের ট্রেলার। আর সবে আমার পড়ুয়ারা শিখছে চিত্রনাট্যের কলা-কৌশল।

তারও একমাস পরে ঢাকার রাস্তায় সেই একই পথে ফিরতে ফিরতে যখন খবর পাই ছবিটা হাউজফুল হয়েছে তিনদিন অবাক হয়নি একটুও। হয়নি একটা লোকের জন্য। যে লোকটা কলমী ফুলের ওপর নরম আলো দেখে একটা অধ্যায় লিখে ফেলেছিল। যার মধ্যে শাহুরিক কপটতা ভিড় করেনি। যাঁকে জোর করে লিখবো বলে লিখতে হয়নি কোনোদিন। যাকে সবাই নিয়ে হাসাহাসি করতো। যিনি বড় অভিমানে বলতেন, “আমার উপন্যাস নিয়ে ছবি করবে কে?...টালিগঞ্জের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে পারবো না।” সেই লোকটা ১৯৫৫ সাল থেকে একের এক ম্যাজিক দেখিয়ে যাচ্ছেন। হ্যাঁ মৃত্যুর পরেও। দেখে যেতে পারেননি পথের পাঁচালীর বিশ্বজোড়া সাফল্য। কিম্বা দুহাজার তেরোতে চাঁদের পাহাড়ের জন্য টিকিটের মারামারি। ঢাকা থেকে ফিরে হন্যে হয়ে বসে থেকেছি টিকিটের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জানতে চেয়েছে স্যার দেখেছেন? বন্ধুরা জানতে চেয়েছে। বাড়ির ছোট্ট বন্ধু আমার এগারো বছরের ভাইঝি শ্রী বলেছে “কাকু তুমি যাবে না?” বেচারার পরীক্ষা তাই পরের সপ্তাহে যাবে। আমি শুধু টিকিটের জন্য হা পিত্যেশ করে বসেছি। আর টিকিট বিক্রির সূচক বলছে গত সাত বছরে এই হারে এই কয়েকদিনে এতো টিকিট বিক্রি হয়নি বাংলা ছবির জন্য।

এবার সরাসরি অন্য কথা বলি। চাঁদের পাহাড় ছবিটি আমার ভালো লাগেনি। এই ছবির চিত্রনাট্য বড় দুর্বল। থার্ডপার্সন যদি গল্পের কথক হয় তাহলে চিত্রনাট্য দাবী করে অন্যভাবে ছবি শুরুর। অন্য আরো সব ডিটেলিং এর দিকে নাই বা গেলাম। শুনলাম এই ছবি পোষ্ট প্রোডাক্সানের জন্য একমাসও সময় পায়নি। সম্পাদনা সারতে হয়েছে মোটে দু-সপ্তাহের মধ্যে। সাউন্ড ডিজাইন ঠিক মতো করা যায়নি। খামতি নিয়েই মুক্তি দিতে হয়েছে কারণ এই সময়টা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইছিলেন না প্রযোজক পরিবেশকরা। শীতের ছুটি বাঙালীদের কাছে একটা উৎসব। সেই উৎসবে মুক্তি পাচ্ছে প্রায় পনেরো কোটি টাকার চাঁদের পাহাড়। মন্দ কী? স্পেক্টাকলের জগতে নাই বা থাকলো শঙ্করের তথা কথিত ক্রাইসিস। সে না হয় একটু দেবের মতো বাংলা বললো। কিন্তু দুঃসাহসের লগ্নি আর হিন্দি ছবিকে রুখে দেবার মানসিকতা নিয়ে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁদের সাহসকে কুর্নিশ দিতে হয়। সাধুবাদ জানাতে হয় কললেশ্বরকেও।

এর আগে এর থেকেও খারাপ বি গ্রেডের অনেক হলিউড এবং বলিউড ছবি দেখে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন কিম্বা তোলেননি বেশ কয়েক দশক যাবৎ। এবার না হয় আমাদের ভাঙাচোরা, পলেস্তারা খসা টালিগঞ্জের ছবি দেখে হাততালি দিন। সমালোচনা করুন। কটুক্তি করুন। পেছন ফিরে বক দেখান। ঠান্ডা সেমিনার ঘরে সাদা চামড়া কালো চামড়ার দ্বন্দ্ব সমাস নিয়ে আলোড়ন তুলুন। কিন্তু প্লিজ ছবিটা দেখতে যেতে কাউকে বারণ করবেন না। এমনিতে পশ্চিমবঙ্গের ছবি শিল্প ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা। টেলিভিশন শিল্পের অনেক কিছুই বন্ধের মুখে। ঠিক সেই সময়ে পনেরো কোটির লগ্নি একটা বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় অনেককে। বিগলিত হবেন না। আবার মোহে পড়ে ভালো কথাও বলবেন না। ছবিটা দেখতে যান। হ্যাঁ বিচক্ষণ বোদ্ধা, তাত্ত্বিক মানুষ, সেমিনার ঘুরে বেড়ানো বক্তা তাঁরা ফেসবুক ফাটিয়ে দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে গেল গেল ভাব উঠেছে বাংলা সংস্কৃতির। তাদের কাছে বিনীত প্রণিপাত। সার্কাস ভেবেই দেখুন। কিন্তু দেখুন। না দেখার জন্য হিংসুটে হবেন না প্লিজ। কারণ আমরা সবাই জানি...আমাদের মেমোরিজ আন্ডারডেভালপমেন্টের কথা। তেমন খোঁচাও কি খেতে হয়নি সেই মাথায় জ্যাবজেবে তেল দেওয়া খাটো ধুতি পড়া লোকটাকে? বন্ধুরা হিংসে করতে ছাড়েনি। পারলে দু-কথা শুনিয়েও দিত। নানান দিকের সলুক সন্ধান নিয়ে লিখেছিলেন রুশতী সেন। বেরিয়েছে অনেক দিন আগে আমাদের বাংলা একাডেমি থেকে। পারলে পড়বেন। আর মিলিয়ে নেবেন যতবার লাঞ্ছিত করেছিল একটা লোককে তার নামজাদা বন্ধুরা তাদের আত্মারাও এখন কোথায় মুখ লুকোবে ঠিক করতে পারছে না। হল থেকে বেরিয়ে আসা পুঁচকে পুঁচকে ছেলে মেয়ে গুলোর সেই আনন্দময় উজ্বল মুখগুলো যে কতদিন পরে দেখলাম। কতদিন পর যে তারা সবাই মিলে বাবা মার সাথে বাংলা ছবি দেখতে গেছে। দিন তারিখের হিসেব গুলিয়ে বাবা মারাও ঠিক করতে পারছেন না। তাদের বাচ্চাদের কাছে নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে তাঁরা জেরবার। ছোটদের কাছে হয়তো এই এ্যাডভেঞ্চারটাই আসল। না হলে কোনো একটা ছোট্ট ছেলে তার দিদিকে কেন বলে আমার শঙ্করের মতো টুপি চাই। কিম্বা ভিড়ের মধ্যে নামতে নামতে সামনের পুঁচকেটা আর এক পুঁচকেকে বলে “দেবটা কি বোকা না? অমন সাপের জায়গায় কেউ যায়?” অথবা কেনই বা ছ’বছরের কবীর সিনেমার হল থেকে বাড়ি গিয়ে বিছানার চাদর দিয়ে তাঁবু বানায়। আর কেনই বা এগারোর শ্রী উন্মুখ হয়ে থাকে কবে তার পরীক্ষা শেষ হবে। কবে সে চাঁদের পাহাড় দেখতে যাবে। এদের অনেকেরই চাঁদের পাহাড় পড়া নেই। ওরা অনেকেই হ্যারিকেনের আলোয় বসে চাঁদের পাহাড় শোনেনি। কিন্তু নিজের ঘরটাকে...কল্পনাটাকে আফ্রিকা করে তুলতে সময় নেয়নি। বাংলা ছবিতে এটা ভালো হল না খারাপ সেটা সময়ই বলুক। আপনি বরং সেই ফাঁকে ছবিটা দেখে আসুন। পারলে আনন্দ থেকে বইটাও কিনে নিন। হ্যাঁ তারা খুব যত্ন নিয়ে সেই আগের মতোই এক্কেবারে সেই প্রচ্ছদে ছাপাচ্ছে সিগনেটের বই। যে সিগনেট থেকে প্রথম বেরিয়েছিল চাঁদের পাহাড়। 
 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি