চলচ্চিত্র এবং সাহিত্য



জন্মের সূচনা লগ্নে ভাবতে হয়নি আবিষ্কর্তাদের কী হবে চলচ্চিত্র শিল্পের মাধ্যম।  ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড কাফেতে সেদিনের সেই শীতালু সান্ধ্য সভায় পৃথিবী আলোড়নকারী একটা ঘটনা ঘটে গেলেও এই শিল্পের অভিমুখ নিয়ে তক্ষুনি লোকজন যে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন তেমন মনে হয় না। সাদা পর্দার গায়ে ছবি চলতে শুরু করলো। একটা ট্রেন পর্দার মাঝ বরাবর ছুটে আসছে দর্শকের দিকে। শোনা যায় চলমান ছবির সেই আচমকা বিনোদনে অনেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। অনেকে হয়েছিলেন স্তম্ভিত। বিস্ময়ের সেই অতিরঞ্জিত তাৎক্ষণিক প্রগলভতা কাটতে সময় লেগেছিল পাশ্চাত্ত্যের মানুষের। আমাদের দেশে অবশ্য তেমনটি হয়নি বলে অনুমান এবং দাবী করেছেন প্রাজ্ঞ জনেরা। কারণ চলমান ছবি দেখার সুললিত ইতিহাস ভারতীয়দের যে মজ্জাগত। এর আগে তারা দেখেছে পটচিত্র, ছায়ানৃত্য সাদা পর্দার এফেক্টে। তবে যান্ত্রিক অনুশীলতায় নয়। পাশ্চাত্ত্যের কাছে কুর্নিশ জানিয়ে আমাদের দেশে চলমান ছবি প্রবেশ করেছিল তার সুললিত ছন্দে। সেখানেও সে সম্পূর্ণ রূপে পাশ্চাত্ত্যের অনুকরণে সাদা পর্দায় প্রতিফলিত করলো বাস্তবের প্রতিরূপায়ণ। 

লুমিয়ের ভাইরা বাস্তবের প্রতিরূপায়ণ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মানুষকে। ছবি হাঁটে। ঘুরে বেড়ায়। চোখে দেখার অননুকরনীয় ভঙ্গি তখন সাদা পর্দায়। দ্বি মাত্রিকতায় স্থান পায় ত্রি মাত্রিকের ইলিউশান। এক সাহিত্যিক লক্ষ্য করলেন খুব কাছ থেকে। ১৮৯৬ সালে চলচ্চিত্র জন্মের মাস খানেকের মধ্যেই সেই বিখ্যাত সাহিত্যিক দেখলেন ছায়া মানুষের হেঁটে চলার বৃত্তান্ত। ধূসর বর্ণের এক অতিপ্রাকৃত জগত দেখে এসে ম্যাক্সিম গোর্কি লিখলেন, “ Last night I was in the kingdom of shadows. If you only knew how strange it is to be there. It is a world without sound, without colour. Everything there-the earth, the trees, the people, the water and the air-is dipped in monotonous grey. Grey rays of sun across the grey sky, grey eyes of grey faces, and the leaves of the trees are ashen grey. It is no life, but its shadow, it is not motion but its soundless spectre…And all this in strange silence where no rumble of wheels is heard, no sound of footsteps or of speech. Nothing. Not a single note of the intricate symphony that always accompanies the movements of people.” ( life to those shadows/noel burch/page-23)

ধূসর বর্ণের এই নিদারুণ গাম্ভীর্যের ভাস্কর্য ভালো লাগেনি অনেকের। যন্ত্র সভ্যতা নিদারুণ রূপে ঢুকে পড়ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। সুজন ঘেরা মানুষরা গ্রামের শ্যামল ছায়া ছেড়ে, স্নেহ ছেড়ে, প্রেমিকার ভালোবাসার নিবিড় টানে ছেদ ঘটিয়ে চলে আসছিলেন শহরে। চাকচিক্য নানা বর্ণের শহর তখন এই অভিবাসী মানুষদের মনে রঙ ধরাবার কাজে ব্যস্ত।সস্তার মিউজিক হল, ভদেভিল, সার্কাস ছেড়ে এই মানুষগুলিই ছুটলো একটা সময়ে চলমান ছবি দেখতে। পৃথিবীর আশ্চর্যজনক আবিষ্কারের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করল নব্য শিল্পায়ণের ছোঁওয়া লাগা সেইসব মানুষ গুলো। পরবর্তী কালে চলচ্চিত্রের ইতিহাস দেখাবে এঁরাই বরাবরের জন্য হয়ে উঠলেন সিনেমার প্রকৃত সার্থক দর্শক। এঁদের ওপরেই চলবে একশো বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা শিল্পের জয়যাত্রা। এদের একত্রিত এবং সঙ্ঘবদ্ধ করতেই নানা নীরাক্ষার অবকাশ রাখবে চলচ্চিত্র। কিন্তু সেতো আরো অনেক পরের ঘটনা। রিল গোটাবার আগে রিলের ইতিহাস এখনও অনেকটাই যে পড়ে।

চলচ্চিত্রের বহু আগে সাহিত্যের সৃষ্টি। চলচ্চিত্রের যেমন একটা দিন ক্ষণ আছে। আবিষ্কারের এক নথি বদ্ধ ফাইল পাওয়া যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। কেন হয় না? সঙ্গত কারণে প্রশ্নটা মনে আসতেই পারে। আর ঠিক তখনি এই প্রশ্নটাও নিজেকে মনে মনে সেই মুহূর্তে করে ফেলা যেতে পারে কবে থেকে মানুষ গল্প বলতে শুরু করলো? উত্তর পাওয়া যায় না। এক অসীম অনন্ত নিহারিকার পথ বলে মন হয় তখন।মানুষ যেদিন আগুনের ব্যবহার শিখলো সেদিন থেকে সে সভ্য হল বলে যে পুঁথিগত দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয় তার কাছে সমীপে করজোড়ে কৃতজ্ঞ চিত্তে আনীত থাকলেও ভুলে যাওয়া উচিত নয় গুহা মানবের চিত্রিত ছবির নক্সার কথা। যে নক্সা, আঁচড়, পশুর দেহাবলি, আত্মচিত্র মানবের গল্প বলার দিকে ইঙ্গিত করে। দেখার অনুশাসন আমাদের শেখায় গল্পের যাত্রাপথকে। সেই যাত্রাপথের রাজনীতিকে। সেই তো কবেই বলে গেছেন জন বার্জার সাহেব তাঁর ‘ways of seeing’ গ্রন্থে। মানুষ গল্প বলেছে নিজের তাগিদে। নিজের অস্তিত্ত্ব পরবর্তীতে ত্বরান্বিত করতে। আগুনের পাশে জড়ো হয়ে সারাদিনের ক্লান্তিকর মুহূর্তগুলোকে অতিরঞ্জিত করে ঝরিয়ে দিয়েছে সহগামী, সহ সাথীদের সামনে। কিন্তু সেতো গেলো আমাদের অতীতচারিতা। ছাপার যন্ত্র আবিষ্কারের পরে সাহিত্যের চলশীলতা বেড়েছে। অক্ষরজ্ঞান ভরাট করেছে মধ্যবিত্তের দেরাজ। তাই তো দুপুরবেলায় আমসত্ত্ব শুকোনোর পাশেই থেকেছেন শরৎচন্দ্র তাঁর দেবদাসকে নিয়ে বাড়ির নতুন বউয়ের সাথে। কিম্বা তারও আগে কপালকুন্ডলা ঘুরে বেরিয়েছে অনন্ত রাস্তা। নিস্তার পায়নি সদ্য কলেজ ফেরত তরুণের হাত থেকে। কৃতাঞ্জলিপুটে চলচ্চিত্রও আহরণ করেছে সাহিত্যকে তবে নিতান্তই তার নিজের ভাষায়। নিজের ব্যাকরণে। আর সেখানেই লেগেছে গোল সাহিত্যের সাথে চলচ্চি্ত্রের। কিন্তু সেতো আবার অন্য আখ্যান অন্য দিকের সূচক। এক নতুন শিল্পের সাথে অনন্তকাল ধরে চলে আসা শিল্পের দন্দ্ব। সেদিকে আমাদের চোখ ফেরানো এখনি সম্ভব নয়। কারণ আমাদের হাতে সময় কম। পরিসর ধরা-বাঁধা।

লুমিয়ের বাস্তবের প্র্তিরূপায়ণে মনোনিবেশ করেছিলেন। এক রীলের সেইসব ছোট ছোট ছবি গুলোর মধ্যে বিষয়ের তারতম্য লক্ষ্য করার মতো। বাগানে মালী জল দিচ্ছে আর একটা বাচ্চা ছেলে মালীকে এসে উত্যক্ত করছে। সবাই একসাথে বসে তাস খেলছে, বাড়ি ভাঙা হচ্ছে। এইরকম নানা বাস্তবের টুকরো ঘটনার প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাদের ছবিতে। গোটা বিশ্বে তাঁরা তাঁদের ছবির যেমন প্রদর্শন শুরু করলেন তেমনি আবার তাঁদের ক্যামেরাম্যানদের দিয়ে ছবি তুলিয়ে রাখলেন। স্বতন্ত্র তথ্যচিত্রের সূচক হিসেবে সেই ছবি গুলো আজ গল্পের অন্যদিকের হদিস দিলেও সেদিন কিন্তু মনোরঞ্জনের গল্প বলতে এগিয়ে এলেন এমন একজন মানুষ যার সাথে হয়তো সরাসরি চলচ্চিত্রের যোগাযোগ তেমন ভাবে ঘটেনি লুমিয়ের ভাইদের মতো। পেশায় ম্যাজিশিয়ান মেলিয়ে ঠিক করেছিলেন তিনিও ছবি দেখাবেন এবং লুমিয়ের ভাইদের মতো ছবি তুলবেন। আর কোনো কিছুর পরিকল্পনা সেই মুহূর্তে তাঁর ছিল কিনা বলতে পারেনন না কেউই। আজন্ম যে গল্প বলে ম্যাজিক দেখায়, সে কী করে কাট খোট্টা বাস্তবের প্রতিরূপায়ণ করবে সেটাও ভেবে দেখেনি হয়তো কেউ। কিন্তু কপালের লিখন বলেও তো একটা কথা আছে তাঁর হাতেই ক্যামেরা খারাপ হলো। আর জন্ম হলো ট্রিক ফটোগ্রাফির। একটা জিনিসের পরিবর্তে আর একটা জিনিসে পরিণত হওয়ার কৌশল। (পাঠক ধরে নিচ্ছি আপনি এই বিষয়ে আগে থেকে অবগত। শুধু মনে করুন হাতে চাঁটি দিয়ে গুপী বাঘার পোষাক পরিবর্তনের মুহূর্ত গুলো। আরো অনেক কিছুও আপনার মনে আসতে পারে।) মেলিয়ে পেয়ে গেলেন চলচ্চিত্রে গল্প বলার জিয়ন কাঠি। মেলিয়ে বড় বড় সেট করে সেখানে কখোনো চাঁদে যাওয়া। কখোনো রূপকথার সিন্ড্রেরেলা, কখোনো অসংখ্য কাটা মুন্ডুর কেরামতি দেখাতে থাকলেন। কারখানা থেকে, বাগান থেকে চলচ্চিত্র কোথাও যেন টুপ করে ঢুকে পড়লো স্টুডিওতে। গল্প বলার ভাষাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেলেন গ্রিফিত। চলচ্চিত্রে গল্প বলার অনুসন্ধিৎসায় ক্লোজ আপ এলো, প্যান এলো। চিত্রভাষার মোড়কে চব্বিশ ফ্রেমের মধ্যে গল্প বলতে শুরু করলো চলচ্চিত্র। 

আমাদের দেশেও শুরু থেকেই চলচ্চিত্র আর সাহিত্য পাশাপাশি হাঁটলো। পুরাণের মহিমায় উদ্ভাসিত তার প্রথম দিকের গৌরব যাত্রা। এক মারাঠি ব্রাহ্মণ দাদা সাহেব ফালকের হাত ধরে অস্পৃশ্য এক শিল্প বললো এমন এক পিতার গল্প, স্বামীর গল্প ট্র্যাজেডির এমন এক করূণ গাথা যা তাকে অমর করে রাখলো। রাজা হরিশচন্দ্র এক মাইল ফলক হয়ে থাকলো ভারতীয় চলচ্চিত্রে। প্রথম কাহিনী চিত্র কাহিনীর ওপর নির্ভর না করে কার ওপর নির্ভরশীল হতো?



এরও অনেক পরে। স্বাধীন ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর সূচনা লগ্নে ১৯৫৫ সালে আবার এক গ্রামীন পুরোহিত তার স্বপরিবার নিয়ে উৎখাত হলো নিজের গ্রাম থেকে। পিছনে পড়ে রইলো মৃত দিদি ইন্দিরঠাকরুণের অভুক্ত স্বপ্ন। মেয়ে দুর্গার অকাল প্রয়াণ আর হাড় জিরজিরে গরীব গ্রামের প্রাকৃত রূপ। সত্যজিত মাইল ফলক স্থাপন করলেন কালজয়ী উপন্যাসকে সাদা পর্দায় প্রতিফলিত করে। বিশ্বের সিনেমার ইতিহাস অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সদ্য স্বাধীন হওয়া এক দেশের ছবির দিকে। তারা দেখলো একটা গাড়িরও প্রাণ আছে। তার নাম আছে। জগদ্দলকে সঙ্গে নিয়ে ঋত্বিক অযান্ত্রিকে যে চিত্রভাষার জন্ম দিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকলো সাহিত্য থেকে পরিগ্রহণের রূপকময়তা। কতটুকু গ্রহণ আর কতটুকু বর্জন সেই ঝগড়াটুকুর মধ্যে আর ঢুকতে মন চাইছে না। এখোনো যেন অপুর স্বপ্ন লেগে আছে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সাহিত্য প্রান্তিক সিনেমাতেও। লেগে আছে বাইশে শ্রাবণের মালতীর আলতা রাঙা পা। কিম্বা হাঁসুলিবাঁকের উপকথার সেই গভীর নির্জন ট্রাক শট। ধুসর ছবি সাহিত্যের ছোঁওয়ায় আর ধূসর থাকলো না। বিচিত্র বর্ণময়তায় এগিয়ে চললো এক অন্তহীন পথে।                                                
 
ছবি সৌজন্য
গুগুল ইমেজ
 
 

মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার , আর্লি সিনেমা আমার ভালো লাগে না ।
    “ মৌন , বার বার ফিরে আসতে হয় এই সুরুর সিনেমাতে,
    মন দিয়ে পড় , এটা ছাড়া সিনেমা হবে না”

    আদি এই লোকটা কি যে পড়ান
    কিচ্ছু মাথাতে ঢোকে না।
    আদি Aditya Dhali কম কথা বলে একটু
    মুচকি হাসিতে ভাসিয়ে দেয় বিষয়টা

    দু বছর ও হয়নি কত বার যে ফিরে গেছি আমরা দুজনে
    কখনো সুস্থ অবস্থায়, কখনো অসুস্থ অবস্থায়
    তবুও সিনেমা থামেনি , থামেনা
    একটা জাদু , একটা মোহ
    আর তার থেকেও বেশী উৎপাত করেছি স্যার Kallol Lahiri কে
    কখনো ক্লাসে , ফুথপথে , কফিহাউসে, লোকাল ট্রেনে
    অতি অবশ্যয় সেই পুরনো কড়িবর্গার ক্লাস রুমে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি