আমার বন্ধু বিভূতিভূষণ...



গতকাল ক্লাস থেকে বেরিয়েই চায়ের আড্ডায় একটা এস এম এস আমাকে জানান দিয়ে গেলো আজ চাঁদের পাহাড়ের ট্রেলার প্রকাশিত হয়েছে। রাত আটটার ঢাকা সচল। তীব্র। মহরমের আগে সবাই ঘরে ফেরার মুখে। তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা তখনও মশগুল চিত্রনাট্যের কর্মশালা নিয়ে। আমি আস্তে আস্তে গেস্ট হাউজের দিকে পা বাড়াই। আর হঠাৎই মনে পড়ে যায় সেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকটার কথা। পান্ডুলিপির সাথে যার ব্যাগে থাকতো একটা বাঁশি। আর গোটা একটা সংসার। অথচ খ্যাতির মধ্য গগনেও যাঁর দিকে আপাত অর্থে ফিরে তাকায়নি চিত্রনাট্যের সাথে জড়িত লোকজনেরা। বায়োস্কোপের বাবুরা। তবুও রিল গোটানোর আগেও না রিলের একটা গল্প থেকে যায়। অনেকেই সেই ফেড আউট অংশটা জানেন না।

১৯৪৭ সালে চিত্ররূপা লিমিটেডের কাছ থেকে খবর আসে তারা অনুবর্তন উপন্যাসের ছবি বানাতে চায়  পরিচালক দেবকী বসু  বিভূতিভূষণকে সপ্তাহ দুয়েক কলকাতায় থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসতে বলে বিভূতিভূষণ এসেছিলেন কিনা জানা যায় না। অনুবর্তন অবশ্য শেষ পর্যন্ত ছবি হয়নি এরপরে ১৯৫০ সালের মে মাসে কেদার রাজা উপন্যাসের ছবি করার প্রস্তাব আসে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিওয়ে ওঠেনি তাঁর গল্পের ছবি হোক-এমন ইচ্ছে তিনি কোনোদিন মুখ ফুটে বন্ধুদের কাছেও বলতে পারতেন না...আত্মীয় বান্ধবদের মধ্যে যদি কখোনো কেউ বলতেন, এই যে বিভূতিবাবু অমুকের ছবি হলো, কই আপনার তো ছবি হোল না? বিভূতিভূষণ বিরক্ত হতেন স্পষ্ট বোঝা যেত ...বলতে শুনেছি, দেখুন আমার দ্বারা বই কোলে করে টালিগঞ্জের স্টুডিওতে স্টুডিওতে ঘোরা সম্ভব নয়স্মৃতিচারণ করেছেন শ্যালক চন্ডীদাস চট্টোপাধ্যায় স্ত্রী সুপ্রভাকে মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, আমি যে সিনেমা হবে ভেবে কিছু লিখতে পারি নে, আর পথের পাঁচালী তো কেউ আর ছবি করবে না এই আক্ষেপের মধ্যে কিছুটা নিহিত ছিল দুঃখ আশে পাশের বন্ধুরা তখন অনেকেই ছবির সাথে যুক্ত। নিজে প্রায় দুবছর একটা সিনেমা ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন বে নামে। চিত্রলেখা আজও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ধুলো খায়।

তবুও কোথাও যেন এক তীব্র অভিমান ছিল। মুখ ফেরানোর মানসিকতাও। কল্লোল যুগের লেখকদের সাথে কলেজস্ট্রিট পাড়া চষে বেড়ালেও টালিগঞ্জের ধারে কাছে যাননি।  কিন্তু ১৯৪৪ সালে আম আটির ভেঁপুর সচিত্র সংস্করণ করতে গিয়ে ডি জে কীমার কোম্পানীর তরুণ কমার্শিয়াল আর্টিস্ট সত্যজিত রায়ের মনে পথের পাঁচালী সম্বন্ধে যে আগ্রহ, যে প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিলো তার হদিস বিভূতিভূষণের কাছে ছিলো না সে আগ্রহের পরিণাম যে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনেছিল, বিভূতিভূষণ তা দেখে যাননি
 
গতকাল চাঁদের পাহাড়ের ট্রেলার দেখতে দেখতে এই কথাই মনে হচ্ছিল। আজ যদি তিনি থাকতেন তাহলে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর চত্ত্বরে কোনো এক তরুণের ট্যাব থেকেই কি দেখে নিতেন না তাঁর বহু সাধের চাঁদের পাহাড়ের তড়িৎ টুকরো অংশ। চিহড় ফলটা কি ঠিক এখনো জানি না। যে ফল কোঁচাতে করে ভরে রাখতেন সাহিত্যিক। আবারও নিজের ব্যাগের মধ্যেই থাকতো আস্ত একটা সংসার। জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোই ছিল যার কাজ। এমন একটা লোক স্যাঁতসেতে মেসের ঘরে বসে আর গ্লোবে সিনেমা দেখে চাঁদের পাহাড় লিখেছিলেন। অনেকে কল্পনাও করতে পারবেন না। যেমন পারবেন না জঙ্গলের নিভৃত কোণে বসে পথের পাঁচালী লেখার কথা। সুদূর যখন ঘরের কথা বলে আর ঘর যখন সুদূরের ঠিকানা দেখায় তখন পথকে কেউ কেউ বন্ধু করে। 

আমার বন্ধু বিভুতিভূষণ।

শুভেচ্ছা রইলো কমলেশ্বর আপনার চাঁদের পাহাড়ের জন্য।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি