ময়ূরপঙ্খী ব্যাগেজ



মৌন একটা ক্যামেরা কিনেছে। সেটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া হয়নি। কাজেই তাকে নিয়ে কোথাও একটু দূরে যেতে হবে। আদি অনেকদিন বাড়ি থেকে বেরোয় না। তাকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বার করতে হবে। অশোকদার ছাত্র দীপায়ণ বেশ কিছুদিন থেকে অশোকদাকে বলে চলেছে আন্দুলে আসার জন্য। অনেক প্রাচীন বাড়ির ভাঙা অংশ...খিল... কড়িকাঠ...ভাঙা অন্দর...পালকি... ঝুলন্ত বাদুড়...সব কিছুই যেন অপেক্ষা করছিল মুহূর্তের জন্য। সব কিছু অপেক্ষা করছিল ক্যামেরা বন্দি হবার জন্য। দুটো বাইকের পেছনে এই এতোগুলো মানুষের সাথে তাই কোথাও আমারও যেন জায়গা হয়ে গেলো। আমরা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি ছুটলাম। এক অলিন্দ থেকে অন্য অলিন্দে গল্পরা সচল হল। মুহূর্ত বন্দি হলো ফ্রেমে। এক পুজোর গল্প থেকে অন্য পুজোর গল্প এসে দ্বার রুদ্ধ করে দাঁড়ালো। কিন্তু সেতো একদিনের জন্য। আমার তো হাতে তখোনো আরও তিনটে দিন। আরো মুহূর্তে বেঁচে ওঠার তাগিদ। কৃষ্ণনগরে থাকে বন্ধু প্রদীপ্ত। আর তার বাড়ি থেকে আরো আড়াই ঘন্টা দূরে ঢোড়াদহে থাকে ছাত্র প্রদীপ্ত। তাদের বাড়ির পুজো পলাশীর যুদ্ধের মাত্র তিন বছর আগে শুরু হয়েছিল। তিনশো বছরেরও বেশি পথ অতিক্রম করা প্রতিমা নির্মিত হয় গৌড়িয় প্রথা মেনে। চৌধুরি বাড়ির সেই বুড়িমা আজও জাগ্রত। আজও অসংখ্য মানুষের শুভাকাঙ্খী তিনি। ইতিহাস, পুরাণ আর নির্মোহ এক একটি মুহূর্তকে গন্ডুষে পান করার অছিলায় বেরিয়ে পড়েছিলাম পিঠের বোঁচকাটাকে নিয়ে। পেরিয়েছিলাম গঙ্গা...পেরিয়েছিলাম জলঙ্গী...পেরিয়েছিলাম এক-একটা ধারণাকে। বাতিঘর ইলিনয় থেকে ফোনে একবার সতর্ক করে বলেছিল “যাযাবর হলে নাকি শেষ পর্যন্ত?” কোথাও রাতের আঁধারে শাহবাগের সেই রাস্তায় বড় মন কেমন করেছিল মায়ের জন্য। একটা ফেলে আসা শহরের জন্য। সময়ের জন্য।


“এখানে ভূত থাকে জানেন স্যার। নিশ্চই থাকে। আমার মনে হয়...”। পেছনে ফিরে দেখি প্রদীপ্ত। জোনাকিরা সবে তখন গাছের মাথায় মিটমিট করে তারার মতো জ্বলছে। দূরে কোনো এক প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে “লুঙ্গি ডান্স...”। বাতাসে শিউলি, পাটকাঠি আর ভিজে ঘাসের গন্ধ। একটা গাছ থেকে ঝটপট করে চামচিকে উড়ে পালালো। খিলানের ওপর প্রসারিত হলো গাছের পাতার ছায়া। এই বাড়িটাকে নিয়ে গল্পের খামতি নেই। আমি এঘর থেকে ওঘরে। এ বারান্দা থেকে ও বারান্দায়। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে শুধু হাঁটি। অষ্টমীর রাত প্রসারিত হতে থাকে। সামনের কোজাগরীর চাঁদ একটু একটু করে বাঁকা হয়ে ওঠে আলতো ঘন কালো মেঘের পাশে। “পারলে গোটা কতক সাহেব ভূতের সাথে মোলাকাৎ করে আসিস তো!” অনেক রাতে ফোন করে দেবালয়। সাহেব ভূত মানে?  “আরে বললি না পলাশির যুদ্ধের আগের। তাই ভাবলাম এখনও যদি নেমনতন্ন খেতে আসে...।” দেবালয়ের সাথে কথায় পারিনা আমি। ফোনের ব্যাটারি শেষ। আপাতত কেউ ডাকবে না আমাকে। জানতে চাইবে না আমার পরিস্থিতি। নিশ্চিন্ত হয়ে যখন ছাদের ওপর রাতের আকাশকে মাথার কাছে নিয়ে একটা বৈঠকি আড্ডার তোড়জোড় শুরু করেছি ঠিক সেই সময় টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমাদের গল্প আরো জমে গেলো তেলেভাজা, সিঙ্গাড়া আর চায়ের সাথে। কেউ বাদ পড়লো না সেখানে। চিলাপাতার জঙ্গল থেকে শুরু করে রায়ডাক বন বাংলো হয়ে দার্জিলিং এর চায়ের বাগান। বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম। সব ভূত কোথা থেকে প্রদীপ্তদের সেই পুরোনো বাড়ির ছাদে ভিড় করলো। রাত আস্তে আস্তে এগোতে থাকলো। মাথার ওপর দিয়ে পেঁচাদের যাতায়াত টের পেলাম।

হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুম ভাঙলো। মাথার কাছে জানলাটা খোলা। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। দূরে কোন এক বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কি প্রভাতী গান? হিমেল হাওয়া আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই কবেকার মামার বাড়ির দালান কোঠায়। পুজোর ছুটি পড়লেই ছোটমামা আমাকে নিয়ে যেত আড়বেলিয়া। একা একটা অত বড় বাড়িতে দিদা একা থাকতো। অপেক্ষা করে থাকতো আমি যাবো। নাড়ু হতো। পাথরের ছাঁচ গুলো পরিষ্কার করে রাখা থাকতো আগে থেকে। ঘি মাখিয়ে তাদের সেই কালো পাথরের গা পরিষ্কার করা হতো। তার মধ্যে নারকেলের পুর ভরে দিদা একের পর এক তৈরী করতেন গোলছাপ ফুল, বাহারী নক্সা, আর সব শেষে ময়ূরপঙ্খী। ঝকঝকে কাঁসার থালায় দিদার ময়ূরপঙ্খী যেন পাল তুলতো। বালীর বাসায় উদ্বাস্তু শিবিরের কলাইয়ের থালার থেকে কিছু দিনের জন্য মুক্তি। চুসির পায়েস, পাতলা চিনির রসে চোবানো মুর্শিদাবাদীয় ঘরানায় ছোট ছোট মুচমুচে নিমকি। আমার দি্দার কৌটো ভরে থাকে থাকে সাজানো থাকতো। ছোটবেলাটা নেই। স্মৃতিটা পড়ে আছে। আর তার সাথে আছে সেই ময়ূরপঙ্খী ছাঁচটা। যাতে কুড়ি বছর কেউ আর নারকেলের পুর ভরে না। 
আমরা এখন নাড়ু কিনে খাই।
লেখাটা এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কিন্তু তারপরেও একটু জিরানোর পালা ছিলো। জলঙ্গী নদীতে সাঁতার কাটা ছিল। আর ছিল বাইশ বছর পর শাহুরিক পুজো ছেড়ে পালানোর পথ খোঁজা। কিন্তু কোথায় পালাচ্ছি আমি? কার কাছ থেকে? তার সদুত্তর জানা নেই। আমারও না। আর সেই বৃষ্টি ভেজা রাতে পথের ধারে যে শেয়াল গুলো বসেছিল তাদেরও না। ভাগ্যিস তাদের আমার মতো ময়ূরপঙ্খীর ব্যাগেজ ছিল না। ছিল না মন কেমনের পালিয়ে যাওয়া।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি