জলছবি

শিবদাসের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিলো সবুজ রঙের কচুপানার পাশে। তার ফুলে ওঠা হ্যাসহ্যাসে সাদা পা দুটো ঘাটের ধারে ঠেকেছিলো। হালকা হাওয়ায় জলের তরঙ্গে দুলে দুলে উঠছিলো দেহটা। মাছরাঙা টুপ করে জলে ডুব দিয়ে ধরছিলো ছোটো ছোটো কেঁদো মাছ, আড়চোখে দেখছিলো পুকুর পাড়ে প্রচুর লোকের জমাট বাঁধা ভিড়। সেই ভিড়ে শিবদাসের মায়ের আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নার শব্দে জলের গভীরে স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলার আস্তরণে ঢুকে পড়ছিলো গেঁড়ি গুগলি গুলো। মাঝে মাঝে পুকুরের ওপরের জল গরম হয়ে বাস্পাকারে উড়ে যাওয়ার সময় নীচের জল উঠে আসছিলো ওপরে। ঠিক এইসব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ছাড়া পুকুর ছিলো নিশ্চল। মাঝে মাঝে সেই নিশ্চলতার তপোভঙ্গ করছিলো দেহাতি ব্যাঙাচি গুলো। তারা উঠে আসছিলো শিবদাসের জল থৈ থৈ বুকে, মুখে, তার চেয়ে থাকা চোখের কোটরে। আদিম বন্যতায় তারা ঘিরে ধরছিলো মৃতদেহকে।

কতবার যে এই স্বপ্নটা দেখেছে সাগ্নিক এখন আর ঠিক মনে করতে পারে না। ডান হাত তুলতে গিয়ে দেখে স্যালাইনের ভারে হাত তোলা দায়। পাশে বসা আয়ার তখন মাঝ রাত। ঢুলতে ঢুলতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়লে নির্ঘাত স্পাইনাল কডটা ভাঙবে। সারাক্ষণ শোওয়ার ধকল সামলানোর জন্যে এখন উঠে বসতে ইচ্ছে করছে। আস্তে আস্তে পিঠের সাড় যত ফিরছে ততই যন্ত্রনাটা বাড়ছে। মনে হয় উঠে বসতে পারলে সুস্থ বোধ হবে। কপালের ঘামটাও মোছা দরকার। কিন্তু দু-হাত পাথরের মতো অসাড়। নাড়া-চাড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা। কারণ খাবলা খাবলা চুল উঠে আসছিলো হাতে। থুতনিতে ব্যান্ডেজ। কিভাবে যে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না সাগ্নিক। এদিকে প্রচন্ড পেচ্ছাপ পেয়েছে। গলা খুশ খুশ করাতে কাশির দমক এলেও কাশতে পারলো না। চোয়ালে খুব ব্যাথা। পোঁ পোঁ সাইরেন বাজিয়ে একটা এ্যাম্বুলেন্স ঢুকলো। লোকজনের কথাবার্তা, হাঁটাচলা শোনা যাচ্ছে নীচে। কিছুক্ষণের জন্যে রাতের নার্সিংহোম যেন সচল হল। তবুও আয়ার ঘুম ভাঙলো না।

গতকাল কোনো হুঁশ ছিলো না সাগ্নিকের। তাই বুঝতে পারেনি কিছুই। এই নার্সিংহোমে সে আসে না। এবারেই কেন যে মা ভর্তি করলো বুঝতে পারছে না। আয়া না উঠলে জল খাওয়াও হবে না। পেচ্ছাপ হয়তো বিছানাতেই হয়ে যাবে। সেটা বড় ঘেন্নার। সেটা বড় কষ্টের। প্রথমবার মাঠে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে, রাতে বিছানায় যখন চাঁদের আলোর ছড়াছড়ি তখন সাগ্নিক অজান্তেই বিছানা জুড়ে হিসি করে ফেলেছিলো। কি পরিতৃপ্ত লাগছিলো সেদিন নিজেকে। সারা গায়ে হিসি আর ঝোছনা মেখে শুয়েছিলো সে। মা রাতে খাবার দিতে এসে দেখেছিলেন বিছানায় ছোপ-ছোপ, লাল-লাল দাগ। ইউরিনের সঙ্গে ব্লাড। সেদিন রাতে সেই প্রথম নার্সিংহোমে পাঠানো হলো সাগ্নিককে। ভোরে শিবদাসের স্বপ্ন। যতদূর মনে পড়ে সেদিন আয়া ছিলো না। ছিলো একজন ওয়ার্ডবয়। নাম শুভঙ্কর। মুখটা মিষ্টি। হাসলে ছোটো মাসির মতো গালে টোল পড়ে। ওকে দেখলেই শাদা দেওয়ালের ঘরটা যেন রামধনুর জার্সি পরতো গায়ে। মনে হতো বিশাল স্টেডিয়ামে নরম কচি ঘাসের ওপর পা রাখলো সাগ্নিক, শুকে নিলো ভিজে ঘাসের গন্ধ। আর একটু পরেই রেফারির হুইসিল। গমগম করা স্টেডিয়ামে স্বপ্নের একটা প্ল্যানটিক কিক। গোওওওললল…।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখ দুটো জড়িয়ে যেতো পিচুটিতে। মুখটা ফুলে উঠতো বিকট। নাম না জানা পাখিটা জানলার ধারে আতা গাছটার ডালে বসে ডাকতো আর সাগ্নিক যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যেত। ভেজা গরম তোয়ালে দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে দিতো শুভঙ্কর। সাদা গরম তোয়ালের ওম পেতে পেতে ছোটোবেলায় মায়ের বুকে মুখ গুঁজে থাকার আনন্দ পেতো সাগ্নিক। সেবার একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়ি হয়েছিলো। কেমো না নিয়েই মাথার চুল খাবলা খাবলা উঠে আসছিলো হাতে। একটু সুস্থ হলে চুল গুলো ছোট ছোট করে ছেঁটে দিয়েছিলো শুভঙ্কর। তখনি কপালের বাঁদিকের কালো রঙের দাগটা ধরা পড়ে। থুতনির নীচে যে ব্যান্ডেজ, সেটা কয়েকদিনের। ডাক্তার বলেছেন ক্রমে থুতনিতে স্প্রেড করছে ইনফেকশানটা। মুখের ভিতরেও। সাগ্নিকের সামনে কিছুই আলোচনা হয়না। তবুও কেউ জানে না, কিভাবে জেনে যায় ও সব কিছু। মা সামনে এলেই মাকে যেন সে পড়তে পারে। বাবার হিল্লী দিল্লী ঘুরে বেড়ানো কাজ, দেশেই থাকে কম। তবুও যখন তখন চলে আসে। দূরে টেবিলের ওপরে কাচের বয়ামে রাখা জেলিফিসটা বাবা এনে দিয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। মাসখানেক হলো সাগ্নিক যেখানে যায় জেলিফিসটাকে সঙ্গে নেয়। সারাদিন কাচের বয়ামের একদিকে চুপ করে বসে থাকে জেলিফিস। রাতে ঘুরে বেড়ায় বয়ামের আনাচে-কানাচে এদিকে ওদিকে। ওকি শিবদাসকে দেখতে পায়?

পাশের কেবিনে হয়তো কোনো নতুন রোগী এসেছে। একটু হাঁটা চলা, কথাবার্তা, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, দরজা খোলার আওয়াজ এসবই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে সাগ্নিক দেখলো আয়া উঠে পড়েছে। সাগ্নিকের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে কিছু দেখার, বোঝার চেষ্টা করছে। বৃদ্ধার মুখে বয়সের ছাপ। হয়তো হাই প্রেসারের রোগী। একটা গল্প তৈরী করে নিলো সাগ্নিক মনে মনে। এটা তার অভ্যাস। দীর্ঘ রোগ ভোগের শরীরে এটা তার আনন্দের পরিসর। বৃদ্ধার গরম নিঃশ্বাস তার ঠোঁটের ওপরে পড়ছে। তার কপালে জমেছে অল্প অল্প ঘাম। বাড়িতে তিন ছেলের সংসারে একমাত্র রোজগেরে মা। আয়া বা নার্সের প্রাথমিক ট্রেনিং নিতে হয়নি কোনোদিন। বছর চল্লিশ হয়ে গেলো এই লাইনে। অবসর বলে তো কিছু নেই, তবু এখন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু টাকা না নিয়ে গেলে খেতে পাবে না। আঠাশ বছর বয়সে যখন বিধবা হয়েছিলো তখন বড়টার বয়েস চার, মেজোটার তিন আর ছোটোটার দেড়। তিন ছেলেকে বড় করার ঝক্কি একা সামলাতে হয়েছে। ছেলেরা বড় হলেও দুঃখ ঘোচেনি বৃদ্ধার। বড়, মেজোর আলাদা সংসার। ছোটোটার সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর হলো তার পাত্তা নেই। পাড়ার লোকেরা বলে ছেলের নাকি সঙ্গ দোষ ছিলো। ভালো ফুটবল খেলতো ছেলেটা। বেঁচে আছে না মরে গেছে তা এখন আর কেউ বলতে পারে না। সাগ্নিক কথা বলতে যাবে আর ঠিক সেই সময় ঘরের লাইট জ্বলে ওঠে। বৃদ্ধা ফ্লাক্স থেকে জল ঢালছেন। আবার সেই গরম জল। কতদিন ঠান্ডা জল খায়নি সাগ্নিক। শুধু শিবদাসকে যখন দেখতে পায়, পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া যেন তার মুখে এসে লাগে। পুকুর পাড়ে যে মহিলা অঝোরে কাঁদছে তার মুখ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু এতো ভিড়, সাগ্নিক এগোতে পারে না।

গরম জলের সাথে ঠাণ্ডা জল মেশানো হয় তারপর চামচে করে সাগ্নিককে খাওয়ান মহিলা। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন, কপালের ঘামও। ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বার করে কি যেন ভাবেন, সাগ্নিকের কপালে হাত দেন, থার্মোমিটার ঢুকিয়ে রাখেন। খাটের তলায় নীচু হয়ে দেখেন ক্যাথিটারে পেচ্ছাপ জমা হয়ে আছে। না কোনো ব্লাড নেই বলেই মনে হলো। ক্রিটিকাল পেশেন্ট। অনেক কিছু নজরে রাখতে হয়। ইদানিং কথা বন্ধ হয়ে গেছে।  শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কিম্বা বেশিরভাগ সময়ে ওভারডোজ মরফিনে থাকে আচ্ছন্ন। সব দেখে শুনে তিনি চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সাগ্নিক নড়াচড়া করতেই চেয়ার সামনে এনে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। ছেলেটার ছটফটানি কমলো।

সাগ্নিকের কেমন যেন শীত শীত করতে লাগলো। পায়ের ওপর চাদরখানা টেনে দিয়ে অঙ্কিতা বললো “এতো গরমেও তোর শীত? এক্সকারসানের ছবি গুলো এনেছি। আজ সকালে রূপস এসে দিয়ে গেলো। যা এনজয় করেছি না। খুব মিস করতাম তোকে। দ্যাখ দ্যাখ।” ছবি গুলো এগিয়ে দেয় অঙ্কিতা। “মনে হচ্ছে না ইটস রিয়েল টাচ অব লাইট? তোর সেই মেঘ ছেঁড়া আলো। সান্দাকফুতে তোলা। এই দ্যাখ…এইটা দ্যাখ…রূপস আর আমি। কি ভীষণ সুইট লাগছে না রূপসকে? কী হলো? দেখবি না ফটো?” বেশ শীত করছিলো সাগ্নিকের। রোদের দিকে সরে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। বেশ কয়েকদিন হলো তার জ্বর হচ্ছে। কয়েকজন ডাক্তার দেখেছেন, কিন্তু কেউ কিছুই ধরতে পারছেন না। কলেজ থেকে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু যাওয়া হয়নি। অঙ্কিতার এখন নতুন বন্ধু রূপস। রূপস ঘোষ। এক বছরের জুনিয়র। ভালো ডিবেট করে। জয় গোস্বামীর বেশ কয়েকটা কবিতা মুখস্থ। রূপস কথায় বাজিমাত করতে পারে। দেখতে ভালো, কিন্তু হাসলে গালে টোল পড়ে না। কলেজের ম্যাগাজিনে নিজের লেখা নিয়ে কথা বলতে এসেছিলো প্রথমদিন। সাগ্নিক ,অঙ্কিতার কাছে পাঠিয়েছিলো তাকে। সাহিত্য, কবিতা, সিনেমা ওই দিকে আগ্রহ বেশি অঙ্কিতার। কলেজ ম্যাগাজিনের দায়িত্ত্বেও আছে। সাগ্নিকের আবার ওসব নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। কলেজের টুর্নামেন্ট সামনে। খেলতে হবে তাকে। ট্রফিটা এবার কলেজে তোলা চাই। কিন্তু খেলাতে সে মন দিতে পারছে না কিছুতেই। কারণ সে মনে মনে ঠিক বুঝতে পারছে রূপসকে সহ্য করতে পারছে না। অঙ্কিতার ফেসবুকের ওয়াল ভর্তি হয়ে যাচ্ছে রূপস আর অঙ্কিতার ছবিতে। রাজনীতিটা অতটা ভালো না বুঝলেও প্রচুর বিদেশী ছবি দেখে রূপস। আর বিদেশী ছবির নাম বলে তাক লাগিয়ে দেয় অঙ্কিতাকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে দুটো মানুষ। ছটফট করতে থাকে সাগ্নিক নিজের মধ্যে। এদিকে টুর্নামেন্ট এসে পড়ে।

ব্যাকে খেলে সাগ্নিক। খেলাতে তার বেশ নাম-ডাক। খেলতে গিয়েই অঙ্কিতার সাথে তার প্রথম আলাপ। খেলা্র পর অঙ্কিতা সরাসরি প্রপোজ করেছিলো। সাগ্নিক কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। কিভাবে হ্যাঁ বলবে বুঝতে না পেরে, মতি নন্দীর ‘স্ট্রাইকারের’ প্রথম পাতায় লিখেছিলো দুজনে বন্ধু হলাম। তারপর দুটো মানুষ খুব কাছাকাছি এসেছে। জীবনে প্রথম চুমু। পিকনিক সেরে অনেক রাতে বাড়ি ফেরা। অনেক অনেক কমিটমেন্ট। তারপর হঠাতই অঙ্কিতার গলায় খালি রূপস…আর রূপস। বল নিয়ে ছুটে আসছে বিপক্ষের দল।  ব্যাক আগলাচ্ছে সাগ্নিক। ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে ছেলেটা। প্রশান্ত পারলো না…ধনঞ্জয় এগিয়ে এলো…সেও পারলো না। এবার সাগ্নিক অবাক হয়ে দেখে কি জাদু ছেলেটার তড়িত চলনে। কি ছন্দ তার বল নিয়ে এগিয়ে আসা শরীরে। আর অপেক্ষা করতে পারে না সাগ্নিক। বলটা ছিনিয়ে নেয়। তড়তড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সেন্টারের দিকে। কিন্তু হঠাত একটা ধাক্কা। ভীষণ ধাক্কা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোনো এক আঁধার গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে সাগ্নিক। ফিকে হয়ে আসতে থাকে মাঠের আওয়াজ। ভিজে ঘাসের গন্ধ টেনে নিয়ে যায় তাকে পুকুর পাড়ে। কে ওখানে দাঁড়িয়ে? শিবদাসদা? একটা হাত শুধু কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না।

কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরেছিলো সাগ্নিকের। পাড়ার লোকরা ধরাধরি করে বাড়ি দিয়ে এসেছিলো। সেদিন অঙ্কিতা খেলা দেখতে আসেনি। রূপসের কবিতা পাঠের আসরে গিয়েছিলো। অনেক রাতে ফোন করেছিলো অঙ্কিতা, “ওমা তুমি পড়ে গেছো? প্রশান্ত বললো। লাগেনি তো? শোনো না আজকে দারুন এনজয় করলাম। রূপস যা কবিতা পড়লো না। সবাই অবাক। আর শোনো। কি শুনছো তো? জয় গোস্বামীর সাথে আলাপ হলো। কি সুইট…হ্যালো…হ্যালো…শুনতে পাচ্ছো? কী হলো?…হ্যালো”। সাগ্নিক রিসিভার নামিয়ে রেখেছিলো। এতো চাঁদের আলো এলো কোথা থেকে? খাটটা ভিজে যাচ্ছে। গোলপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে কতদিন পরে অমনভাবে শিবদাসদা খেলা দেখছিলো? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সাগ্নিক বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলো। রাতে ঘরে এসে মা আলো জ্বালালেন। “বাবি…বাবি…”। সাগ্নিক কোনো উত্তর দিলো না। রক্ত পেচ্ছাপে ভেসে গিয়েছিলো চাদরটা। সকালে যখন হুঁশ হলো তখন কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা। বিন্দু বিন্দু জল এলিয়ে পড়ছে স্যালাইনের নলে। চোখ মেলতেই শুভঙ্করকে দেখেছিলো। কি অমলিন হাসি ছেলেটার। গালে টোল পড়ছিলো। সাগ্নিকের হঠাত ভালো লেগে গেলো সেই সকালটা। চারপাশের সাদা দেওয়াল গায়ে তুললো রামধনু রঙের জার্সি। রেফারির হুইসিল শোনা গেলো। আবার ভিজে ঘাসের গন্ধ এসে লাগলো চোখে মুখে।

তিনতলার নয় নম্বর কেবিনের পেশেন্টের অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার মুখার্জিকে রাতেই খবর দেওয়া হয়েছিলো। উনি এসে দেখে গেছেন। সাগ্নিক বসু এখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। মণিমালা সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলেন। লিফট খারাপ। ভারী চেহারার মানুষ মণিমালা। ওপরে ওঠার কষ্ট পরতে পরতে বুঝতে পারছিলেন। তিনতলায় ইনটেনসিভ কেয়ার সামনে যখন এলেন তখন শরীরের সমস্ত রক্ত যেন জল হয়ে গেছে। বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। দম নেওয়ার জন্যে হাঁসফাঁস করছেন তিনি। সিঁড়ির মুখটাতে রাতের সেই বৃদ্ধা আয়া দাঁড়িয়ে। মণিমালার কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিলো। হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করলেন, “কি কী হয়েছে…?” বৃদ্ধা হাত ধরে নিলেন মণিমালার। সিঁড়ির শেষ ধাপটা উঠতে সাহায্য করলেন। “রাতে, শেষ রাতে…হাত-পা সব ঠান্ডা…নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট…কি ঘাম গো তোমার ছেলের।” দরজা ঠেলে এগিয়ে যান মণিমালা। কাঁচের দেওয়ালের বাইরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অদূরে তাঁর একটি মাত্র ছেলে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। ডাক্তার মুখার্জিও আশ্বাস দিতে পারছেন না। “মা…”। মণিমালা ফিরে তাকান। “কাল কথা বলছিলো খোকা”…। মণিমালা সরে আসেন বৃদ্ধার কাছে। “ওর জিভ…জিভটাতে কোনো সাড় নেই। কথা বলতে পারে না বাবি…। আজ মাস ছয়েক হয়ে গেলো। তোমার রাতে ঘুম হয়নি…”। কিন্তু নাছোড় বৃদ্ধা। “আমি স্পষ্ট শুনেছি মা…শিবদাসের কথা বলছিলো তোমার ছেলে।” মণিমালা এবার একটু বিরক্ত। “কে শিবদাস?” “তা আমি কী করে জানবো মা?…তবে ওই নামে আমার একটা ছেলে ছিলো।…বহুদিন তার কোনো খোঁজ নেই…।” ভাইব্রেশানে থাকা মোবাইল বেজে ওঠে। মণিমালা কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সাগ্নিকের বাবার সঙ্গে। নার্স এসে মণিমালাকে ডাকেন। ডাক্তার সোম কথা বলতে চান। “এখানে যে বয়স্ক এ্যাটেনডেন্স ছিলেন?” মণিমালা বৃদ্ধাকে খোঁজেন। নার্স জানায় চলে গেছে সে। কাল ছুটি পরশুদিন আসবে।

আকাশে মেঘ করেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। গুমোট গরমের এই বিকেল বৃষ্টি সাগ্নিকের খুব প্রিয়। ছুটে চলে যায় চিলেকোঠার ঘরে। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে খড়খড়ি জানলায়, মার তুলসি গাছের টবে, কোন্টিদের বাড়ির টিয়া পাখির খাঁচায়। দূরে আলসের মাথায় একটা কাক মজা করে ভিজছে। এসব চেনা ছবি। এতো আনন্দের মধ্যে এইসব দেখতে আসেনি সাগ্নিক। কানাই ওকে ডেকেছে, বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে মাঠের খেলা দারুন জমবে। সাগ্নিক যেতে পারবে না বলে ইশারা করে। কানাই তাকে না নিয়ে যাবে না। বৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে। কি মনে হয় সাগ্নিকের ছুটে চলে আসে নীচে। জারসি সরটস পরে নেয়। বুট পরতে যাবে, বৃষ্টির দিকে তাকায়, পরে না। পিছনের দরজা দিয়ে কানাইয়ের কাছে চলে আসে চুপি চুপি। হৈ হৈ করে ভিজতে ভিজতে সবে এইট থেকে নাইনে ওঠা দুই বন্ধু মাঠের দিকে ছোটে।

মাঠে তখন খেলা শুরু হয়ে গেছে। শিবদাসদা নিজেই খেলাচ্ছে। “না…না…রনিকে না…ওদিকে প্রশান্ত ফাঁকা। এভাবে খেললে কোনোদিন শিখতে পারবি না তোরা”। সাগ্নিক আর কানাই পেছনে এসে দাঁড়ায়। শিবদাস ওদের দুজনকে দু-দিকের দলে ঢুকিয়ে দেয়। খেলা চলতে থাকে। বৃষ্টি, কাদা, জলে মাখামাখি হয়ে ছেলেগুলো খেলতে থাকে। শিবদাস চিতকার করে, “ওখানে ওভাবে নয় কানাই, ওভাবে ট্রাকেল করলে চলবে না। সাগ্নিক বলটা নিয়ে উঠতে থাক…রণিকে বাড়া…।” বৃষ্টি ধরে আসে। খেলাও শেষ হয়। কাদামাখা ছেলের দল পুকুরে স্নান করতে নামে। জলে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি করে। সাগ্নিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। পুকুরে নামে না। সারা গায়ে লেপটে থাকে কাদা মাখা ছোটো ছোটো ঘাস। চোখ বন্ধ করে ভিজে ঘাসের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে। শিবদাস পাশে এসে দাঁড়ায়। “ ঠিক এইভাবে খেললে একদিন তুই অনেক বড় হবি। সকালে প্র্যাকটিসে আসছিস না কেনো?…” সাগ্নিকের কাঁধের ওপর হাত রাখে শিবদাস। সাগ্নিক কোনো কথা বলে না। জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব শীত করে তার, খুব শীত। কাঁপুনি লাগে। শিবদাসের হাত ধরতে চায়। কিন্তু কোথায় শিবদাসদা? পুকুরের চারিদিকে শুধু লোকের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে সাগ্নিক দেখে দুটো পা ঠেকে আছে পুকুরের ঘাটে। শিবদাসদার চোখ দুটো খোলা।

মণিমালা তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছেন পুরনো প্রেসক্রিপশানটা। প্রথমবার সাগ্নিককে যখন দেখানো হয়েছিলো, তাও প্রায় বছর তিনেক আগের কথা। কে যেন দেখে ছিলেন? মনে করার চেষ্টা করেন মণিমালা। কিছুতেই মনে পড়ে না। কাজের মেয়ে পুতুল দাঁড়িয়েছিলো দরজার কাছে। “কিছু খুঁজছেন দিদি”? মণিমালা না তাকিয়েই উত্তর দেন “বাবির প্রেসক্রিপশান”। পুতুল ঘরের মধ্যে ঢোকে, “সেতো আলমারিতে”। মণিমালা অবাক হয়ে ফিরে হয়ে ফিরে তাকান, “তুই জানলি কী করে?” পুতুল মেঝেতে বসে পড়ে, “বারে সেদিনই তো ফটো টটো তুলে নিয়ে এসে ওই আলমারীতে রাখলেন”। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। সচরাচর যেটা তিনি করেন না, অপছন্দ করেন সেটাই করলেন মণিমালা। চিতকার করে বললেন, “সেগুলোতো নতুন। আমি পুরোনোটা খুঁজছি। কাজের সময় বিরক্ত করিস না। নীচে গিয়ে দেখ গ্যাসে কি বসিয়ে এসেছিস…পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে”।

পোড়া ভাতের গন্ধে গোটা বাড়ি যখন ম-ম করছে তখন মণিমালা চিলেকোঠার ঘরে। অনেকদিনের পুরোনো কাঠের আলমারিটা খোলার চেষ্টা করছেন। একটু জোরে টান দিতেই দরজাটা খুলে গেলো। হুড়মুড় করে পড়লো কাগজের বান্ডিল, ছেঁড়া খাম, কতকগুলো পুরোনো ফাইল। সাগ্নিকের বাবার আলমারি, পরে সাগ্নিক ব্যবহার করতো। দেরাজটা খুলতে পারছেন না। অনেক টানাটানি করেও না। পাশের তাকে রাখা ফাইলের দিকে নজর পড়লো। ফাইল খুলে বসলেন মণিমালা। কয়েকটি ছবি তাঁর আর সাগ্নিকের বাবা সুবীরবাবুর। বহুদিন আগের লেখা চিঠি, সেসব তো এখন ইতিহাস। কিন্তু এগুলো এখানে এলো কী করে? মণিমালা খুঁজতে থাকলেন যদি আরো কিছু পাওয়া যায়। ছেলের আলমারিতে তাঁদের বিগত প্রেমের চিঠি। এসব কি সাগ্নিক পড়েছে? কবে যে এতোবড় হয়ে গেলো ছেলেটা? ভাবেন মণিমালা, এই তো সেদিনের কথা। হাতের কাছেই পেলেন বেশ পুরোনো একটা এ্যালবাম। সাগ্নিকের ছোটোবেলার ছবি, কানাইয়ের সাথে সাগ্নিক, ওদের ফুটবল টিমের গ্রুপ ফটো। শিবুর সাথে সাগ্নিক। “শিবু ছেলেটা বাড়িতে খুব আসতো”…। বিড়বিড় করেন মণিমালা। “বাবিদের কোচ। রেললাইনের পাশের কলোনীতে থাকতো। বাবি আর কানাইকে খুব ভালোবাসতো। জলে ডুবে মারা যায়। কেউ বলে সুইসাইড, তবে অনেকের মতে খুন হয়েছিলো শিবু।” পুরো নামটা মনে করার চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। কানাইটাও নেই, বন্ধুদের মধ্যে ওর সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিলো এই বাড়িতে। কি একটা চাকরী পেয়ে মুম্বাইয়ে চলে গেছে। কলিংবেলের শব্দ হয় একবার নয় পরপর দুবার। পুতুল এসে বলে চিঠি এসেছে সই করে নিতে হবে। মণিমালা একটু অবাক হন, সই করে পিওনের কাছ থেকে পান একটা বড়সড় খাম। ওপরে লেখা সাগ্নিকের নাম ঠিকানা। কে পাঠিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। স্লিপে লেখা আসানসোল নামটা শুধু চোখে পড়লো। অন্যসময় হলে তিনি ছেলের জিনিস খুলতেন না, কিন্তু সাগ্নিক আজ বেঁচেও মৃত। তার বাহ্যিক জ্ঞান যেটুকু ছিলো আজ সকালের পরে সেটাও আর নেই। এই বয়েসে একমাত্র ছেলের মরা মুখ দেখতে হবে! শিউরে ওঠেন মণিমালা। সত্যি এইভাবে ভাবার সময় পাননি। গত তিন বছর তাঁকে শুধু হসপিটাল আর বাড়ি করতে হয়েছে। ছুটতে হয়েছে রাজ্যের বাইরেও। কেউ আশ্বাস দিতে পারেননি। তবুও বুক বেঁধে ছিলেন। কি একটা মনের জোর তাঁকে এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে আর এক ডাক্তারের চেম্বারে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতো। ঘরে ফিরে আসেন মণিমালা। প্যাকেট খোলার চেষ্টা করেন, হাত দিয়ে না পেরে কাঁচির সাহায্য নেন। কাটতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে ভেতরের জিনিসপত্র। মেঝের চারিদিকে ছড়িয়ে যায় অঙ্কিতা আর সাগ্নিকের ছবি। সাগ্নিকের লেখা বেশ কয়েকটা চিঠি। মণিমালা সেগুলো তাড়াতাড়ি তুলে নেন, পাছে পুতুল দেখে ফেলে।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। শেষ বিকেলের আলো ভালো লাগে অঙ্কিতার। রূপসের ভালো লাগে কিনা সেটা এখন আর বুঝতে পারে না। সারাদিন লেখালেখি তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা, রাত দুপুরে নেশায় টালমাটাল হয়ে বাড়ি ফেরা। গত দুবছরে বিবাহিত জীবনে এরচেয়ে বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসেনি তাদের। কবি হয়েও শেষ বিকেলের আলো কেনো যে ভালো লাগে না রূপসের সে কথা ভাবতে ভাবতে ছাদে এসে অঙ্কিতা দেখে সারা আকাশ লালে লাল। হঠাত গোধূলীর সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন অনেকদিন পর ফিরে পায়। “আরে তুই এখানে? আর আমি তোকে গোটা বাড়ি খুঁজে মরছি”। অঙ্কিতা ফিরে দেখে সাগ্নিক। “একটু দাঁড়া না”। এগিয়ে আসে অঙ্কিতা। ভীষণ ব্যস্ত সাগ্নিক, “বুঝতে পারছিস না এখনি ক্লাবে যাওয়া দরকার”। আরো কাছে এসে দাঁড়ায় অঙ্কিতা। “আর আমি ডাকছি সেটা দরকারের নয়?” শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে অঙ্কিতার মুখে…বুকে…সারা শরীরে…তার উঠলে ওঠা যৌবনে। সাগ্নিক তাকিয়ে থাকে। “কি সুন্দর তুই…”। অঙ্কিতা টেনে নেয় সাগ্নিককে। গোধূলির সেই আলোতে খুব কাছাকাছি দুজনে। খুব ঘনিষ্ঠ। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তারা ভালোবাসার উষ্ণতা মাপে। এবার অঙ্কিতা লজ্জা পায়। সাগ্নিক আরো কাছে টেনে নিতে চায় তাকে আর ঠিক সেই সময়ে অঙ্কিতা বুঝতে পারে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে সাগ্নিকের।
“জ্বর তোর”।
“তাতে কী?”
“মানে…পাগোল হলি নাকি? নীচে চল।”
“না ভালো লাগছে তোর সাথে থাকতে।”
“আজ আর তুই খেলতে যাস না। রাতে নেট প্র্যাকটিসের দরকার নেই।”
সাগ্নিক যা বলতে চায়নি, এতোদিন মনে মনে যা রেখে দিয়েছিলো তা যেন হঠাতই বেরিয়ে পড়লো।
“আমাকে ছেড়ে চলে যাবি নাতো তুই?”
“কি যাতা বকছিস?”
“তোর সাথে রূপসের বন্ধুত্ত্বটা বুঝতে চাই”।
সাগ্নিক দুহাতে তুলে ধরে অঙ্কিতার মুখ।
“ভালোবাসিস তুই রূপসকে?”
অঙ্কিতা চোখ সরিয়ে নেয়।
“পাগলামি করছিস আমাদের নীচে যাওয়া উচিত”।
“কেন?”
“তোর শরীর খারাপ।…আর তোর মতো ছেলের সন্দেহ করা উচিত নয়।”
“জানি…আর এটাও জানি আমার শরীর খারাপ…কয়েকদিন হলো জ্বর হচ্ছে…আর এতোই যখন চিন্তা আমাকে ফেলে বেড়াতে যেতে ভালো লাগছে?”
“আমাকে যেতেই হবে সাগ্নিক। আমি না গেলে রূপসের যাওয়া হবে না। এই ট্যুরটা ওর দরকার। মা মারা যাওয়াতে বেচারা একা হয়ে পড়েছে”।
একটানা বলে যায় অঙ্কিতা। একটানা কত কথা বলতো সেদিনের সেই মেয়েটা। সাগ্নিক কি কিছু বলেছিলো? মনে করার চেষ্টা করে। না কিছু বলেনি নীচে নেমে গিয়েছিলো চুপচাপ। অঙ্কিতাও কি কষ্ট পায়নি তাতে? পেয়েছিলো। কিন্তু অন্য এক বৃত্তে তখন সে ছিলো সংবৃত। রূপস তার শরীরে… মনে… ভালোলাগায়… ভালোবাসায়… কথায়… বুদ্ধিতে…অঙ্কিতাকে নিয়ে গিয়েছিলো সাগ্নিকের থেকে দূরে…বহুদূরে।

এবার অঙ্কিতার কেমন শীত শীত করতে লাগলো। এই অসময়ে শীত করার কারণটা ঠিক সে বুঝতে পারলো না। ছাদ থেকে নীচে এলো সে। আজ সকালে শুধু রূপস ঝগড়া করেছে বলেই, শুধু রূপস চাইছে না বলেই সাগ্নিকের সব চিঠি, সব ছবি সে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু পারেনি। সত্যি পারেনি। রূপস বেরিয়ে যাওয়ার পর সব কিছু পোষ্ট করে দিয়ে এসেছে। সাগ্নিকের যদি মনে নাও থাকে, তাহলেও। আর বিশেষ কিছু ভাবেনি অঙ্কিতা। একটা সম্পর্ক সে যেমন নিজে হাতে শেষ করে আসতে পেরেছে তেমন শেষ চিহ্নটুকু হারাতে কষ্ট হলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। সেটা অনেকরাতে বাড়ি ফিরে বুঝতে পেরেছিলো রূপস। না আসল ঘটনার সারবত্তা হয়তো কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু একটু অনুমান করতে পেরেছিলো তার বউ জ্বরে বেঁহুশ। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলো ফোনের দিকে ডাক্তারকে খবর দেওয়ার জন্যে, আর অঙ্কিতা তখন জ্বরের ঘোরে খেলার মাঠে। এইমাত্র হারা খেলাটা যে ছেলেটা জিতিয়ে দিলো তার মুখের দিকে না তাকিয়ে সে পারছিলো না। সরাসরি ছেলেটার সাথে কথা বলতে চলে গেলো। আর ডাক্তারের কথা শুনে রূপস গেলো ওষুধ আনতে। এইমাত্র জানতে পেরেছে সে বাবা হতে চলেছে। আজ তার আনন্দ একটু বেশি।

মণিমালা শুয়ে ছিলেন। পুতুল ঘরের আলো জ্বালিয়ে সন্ধ্যে দেখালো। পাশের বাড়িতে শাঁখ বাজছে। মণিমালা উঠে বসলেন। মাথা ধরেছে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলেন। আজকাল আর এমনিতে ঘুম আসে না। কাল ভোর রাতে নার্সিংহোম থেকে ফোন আসতে শুরু করেছিলো। আজ আর তেমন কিছুই করার নেই। যেকোনো সময়ে যা কিছু ঘটে যেতে পারে। হ্যাঁ সাগ্নিক আর থাকবে না। তারপর মণিমালার কী হবে? সে কথা ভাবতে ভালো লাগছে না এখন। আর ভেবে সত্যিই কিছু করা যায় না। আমরা কিছুই করতে পারি না। অনেক সময় হাতের বাইরে থেকে যায় সব কিছু। বিছানার মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। হাওয়াটা খুব একটা ভালো লাগছে না। আজ সাগ্নিকের বাবার কোনো ফোন আসেনি। হয়তো আসবে না আর। যখন জেনে গেছেন তাঁর একমাত্র ছেলের আর কোনো ভাবেই বাঁচার চান্স নেই তখন যোগাযোগ বা ফিরে আসার কোনো সুযোগ হয়তো নেবেন না। গত দুবছরে সুবীরের সাথে দূরত্ত্ব বেড়েছে। গত দুবছরে সুবীরের ব্যবসা ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশে আর মণিমালা হয়ে গিয়েছেন একা। এক বছরের সেপারেশানে আছেন তাঁরা। ছেলে জানেও না। লাল, নীল রঙীন মাছেই সে খুশী। বাবার দেওয়া জেলিফিসটা সে সঙ্গে নিয়েই বেড়ায়। এখন অবশ্য জানলার কোণায়। মণিমালা নিয়ে এসেছেন। নার্সিংহোমের ইনটেনসিভে মৃতপ্রায় মানুষের কাছে তার আর কি মূল্য থাকতে পারে? পরশু থেকে মোবাইল চার্জ দেওয়া হয়নি। চার্জে বসালেন। পুতুল চা দিয়ে গেলো।

অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে শিবদাস আর ফিরে এলো না। সাগ্নিকের ঘুম ভালো হওয়ারই কথা ছিলো কিন্তু তার পাশে তখন ডাক্তারদের ভিড়। প্রত্যেকেই একটা ডিসিশান নেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর। সাগ্নিক বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে করণীয় কী? তার সমস্ত দেহ ভার। এদিক ওদিক তাকিয়েও বৃদ্ধা আয়া বা জেলিফিস কাউকেই দেখতে পেলো না। শুধু বুঝতে পারলো তার ঘর পরিবর্তন হয়েছে। এই ঘরের মানুষদের সে চেনে না। শুভঙ্করকে দেখতে ইচ্ছে করলো… ইচ্ছে করলো শাদা দেওয়ালকে রামধনু জার্সি পরাতে… ইচ্ছে করলো ছুট্টে চিলেকোঠায় যেতে…ইচ্ছে করলো ভিজে ঘাসের গন্ধ পেতে…ইচ্ছে করলো এমন আরো অনেক কিছুর।

ঠিক মাঝরাতে হঠাত ঘুম ভেঙে গেলো মণিমালার। ঝড় উঠেছে… জানলার ভারী পাল্লাটা দড়াম দড়াম করে পড়ছে। ঠিক কটা বাজে বোঝার উপায় নেই। আর সত্যি বলতে কি ইচ্ছেও নেই। মণিমালা পাশ ফিরে শুলেন। কিন্তু পাল্লার বিকট শব্দ আর তুমুল ঝড় মণিমালার বিষণ্ণ শরীরকে নিশ্চুপ থাকতে দিলো না। আলো আঁধারির মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে খুঁজে পেলেন বেড সুইচ। আলো জ্বলে উঠলো ঘরে। খাট থেকে নামতে গিয়ে দেখলেন ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ছে সকালের ডাকে আসা ছবিগুলো। কিছু উড়ছে, কিছু জলে ভিজে সেঁটে আছে চৌকাঠের ধারে লাল মোমপালিশ মেঝেতে। ভিজছে সাগ্নিক…ভিজছে অঙ্কিতা…ভিজছে বিগত সময়। আর ঠিক এই সবের মধ্যে ফোনটা বেজে উঠছে। বাজতে থাকছে… অবিরাম অবিশ্রান্ত তার বেজে চলা। মণিমালা সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করছেন না। এগিয়ে যাচ্ছেন উড়ন্ত ছবিগুলোর দিকে, আলগোছে হারিয়ে যাওয়া সময়কে ধরতে। বৃষ্টির জলধারা লাগছে তাঁর চোখে, মুখে, ক্লান্ত বিরামহীন শরীরে। আজ এই মুহুর্ত থেকে…পুত্রশোকের, অশৌচের… যে ছোঁওয়া লাগবে তাঁর গায়ে তার ছিটেফোঁটাকেও ধারে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না মণিমালা। বরং ভারী শরীরটা নিয়ে বসে পড়ছেন মেঝেতে। যত্ন করে তুলে রাখছেন সাগ্নিককে, অঙ্কিতাকে, তাদের ভিজে যাওয়া জল ছবিকে।
 গল্পটা করিমকুটিরের প্রথম সংখ্যাতে (২০১৩) প্রকাশিত।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি