প্রলয় : চেনা না চেনার মিশায়
‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’
উপনিষদের এই বানী আউড়ে যায় মাঝে
মাঝেই মূল চরিত্র। সুঠাম, তেজি এক যুবক। চোখে মুখে প্রতিবাদের ভাষা। মাথা উঁচু করে
কোথাও বেঁচে থাকার আকাঙ্খা। অন্যায় নিজে করেন না। অন্যায় সহ্য করতেও পারেন না।
গ্রামের লোকজন তাকে ডাকে মাষ্টারদা বলে। বিবেকানন্দের হাত ধরে লক্ষ্যে পৌঁছোনোর চেষ্টা
তাঁর। আর অহিংসতায় সহায় থাকেন গান্ধী। গ্রামের জাগরণ মঞ্চে মানুষ জড়ো হয় তাকে ঘিরে।
মাস পয়লার মাইনে, গ্রামের মানুষকে সাহায্য করতে করতে শেষ হয়ে যায় মিত্র
ইন্সটিটিউটের এই শিক্ষকের। রাতের আঁধারে নিজের মোটরবাইকে টহল দেয় মানুষটা গোটা
গ্রাম। কারণ নারী মাংসলোভী জানোয়ার গুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামের মধ্যে। মা, মেয়ে
কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে না। ইঁট ভাটা, রাস্তা, বাড়ির মধ্যে তাদের নিরঙ্কুশ আনাগোনা।
প্রতিবাদে সরব হন মূল চরিত্র। ছবি শুরুর মাত্র মিনিট তিনেকের মাথায় খুন হন
মাষ্টারদা, হয়তো তার কোনো প্রিয় ছাত্রের হাতেই। রাতের গোটা স্টেশন তাকে ঘিরে থাকে।
অথচ কেউ এগিয়ে আসে না তাদেরই চেনা...তাদেরই গ্রামে রাতে টহল দেওয়া... তাদেরই আপদে
বিপদে সাহায্য করা একটা মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো প্রাথমিক সাহায্য করতে।
বুকে গুলি লাগা অবস্থায়, রক্তাক্ত মাষ্টার অস্ফুটে বলে “আমাকে চিনতে পারছো না? আমি
তোমাদের বরুণ...।”
ঠিক এখান থেকেই ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যায় ছবি। অর্থাৎ অতীতের পাতা
ঘাঁটতে থাকেন রাজ চক্রবর্তী। ‘প্রলয়’ শুধু সাদা পর্দার ওপর আছড়ে পড়ে না। প্রলয়
ছবির বরুণ আর বাস্তবে হারিয়ে যাওয়া বরুণকে মুখোমুখি বসিয়ে দেয়। সাক্ষী থাকি আমরা
দর্শকরা। আর বারবার কানের কাছে বাজতে থাকে “আমাকে তোমরা চিনতে পারছো না। আমি
তোমাদের বরুণ।” এরপর থেকে এই ‘চেনা’ আর ‘না চেনার’ দন্দ্বটা গোটা ছবির মধ্যে একটা
প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে বারবার ফিরে ফিরে আসবে। কখোনো দৃশ্যের সাংকেতিকতায়। কখোনো বিষয়বস্তুর
আবরণে। আবার কখনো খুব জনপ্রিয় মোড়কে গল্প শেষ করার অছিলায়। থানা মানুষকে চিনতে
পারে না। স্থান বিভাজন আবার গ্রামের মানুষের বিচার বিবেচনার বাইরে। বরুণকে চিনতে
পারে না, প্রেমে পড়ে যাওয়া ছাত্রী দুর্গা। দাদা ভাইকে চিনতে পারে না। “আজও তোকে
চিনতে পারলাম না বরুণ।” স্কুলের বয়স্ক সহকর্মী পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও চিনতে পারে না
বরুণকে। “আচ্ছা বলতে পারেন কী কারণে বরুণকে মরতে হল?” দুঁদে ক্রাইম ব্রাঞ্চের
পুলিশ অফিসার চিনতে পারে না সেই মানুষটাকে যে রাতের পর রাতে খুন করে যাচ্ছে একের
পর এক পিশাচকে। যে লোকটা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে “বিল্পব দীর্ঘজীবি হোক”। কিম্বা
রাতের আঁধারে ত্রাণ কর্তা হিসেবে যখন দাঁড়াচ্ছে পুলিশ অফিসা্র তাকেই বরুণ হিসেবে
ভুল করছে বয়স্ক মাষ্টার মশাই। এই চিনতে পারা আর না পারার দৃশ্যগত ব্যাঞ্জনায় এক
অন্যদিকের চিহ্নায়ণের সূচনা করছে ছবিটি।
বাস্তবের একটা ঘটনা অবলম্বনে রাজ
চক্রবর্তী নির্মাণ করেছেন ‘প্রলয়’। কোন সময়ে এমন একটা ছবি মুক্তি পাচ্ছে? যখন
আমাদের রাজ্য এবং দেশ সমালোচনায় জর্জরিত হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা, বিশেষ করে
মহিলাদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের প্রশ্নে। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান নিয়েছে
নৃংশস, বর্বরোচিত, ঘৃণ্য এবং এর আগে না দেখা, না শোনা, সমস্ত জান্তব ধর্ষণের বিবরণ। আমরা পড়েছি। মিছিলে
হেঁটেছি। মিছিল বিভাজিত হয়েছে মিত্র পক্ষ এবং শত্রু পক্ষের নিরিখে। আর বরুণ বিশ্বাসের
কেস আদালতের আরো অনেক অজস্র ফাইলের তলায় চাপা পড়েছে। খুনের সাথে প্রত্যক্ষ এবং
পরোক্ষভাবে জড়িত লোকদের অনেকেই নাকি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বহাল তবিয়েতে। কয়েকটি
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সেই রকমই দাবী।
ঠিক এমন মুহূর্তে কলকাতা, পুরুলিয়া,
ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে সেট ফেলে যে জীবনের চিত্ররূপ রাজ পুণঃ নির্মাণের চেষ্টা
করলেন সেখানে কোন সামাজিক লক্ষ্যে তিনি পৌঁছে নিয়ে যেতে পারলেন প্রলয়কে? ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’... বরুণকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি। কিন্তু কোথাও একটা প্রদীপ থেকে
অসংখ্য প্রদীপ জ্বালবার সাহসটুকু দেখিয়ে গেছে। সত্যিই কি তাই? গ্রামের মানুষের মনে
যে জ্ঞানের আলো জ্বালাবার জন্য একদিন বরুণ এগিয়ে ছিল অহিংসতার পথে, যে বরুণ চিঠির
পর চিঠি লিখে গেছে সরকারী দপ্তরে কখোনো গ্রামে ইলেক্ট্রিকের জন্য আবার কখোনো বা
গ্রামের মানুষদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। লিখে গেছে।
আর আশায় থেকেছে কখন একটা জবাব আসবে। অনেক ক্ষেত্রেই আসেনি। ন্যায়ের পথে থাকা,
আইনের শাসন মানা বরুণকে সমালোচিত হতে হয়েছে। বারবার। তার আদর্শ, নীতি মানতে পারেনি
অনেকে। বরুণকে সরিয়েও দেওয়া হয়েছে। আর সেখানে এসে তার জায়গায় যাকে দাঁড় করানো
হয়েছে তিনি ঠিক বরুণের বিপরীতের মানুষ। যে কথায় কথায় খিস্তি দেয়। যে বলে “জ্ঞান
দেবেন না মাইরি”। যে রাতের বেলা মদ খায়। আর দিনের বেলা আসামী ঠ্যাঙায়। যে ভয় পায়
না কোনো মন্ত্রীকে, আমলাকে। ছবির দ্বিতীয় অংশ জুড়ে থাকে তাই হাততালি। মারপিটের
রণহুঙ্কার। যুদ্ধের প্রারম্ভ। চেনা-অচেনার মিশায় কোথাও যেন হারিয়ে যায় বরুণের সেই
আর্তি। “আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি আপনা্দের বরুণ।” চিনতে পারা যায় না বরুণকে
আক্ষরিক অর্থে। সত্যি যদি চেনা যেত ছবিটা অন্য গল্প বলতো। কিন্তু জনপ্রিয় ধারায়
ছবি করতে বসলে ওই যে এক গুচ্ছ শর্তের ডালি থাকে। প্রতি মুহূর্তে সেই শর্তের পাঁচিল
টপকাতে হয়। বিষয়ের গভীরতা হারিয়ে যায় আরো গভীরে। ছবির প্রচারে হয়তো তাই দরকার হয়ে
পড়ে শাসক গোষ্ঠীর উপস্থিতি। দরকার হয়ে পড়ে এক বার্তা। কিন্তু সেই বার্তাটা কী? দুঁদে
পুলিশ অফিসার বয়স্ক মাষ্টারকে বলে “ছাত্রদের শুধু জ্ঞান দেবেন না। মাথা উঁচু করতেও
একটু শেখান।” সেটা কি ছবির প্রথমার্ধ জুড়ে বরুণ করেনি? তার মুখে ছিলো না চলতি বাংলা খিস্তি...তার পেছনে
ছিল না সহিংস আন্দোলনের জোয়ার। তাই মনে দাগ কাটে না বরুণ। দাগা রেখে যায়। তাই
ছবিতে বরুণ রূপী পরমব্রতকে যতটা না মনে থাকে তার চেয়ে বেশি মনে থাকে শাশ্বতকে।
পরাণকে। কারণ একজন আইনের রক্ষক নিজেই ভক্ষক হচ্ছেন। আর অন্যজন আইন তুলে নিচ্ছেন
নিজের হাতে। যে দুটোরই ঘোরতর বিরোধী ছিলেন বলে মনে হয় বরুণ। অন্তত চিত্রনাট্য সে
কথাই বলছে।
ছবির শেষ দৃশ্যে বন্ধুবরেষু সহকর্মী
সুপ্রিয়র ক্যামেরা যেভাবে ধরে পুরুলিয়ার ল্যান্ডস্কেপকে। যেভাবে পুলিশ অফিসার
জানায় তার সদ্যজাত ছেলের নাম সে রাখছে বরুণ। আর বিশ্বাসটা রেখে দিচ্ছে মনের মধ্যে।
তখন কলকাতার তথাকথিত আভিজাত্যে মোড়া দর্শকের হাততালিতে গমগম করে ওঠে
মাল্টিপ্লেক্স। বরুণের বিশ্বাসটা মনের মধ্যে দোলাচলতায় মোড়া থাকে। চিনতে পারা আর
না চিনতে পারার খেলাটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না আমরা কেউই। তবুও...এমন একটা বিষয়কে
প্রতিরূপায়ণের সাহসিকতায় একটু পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করে পরিচালকের। কোথাও দক্ষিণের
এক প্রিয় পরিচালক মণিরত্নমের রাস্তায় হাঁটতে দেখি একা রাজকে। শুভেচ্ছায় মোড়া থাকলো
পথটা আপাত জনপ্রিয়তায়। এবং জনপ্রিয় শর্তাবলীর সৌকর্য্যে। কিম্বা চেনা না চেনার
তাৎপর্য্যতায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন