একটা ভাঙা সিনেমা হল এবং মন কেমন...
স্বর্ণাঙ্ককে
বেশ কিছুদিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝেই হাওয়া হয়ে যায় কোথাও। এই রকম প্রায়
হয়। আমরা কেউ খুঁজে পাইনা স্বর্ণাঙ্ককে। তারপর বেশ কয়েকমাস কাটিয়ে একদিন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের চিলেকোঠার মিডিয়া স্টাডিজে দেখি গুটি গুটি পায়ে, লাজুক
মুখে হাজির হয়েছে সে। কিছু বলার আগেই সন্তর্পণে ঝোলার মধ্যে থেকে বের করছে একটা
টিফিন কৌটো, যার মধ্যে ঠাসা আছে ঠাকুমার তৈরী করে দেওয়া নাড়কেল নাড়ু, কিম্বা আনন্দ
নাড়ু। সঙ্গে আরো আছে আমার জন্যে বেশ কিছু ছবি। যেগুলো দেখে স্বর্ণাঙ্ক উত্তেজিত।
কিছু বলতে চায়। কিন্তু চারপাশের লোকজন না দেখলে বলবে কী করে? আর আলোচনাই বা হবে কী
করে? অতএব ছবি দেখাটা চাই। চাই। চাই। শুধু দেখলে হবে না, সেটা নিয়ে লিখতেও হবে।
আমি লিখবো ও পড়বে, তারপর তর্ক করবে। খুবই বিনীত ভাবে। সিগারেট শরীরের পক্ষে খারাপ
সেটাও মনে করাবে, আর বলবে এতো টমাটো শস খান কেনো আপনি? ফিসফ্রাই গলায় আটকাবে আমার। আদি, মৌন,
শুভঙ্করের রাগানোকে একটুও পাত্তা না দিয়ে আমাদের সবার সাথে হাঁটতে থাকবে
কলেজস্ট্রিট পাড়ায়। হয়তো মণি কাউলের সদ্য দেখা ছবি নিয়ে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে
বলতে হাঁটবে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামবে, রাত বাড়তে থাকবে, বইয়ের দোকান গুটিগুটি হাতে বই
তুলবে ফুটপাত থেকে আমাদের আলোচনা থামবে না। কোনো কোনো দিন সেই আড্ডায় অশোকদা এসে
জুটলে আর তো কথাই নেই!
এতো গুলো কথা স্বর্ণাঙ্ককে পরিচয় করানোর জন্য যথেষ্ট
নয়। কারণ আপনি যদি আলাপ না করেন তাহলে বুঝতে পারবে না, সিনেমা ছাড়াও স্বর্ণাঙ্ক আর
কি কি বিষয়ে আগ্রহ রাখে। রাতের কলকাতার একটা আলাদা ভাষা আছে, সেটা বোঝার জন্য
স্বর্ণাঙ্ক সাইকেল নিয়ে রাত-বিরেতে বেরিয়ে পড়ে। কিম্বা হঠাৎই কপিল মুণির আশ্রম
থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে ফোন করে বলে “বুঝলেন...একটা আস্ত ঢপ”। কিম্বা সকালে ফোন
খুলেই অনেক ভোরের এস এম এসে বলে “স্যার ভাবছি এবার জটা রাখবো”। ভারতের
এক প্রথম সারির সরকারী প্রতিষ্ঠিত নাম করা ফিল্ম এবং টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে লেখা
পরীক্ষায় পাশ করে যখন সে ইন্টারভিউতে বসে, এবং নাম করা এক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাকে
যখন প্রশ্ন করে “আচ্ছা বাছা তোমার প্রিয় পরিচালককে কে?” তখন স্বর্ণাঙ্ক
নির্দ্বিধায় বলে দেয়, “ কিছু মনে করবেন না স্যার
আপনার প্রশ্নটাই ভুল! প্রিয় পরিচালক একজন হতে পারে না।” প্রচন্ড তর্ক করে নিজের
ভবিষ্যৎ গেন্ডুলি পাকিয়ে ফিরে আসে। শুনেই মাথায় হাত দিয়ে বসি আমি। ফোনেই
চিৎকার করি। “এটা কি বলেছিস তুই? এরপর ওরা তোকে চান্স দেবে?” দিয়েছিল। এক্কেবারে
লিস্টের শেষের দিকে প্রতীক্ষায় নাম ছিলো। ভর্তি হওয়া হয়নি তার।
স্বর্ণাঙ্ক
ছবি দেখে, ছবি নিয়ে ভাবে, পড়াশুনো করে। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে চায়না। সেদিন
অনেকদিন পরে হঠাৎই স্বর্ণাঙ্কর একটা উড়ো মেইল আসে। “মন খারাপ স্যার। চ্যাপলিনটাকেও
ওরা ভেঙ্গে দিলো। প্রায় একশো ছয় বছরের পুরোনো হলটাও আর থাকলো না। রোজ যাচ্ছি
ওখানে। একটা সিনেমা হলের ভেঙে পড়ার ছবি তুলছি।” অনেক যোগাযোগের চেষ্টা করি
স্বর্ণাঙ্কর সাথে, কিন্তু পাই না তাকে। মোবাইল বেজে যায়। এবারেও হয়তো কোথাও একটা
মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে রেখে ভুলে গেছে নিতে। সাতদিন আগে মোবাইলের খোঁজ পড়বে না।
স্বর্ণাঙ্কর
মন কেমন আমারও মনকে নাড়া দিয়ে যায়। খুলে বসি এলিফিনস্টোন পিকচার প্যালাসের কথা। সামনে
চলে আসেন জামসেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান। কে ছিলেন তিনি? আমার হাতের ছোট্ট চটি বই Centenary celebration of cinema,
nandan (January, 1995) বলছে ১৯০২ সালের কথা। তখন জে এফ ম্যাডানকে কে চিনতো?
সামান্য একজন প্রপ বয়, স্টেজের ছোটোখাটো চরিত্রাভিনেতা। কিন্তু এই সময়েই তিনি
অন্যান্যদের দেখে ময়দানে তাঁবু খাটিয়ে বায়োস্কোপ দেখাতে শুরু করবেন। কিছুদিন পরেই
স্থাপিত হবে ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড। আর কিছু দিনের মধ্যেই জাঁকিয়ে ব্যবসা শুরু
করবে। বইটা লিখছে, “Production-distribution-exhibition empire”। একাধারে ছবির প্রযোজক, এবং প্রদর্শক। গোটা ভারতে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। আর কলকাতায় প্রথম স্থায়ী ভাবে নির্মাণ করছেন প্রথম সিনেমা
হল। নাম রাখছেন এলিফিনস্টোন পিকচার প্যালেস। তাঁবু থেকে বাবুরা এবার এসে ঢুকলেন
সিনেমা হলে। সিনেমাও পেতে শুরু করলো কৌলিন্য। আর তার সেই সদ্য বেড়ে ওঠার বয়সে
একটুও কোথাও বেসুরে কিছু বাজলো না।
পরবর্তী কালে এই হলের নাম দুবার পরিবর্তিত
হয়েছে। এলিফিনস্টোন পালটে রাখা হয়েছে মিনার্ভা সিনেমা। তারপর চ্যাপলিন হল। আর আজ
সেই সিনেমা হলটাও থাকলো না। আমাদের কাছে অন্য অনেক কিছু ফালতুর মধ্যে ভেঙে ফেলা
হলো সেটাকেও। কেউ কোথাও লিখলো না। কেউ কিছু বললো না। একশো ছয় বছরের ইতিহাস মুছে
ফেলা গেলো সহজেই। এখোনো এই মুহূর্তে আমরা পিঠ চাপড়ালামা নিজেরা নি্জেদের। বাংলা
সিনেমার নবজোয়ারে নাকি গঙ্গার দুকূল প্লাবিত হলো। দৃশ্য-শব্দ-কল্প-দ্রুমে একদম একটুও
সিরিয়াস না হয়ে আমরা হ্যা হ্যা করে দন্ত বিকশিত করে বললাম, "বুঝছেন না, এটা বাংলার
নিউ ওয়েভ।"
স্বর্ণাঙ্কর
ফোন তারপর অনেকদিন পাইনি। আজ এই এতো রাতে বাড়ি ফিরে ওর মেইল পেয়েছি। সঙ্গে শুধু কয়েকটি
ছবি। একটা সিনেমা হলের ভেঙে ফেলার মুহূর্ত। এবং একটা ছেলের মন কেমন।
ছবি সৌজন্য
স্বর্ণাঙ্ক
এই দেখাটাও সেই পুরানো ছেলেটার মতো, ওই যে এডিট মেশিনে , সারাদিন এডিট শেষে ঠাণ্ডা- শীতল হাত বাড়িয়ে বলত , "দাদা জমে গেছি একেবারে , রক্ত ঠাণ্ডা মেরে গেছে " ... মুখ টিপে বলতাম ... "এখুনি তিনি আসবেন ...রক্ত কেন মাথাও গরম করে দেবেন ...চল ,চল কফি খেয়ে আসি ..." তারপর সেই বাড়ি ফেরা ...অনেক যুদ্ধ শেষে গাড়ি পেয়ে একসঙ্গে ফেরা ...আর আড্ডার... কথা গুলও...অনুভুতি টা একি রকম !!!
উত্তরমুছুনসব কিছু তোমার মনে আছে? ভালো লাগছে ত্রিদিবদা। এক ঝটকায় ১০ বছর আগে নিয়ে গিয়ে ফেললে! অনেক অনেক ভালবাসা। :)
মুছুন