এক উদ্বাস্তু ছেলের গল্প



বাবা বলেছিলো ভাগ মিলখা ভাগ। পেছনে ফিরে তাকাস না। পেছনে ফিরে দেখতে নেই। তুই ঠিক পালাতে পারবি। তারপরেই দাদুর মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছিলো তারা, যারা এক দিন দেশভাগের হয়ে মত দিয়েছিলো। আর মিলখা হয়ে পড়েছিলো একা। গ্রামের সেই ভরপুর সংসার। মায়ের হাতে খাওয়া। ঠাম্মার আদর সবকিছু টপকে টপকে পেরিয়ে যাচ্ছিলো সে। রক্ত নদীর ধারা অতিক্রম করছিলো তার ছোট্ট ছোট্ট দুটো পা। ভয়ে বিভীষিকায় সে অতিক্রম করছিলো তার দেশ সীমানার গন্ডি। তার কাছে কোনটা তখন পাকিস্তান, আর কোনটা ভারত কোনো কিছু অর্থ রাখে না। হাজার হাজার শরণার্থীর ভিড়ে মিলখা তার গ্রামের নাম লেখাতে গেলে অফিসার হেসে ওঠে। ওটা এখন আর তোর গ্রাম নয়। ওটা এখন অন্যদেশ। এই অন্যদেশে আবার মিলখা ফিরে আসবে। এই অন্যদেশের মানুষ তখন এক নামে মিলখাকে চিনবে। এই অন্যদেশের হাত থেকে ছিনিয়ে আনবে মিলখা সেরা পদকের সম্মান। এই অন্যদেশের ভাঙাবেড়ার পাশে যাদের রক্তাক্ত দেহ অতিক্রম করেছিলো, যাদের বুকের সব স্বপ্ন নিঙড়ে মিলখা পাড়ি দিয়েছিলো তাদের সেই ভাঙা স্বপ্ন সফল করে এক উদ্বাস্তু ছেলে।

যে মিলখার কাছে স্বাধীনতা মানে ছিলো দেশভাগ। যে মিলখার কাছে স্বাধীনতার মানে ছিলো ঘর হারানো। যে মিলখার কাছে স্বাধীনতা মানে ছিলো প্রিয়জনের মৃত্যু, দিনের পর দিন অনাহার। সেই মিলখা একদিন উড়ান দেয়। সেই ঘর হারা, পরিজনহারা, কয়লা চুরী করা ছেলেটা একদিন দেশের হয়ে, সবার হয়ে মাঠে দৌড়োয়। চারশো মিটার দৌড়ে বিশ্ব রেকর্ড ভাঙে। ইন্ডিয়ার লোগো আঁকা কোট গায়ে পড়ে যখন একমাত্র আশ্রয় দিদির কাছে এসে দাঁড়ায় তখন চোখের জল বাঁধ মানে না। কোথাও যেন বৃষ্টি পড়ে। কোথাও যেন মিলখার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে মিখলার শৈশব।
 
এক উদ্বাস্তু ছেলের মন কেমনকে প্রায় তিন ঘন্টা আট মিনিটের সময় বন্ধনীর মধ্যে ধরে রাখলেন রাকেশ ওম প্রকাশ মেহেরা। তিনি মনে করালেন এমন এক সময়কে, এমন এক জীবনকে যাদের কাছে দৌড়োনো মানেই ছিলো প্রাণ নিয়ে বাঁচা। যাদের কাছে দৌড়োনো মানেই ছিলো একবেলা দুধ আর পেট ভর্তি করে খাওয়া। যাদের কাছে দৌড়োনো মানেই ছিল ফেলে আসা স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখা।

জীবনীমূলক ছবি। এমন এক ঘটনাবহুল জীবন, যে জীবনে কোনটা বাদ দেবেন পরিচালক আর কোনটা গ্রহণ করবেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বড় কঠিন। ছবি তাই এখানে বড় শ্লথ। ছবি তাই এখানে বড় অহেতুক গানে ভর্তি। তবে হারানো আর প্রাপ্তির অঙ্কে মিলখার সাথে পরিচালক যেমন ছুটেছেন, এই ছবির রচনাকার যেমন ছুটেছেন, তেমনি ছুটেছেন মূল ভূমিকায় অভিনয় করা ফারহান আখতার। তবুও এই এতো ছোটা কি কখোনো মনকে স্পর্শ করলো? উদ্বুদ্ধ করলো? নাকি দেশভাগের যন্ত্রণাটা আরো বেশি মোচড় দিয়ে গেল অন্যপ্রেক্ষিতে।


আমি ঠিক জানি না।


তবে এটুকু জানি হল থেকে বেরিয়ে আসার পর এই ছবিটা আমি ভুলে যাবো। মনে থাকবে না কিছু। শুধু মনে থাকবে একটা ছেলেকে। যে ছেলেটা যতটা না দেশের জন্য দৌড়ে ছিলো...তার চেয়েও দৌড়ে ছিলো নিজের জন্য। বাঁচার জন্য। দুবেলা-দুমুঠো খাওয়ার জন্য। যে ছেলেটাকে মনে রেখে দিলো সারা বিশ্ব। এতোদিন পরেও। 

যে ছেলেটা আসলে, আদপে ছিলো উদ্বাস্তু।


এই সত্যি কথাটা, সত্যি ভাবে বলার জন্য মনে রাখবো পরিচালককে। আর মনে রাখবো নিজেকে এক যোগ্য অভিনেতাতে পরিণত করার জন্য ফারহান আখতারকে।


ছবিটা হলে গিয়ে দেখুন। তারপর না হয় আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি