শ্রদ্ধা



শ্রদ্ধা
একাদশ শ্রেনীর পড়ার চাপটা তখন একটু বেশি। পুজোর পরেই পরীক্ষা। এদিকে আনন্দবাজার পুজো বার্ষিকীতে বেরিয়েছে নতুন এক লেখকের চিত্রনাট্য। মাঝপথে থামিয়ে তাই একটুও ভূগোল পড়তে ইচ্ছে করছে না। মা-মেয়ের সম্পর্কের টানা পোড়েনে জমে উঠেছে অন্দর। দুটো হাত এক বাড়ির নির্বান্ধব পুরীতে এগিয়ে আসছে একে অপরের কাছে। আমি তন্ময় হয়ে আছি চিত্রনাট্যের নিবিড় পাঠে। ঊনিশে এপ্রিল শেষ হচ্ছে আমার শরতের এক মন কেমনের রাতে। তারও অনেক পরে বালীর রবীন্দ্রভবনে ভিড়ে ঠাসা হলে ছবিটা যখন দেখেছি তখোনো জানি না জীবনে বেশ কিছুবার নানা কারণে এই ছবির নির্মাতার সাথে আমার দেখা হবে। তখনও জানি না, কোনো এক পরিচালকের বাড়ির নাম হতে পারে ‘তাসের ঘর’। তখনও জানি না আমি এই পরিচালকের সাথে তারই শেষ ছবির চিত্রনাট্যের অনুলেখক হবো। গোটা চারটে দিন খুব কাছ থেকে দেখবো একটা মানুষকে। যার সকাল শুরু হয় ভোর বেলা। যে উতকন্ঠায় থাকে “কল্লোল আজ আসবি তো তুই?” কিম্বা যে কারণে অকারণে আমাকে খোঁচা দিয়ে বলে, “তোরা আর কী বুঝবি টেলিভিশন রাইটার কোথাকার।” গায়ে ফোস্কা পড়তো আমার। একটু আধটু ঝগড়া করিনি সেটাও বলতে পারবো না। বানান ভুলে প্রায় তিতি বিরক্ত ঋতুদা একটুও বুঝতে চাইতো না, অনর্গল বলে যাওয়ার সাথে টাইপের কিছু ভুল থাকতে পারে।  
“থামবি তুই? তোর গোড়াতেই গলদ।” 
আমি বলতাম বেশ। তাহলে ডেকেছো কেনো আমাকে?
“নে, তাড়াতাড়ি লেখ। এই শোন...ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছে কী? চুরমুড় খাবি? আমাদের এখানে একটা লোক দারুন চুড়মুড় বানায়।”    

ফেব্রুয়ারির শীত। সোয়েটারের ভেতর দিয়ে একটু একটু কামড়াচ্ছে। তার মধ্যে একবার এসি চালিয়েছে। আর দুবার পাখা। দুপুরে খাওয়া হয়েছে খিচুরী, বেগুনভাজা, মাছ ভাজা, ঘি, আর সঙ্গে আছে চাটনী। নিজেই বেড়ে দিয়েছে আমার প্লেটে। নিজেই বারবার জানতে চেয়েছে “আর কিছু খাবি?” আর আমি দেখছি আমার সামনে একাদশ শ্রেনীর এক ছাত্র পরীক্ষার পড়ার নাম করে রাত জেগে পড়ছে ঊনিশে এপ্রিল চিত্রনাট্য। আমি দেখেছি কি উতসাহ নিয়ে ঋতুদা
পড়েছে আমার লেখা প্রথম মেগা সিরিয়াল অপরাজিতর প্রথম বারোটা এপিসোড। আর যীশু নীলাঞ্জনাকে বলেছে... “ডাকবি একবার কল্লোলকে। দেখবো ছেলেটাকে একবার...”। 

আমরা গেছি। আর শুধুই বকে গেছে আমাকে। কী করে তুই এই ভুলটা করলি? এতো ছটফট করিস কেনো? আরো মন দিয়ে লিখতে হবে। “দেখ এই চরিত্রটা যদি এমনভাবে হয়...”। ঋতুদার সাজেশান আমরা নিইনি তেমন। কিন্তু সামনে থেকে সেই প্রথম দেখেছিলাম ভাষার প্র্তি তার দক্ষতা। অবাধ নিষ্ঠা। মুখে বলে বলে নিমেষে সিকোয়েন্স নির্মাণের মুন্সিয়ানা। আর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা। 

শেষদিন যখন ফিরে আসছি। হাতে তুলে দিয়েছি এইট বি থেকে রাত নটায় দোকান বন্ধ করার আগে তড়িঘড়ি প্রিন্ট করা সত্যান্বেষীর ফাস্ট ড্রাফট। ঋতুদার চোখ চকমক করছে খুশিতে।
“ভাগ্যিস ঝরের মতো টাইপ করলি... টেলিভিশন রাইটার কোথাকার! হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা...তোর লাস্ট ডানকুনি বেরিয়ে যাবে বলে আবার ঘ্যান ঘ্যান করবি।”
আমি বলি...একটু চুপ থেকেই বলি...। ঋতুদা...তোমার ব্যোমকেশের বড় অন্দরে বাঁচার শখ...। সে এতো লোকের মধ্যে থেকেও একা...অজিতের সাথে তার সামান্য রেষারেষি...আর সেই নারী...যে অন্দরের আলোতে উদ্ভাসিত...সেও তো বড় একা...এই একা হওয়ার গল্পর জন্য কি সত্যান্বেষী খুব দরকার ছিলো?
ঋতুদা হাসে...। কোনো উত্তর দেয় না। বসার ঘরটায় সোফার ওপর পা তুলে দেয়। রাজ্যের লোককে এস এম এস পাঠাতে শুরু করে। বাড়ির কাজের ছেলেটি দরজা বন্ধ করে দেয়। পেছন ফিরে দেখি ‘তাসের ঘরে’র আর এক নির্বান্ধব মানুষ রাতে শুতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
একদিন যে ঘুমের মধ্যেই অনেককে নির্বান্ধব করে  চলে যাবে।
খুব ভালো থেকো ঋতুদা।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি