শুভেচ্ছা



দিগন্ত জুড়ে বৃষ্টি নামছে।

ধেয়ে আসছে বৃষ্টি ... ভিজিয়ে দিচ্ছে গাছ... মাঠের ঘাস...দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ঘোড়াটাকে।

ভিজছেন অন্দ্রে রুবলিয়ভ...ভিজছেন তারকভস্কি...ভিজছি আমি...গোটা সাদা পর্দা জুড়ে।

অনেকদিন ছবি আঁকেন না রুবলিয়ভ। চার্চের সাদা দেওয়াল তার দিকে একরাশ বিষাদের হাঁ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আঁকতে পারেন না শিল্পী। তুলির আঁচড়ে কোনো ম্যাজিক খেলে যায় না আর। পাতার পর পাতা বাইবেলে্র গল্প গুলো আর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না শিল্পীকে। থমকে থাকে সব। ঝিরঝিরে বরফ উড়ে বেড়ায়। বড় শীত লাগে রুবলিয়ভের। বড় শীত।

চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে মৃত মানুষ, রক্ত, জান্তব যুদ্ধের করুণ চিহ্ন।
বড় বেশি শত্রুতা, বড় বেশি অবক্ষয় ক্লান্ত করে। অন্তর্গত স্বত্তার কাছে জবাব চান রুবলিয়ভ। পান না। সাদা দেওয়ালের ক্যানভাস কাদায় ভরে।

পরিচালক নিজেও দোটানা সত্ত্বায় অবগুন্ঠিত। রুবলিয়ভের সাথে হাঁটছেন অনেকটা পথ।

মন কী বলছে?

মন কী দেখাচ্ছে? তাঁকেও কি হতে হবে না দেশান্তরিত?

রক্তের বিভীষিকা ... মুখোশ পরা মানুষের ভিড়...ছবি আঁকা আর না আঁকার দন্দ্ব শিল্পী রুবলিয়ভকে একা নিঃস্তব্ধ করে দেয়।

পরিচালককেও।

আমাকেও।

কোথা থেকে চলে আসে সেই ছেলেটা। যে বলেছিলো রাজাকে, সে ম্যাজিক জানে। সে জানে ঘন্টা তৈরীর আদিম পক্রিয়ার ইতিহাস।

শুরু হয় এক নতুন পথ চলা, শুরু হয় এক নতুন আখ্যান। দূর থেকে দেখেন রুবলিয়ভ। দেখেন ছেলেটিকে, তার সাহসকে, তার অনুসন্ধিতষ্ণু শিল্পী মনকে।
ছেলেটা সত্যি একটা কান্ড করে ফেলে। ছেলেটা বানিয়ে ফেলে একটা ঘন্টা।
অথচ যাকে কেউ একটি বারের জন্যও শিখিয়ে দেয়নি ঘন্টা তৈরীর সহজ উপায়ের কথা। কে শেখাবে? তার পূর্বসুরীরা তো কবেই প্লেগে মৃত! বাবা বলে যায়নি কানে কানে কোনো কথা তাকে। এই সৃষ্টি তার নিজের। মাথা উঁচু করে বাঁচার শেষ খড়কুটো।
অনেক রাতে ডনকুনির শেষ লোকালে বাড়ি ফেরার পথে বিপ বিপ করে ওঠে মোবাইল। এস এম এস। “এবার বালি সিনে গিল্ডের বুলেটিন একশো পঞ্চাশতম সংখ্যায় পা দিলো। লেখা চাই।”
আমি হাতড়াই...আমি কাঁদি...আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনে কোনো লেখা ফুটে ওঠে না।

শুধু ভেসে থাকে দিগন্ত জোড়া বৃষ্টি। টোরেন্ট থেকে ডাউনলোড করা রুবলিয়ভের ছবি। আমার না লেখা সত্ত্বার হিসেব নিকেষ।

ভারতীয় সিনেমার একশো বছরে দাঁড়িয়ে অশৌচ লাগে আমার গায়ে।

লেখা ছেড়ে যায় আমাকে।

দিগন্তজোড়া বৃষ্টির মধ্যে আমি হাঁটি... ছুটি... হাতড়াই...আমার সামনের পথটা ধোঁওয়ায় ঢেকে যায়।

মুখোশ পরা মুখ গুলো বলে ভূতই হলো আমাদের ভবিষ্যত। আমি যেন ভুলে যাই আমার ছবি দেখার অতীত। আমি ভুলে যাই সেই ছেলেটাকে যে একদিন বাড়ি ফিরবে বলে আর ফিরে আসেনি। পৃথিবীর পথে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে। আমি ভুলে যাই চলচ্চিত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য। ভুলে যাই ছবি নিয়ে রাত জাগা মানুষ গুলোর কথা। স্বপ্নের কথা। চোখের সামনে এক-একটা হল ভাঙা হয়। গজিয়ে উঠতে থাকে সিড়িঙ্গে ফ্ল্যাট বাড়ি, শপিং মল। বৃদ্ধ করিমচাচাকে দেখতে পাই না আর। যে হাত দিয়েই ফিল্মের রোলটা গুটিয়ে নিতো অনায়াসেই। যাকে কোনোদিন ফিল্ম স্কুলে যেতে হয়নি। যে আমাকে সেই আলোছায়ার ঘরের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলো। প্রজেক্টারের সেই ঝিম ধরা আওয়াজ, ফিল্মের গা থেকে উঠে আসা গন্ধ আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো অনেক দূর। চলচ্চিত্র বিদ্যা পাঠের আঙিনায়। করিম চাচারা যত হারিয়েছে, রাজু ব্ল্যাকাররা যত মারা গিয়েছে তত মাল্টিপ্লেক্স গজিয়েছে। আমার বালির চটকল ঘেরা ধূসর গঙ্গার পাড়ের শ্রীকৃষ্ণ সিনেমা হলের ছোটবেলার রাজু, করিম চাচারা তত হারিয়েছে। আর আমাদের মাল্টিপ্লেক্স গুলো ভরে উঠেছে, উপচে উঠেছে দর্শকে। আর সংবাদ পত্রে খিল্লি করছে যেন কেউ। সত্যজিতের ছবির পাশে ঠ্যাং তুলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এখনকার প্রজন্ম! “হ্যাঁ দাদা, হ্যাঁ দিদি, এটা বাংলা ছবির নিউ ওয়েভ। আর এক প্যাকেট ফিংগার চিপস নেবেন? পপ কর্ণ...বাটার লাগিয়ে? কোনের দিকে সিটটা নিতে পারেন স্যার...ওখানে অন্ধকারটা বেশি...বে-আব্রু নয় ওখানে সব কিছু...।” সবটা ইংরাজিতে বলে ছেলেটা। মাল্টিপ্লেক্সে টর্চ দেখিয়ে সিট দেখায়।

আমার রাজুর কথা মনে পড়ে।
করিমচাচার গা থেকে আতরের গন্ধ চাপা পড়ে ফিল্মের ক্যানের গন্ধ ছাপিয়ে যায় আমার ঘর। 
বাজ পড়ে। বৃষ্টি আসে তেড়ে। নৌকা দুলে ওঠে। খেয়া ঘাটের শেষ নৌকাটাও ছেড়ে চলে যায়। লেখা ফিরে আসে না।
জানি হয়তো আসবে না আর। অন্যকোথাও থাকবে...অন্য কারো সঙ্গে।

তার হয়তো নতুন পথে চলা শুরু।

সে চলবে তার মতো আর আমরা একে ওপরের পিঠটা জোরে চাপড়িয়ে দেবো। মিথ্যে কথা বলবো, ভুয়ো প্রশংসা কুড়োবো। জাতীয় পুরষ্কারের নামে লোক ঠকাবো! হিংসে করবো। নখ দাঁত বের করে হায়না হয়ে যাবো সবাই।

তোমার কি খারাপ লাগছে সিনে গিল্ড বালি? এইসব কথায়। এই ছন্দপতনের আতিশয্যে।

ভাবছো, কেনো আমার মুখে আটকানো আছে মুখোশ? আমার হাতে মিথ্যের কি-প্যাড? আমার ঠোঁটে হিংস্র হাসি? যেনো এটা আমার রঙ্গ মঞ্চের মোহড়া। যেন এখনি শেষ দৃশ্য অভিনীত হবে। যেনো আমিও অপেক্ষায় আছি দিগন্ত জোড়া বৃষ্টির। অপেক্ষায় আছি রঙ ধুয়ে যাবার।
ভাবছো এতোটা পথ পেরিয়ে কী পেলে তুমি সিনে গিল্ড বালি?

আমি যদি বলি একশো পঞ্চাশ বুলেটিনের অনন্ত পথ চলা। সেই বৃষ্টিভেজা দিগন্ত, সেই মনকেমনের বিকেল। একদল মানুষের ঘর-সংসার ভুলে তোমাকে নিয়ে মেতে ওঠা। চোখে আদিগন্ত সাদা পর্দার কালো হয়ে ওঠার স্বপ্ন।

শুভেচ্ছা তোমাকে সিনে গিল্ড বালি।

তোমার তারুণ্যের এই দিগ্বিজয়ের দৌড়ে অনেক দূরে বড় মন্থরে হাঁটছি আমি। সারা গায়ে আমার অশৌচের ছোঁওয়া।

জানি বষ্টি আসবে একদিন। ধুয়ে যাবে সব কিছু। ঠিক আগের মতো না হলেও নতুন ডালপালা গজাবে আমার। হ্যাঁ নিশ্চিত...তোমার চলার পথে ধরেই।

বালি সিনে গিল্ডের একশো পঞ্চাশ তম বুলেটিনে প্রকাশিত।

ছবি কৃতজ্ঞতা- 
সুস্মিতা দাস।
মিডিয়া স্টাডিজঃ ফিল্ম এবং টেলিভিশন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি