দেশ বদল... রেশ বদল...



যে পরিসরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি...যে স্থান কাল আমাকে মনে করাচ্ছে আমার সময়কে...দেশকে...জন্মভূমিকে তাকে আমার জানা বোঝার চৌহদ্দির মাঝে নানা রূপে, নানা ভঙ্গিমায়, নানা চিহ্নে ধরা দিচ্ছে সাদা পর্দা। কোথাও প্রত্যক্ষ আবার কোথাও বা পরোক্ষভাবে। ভালো লাগা মুহূর্ত গুলো ফিরে ফিরে আসছে আখ্যানে, অভিব্যক্তিকে, চিত্রনাট্যের কাঠামোয়। প্রশ্ন উঠছে, আর মিশে যাচ্ছে প্রাত্যহিকতায়। রাষ্ট্রের কাছে, শাসনের কাছে, আইন বলয়ের সুরক্ষিত ব্যবধানের মধ্যে দাঁড়িয়েও ‘দেশ’ নামক এক পরিসর নির্মাণ করছে হিন্দি চলচ্চিত্র তার সদা বহমান ঐতিহ্যের ধারায়। একশো বছরের শেকড় বাকড় গায়ে জড়িয়ে যে আলো আর শব্দের চিত্রমালা আমাদের মনোরঞ্জনের, অবলোকনের হদিস দিচ্ছে তাকে আর চব্বিশ ফ্রেমের গন্ডির মধ্যে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সমাজ তত্ত্বের আঙিনায় চিহ্নে, সংকেতে, সাম্প্রতিক মুহূর্তে সে যেন আমাকে শুনিয়ে চলেছে আমারই দেশকে “ভালো লাগার”, “ভালোবাসার” আপাত অর্থে সহজ অথচ কঠিন পাঠ। দেশ বলতে আমি যা বুঝি আমার দেশ হারানো ঠাকুমা তা বুঝতো না। আমার পিসির কাছে দেশ মানে ছিলো দেশভাগ। বাবার কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল উচ্ছেদ। হঠাৎ এক রাতের মধ্যে গায়ে জোর করে সাঁটিয়ে দেওয়া ‘উদ্বাস্ত’ চিহ্ন। কিন্তু সেতো আমার গল্প। আর সাদা পর্দার? নেই একেবারে তা নয়। কিন্তু দেশভাগের, স্বাধীনতার, শহীদদের গল্প একটু দূরে সরিয়ে রাখবো আমরা। কারণ দেশ প্রেম সেখানে সরাসরি আলোচ্য, কেন্দ্র বিন্দুতে তার স্থান। ‘গরম হাওয়া’কে তাই শ্রদ্ধাবনত স্যালুট জানিয়ে আমরা ঝুঁকবো সাম্প্রতিকতায়। ঘুরে বেড়াবো জনপ্রিয় হিন্দি ছবির আঙিনায়।

গ্রাম থেকে কোনোদিন বেরোয়নি মেয়েটা। জানে না নিজের মাতৃভাষা তামিল ছাড়া অন্য কিছু। বিয়ে হয়ে যায় দিদিকে দেখতে আসা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ঋষিকুমারের সাথে। আর বরের  কার্যসূত্রে প্রায় স্বইচ্ছায় তাকে পাড়ি দিতে হয় কাশ্মীর। ভারতের সেই উপত্যকায় যেখানে অবিরত নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহে চলছে ধ্বংস আর সৃষ্টির এক যজ্ঞলীলা। সেখানে হঠাৎই ঋষিকুমারকে কিডন্যাপ করে টেররিস্টরা। মেয়েটি হন্যে হয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে খুঁজে বেড়ায়, দরবার করে। আর অন্যদিকে ঋষিকুমার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে নিজ মাতৃভূমিতে টেররিস্ট হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তার স্বামীকে ফিরে পায়। ঋষিকুমার মুক্ত হয়। আর হিন্দি ছবির ইতিহাসে চিরকাল সবার মনে থেকে যায় সেই মিষ্টি মেয়েটিকে যার নামে ছবির থিম মিউজিক হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে কিম্বা খেলার মাঠে গুনগুন করে ওঠে বন্ধুরা, “রোজা জানেমান তু হ্যায় মেরা দিল...”।  ১৯৯২ সালের কোন এক দুপুরে ক্লাস কেটে ছবিটা দেখে এসে আবার যেন মন কেমন করে ওঠে মেয়েটার জন্যে। পড়ার ফাঁকে, টেস্ট পরীক্ষার রাত জাগায় ফিরে ফিরে আসে রোজা। বড় দেখতে ইচ্ছে করে সেই মেয়েটাকে যে হিন্দি জানে না, ইংরাজী জানে না; সে রাষ্ট্র বোঝে না, সরকার বোঝে না শুধু বোঝে তার প্রিয়জনকে। আর তার প্রিয়জন ঋষিকুমার চায় রাষ্ট্রের উন্নতি। ঋষিকুমার ঝাঁপিয়ে পড়ে জ্বলন্ত তেরঙা ভারতীয় পতাকার ওপর, দেশকে বাঁচাতেই হবে। হাততালি দিয়ে ওঠে গোটা হল। রোজার মন কেমনের মানুষটা তখন অন্যরকমের। মণিরত্নম তাঁর দ্বিভাষিক ছবির নির্মাণে গ্রাম আর শহরের দিগবলয়ের পার্থ্যকের চিহ্নায়ন করেন এইভাবে। রোজার কাছে দেশ মানে তার গ্রাম, নিজের কৌম। আর তার স্বামীর কাছে দেশ মানে রাষ্ট্র তার প্রতি শিক্ষিত নাগরিকের কর্তব্য। এক ভালোবাসার গল্পের মাঝে, শহর আর গ্রামকে মিলিয়ে দেবার ফাঁক ফোঁকড়ে, সারল্য আর জটিলতার মেলবন্ধনে মণিরত্নমের ছবিতে কোথাও দেশ একটা বড় জায়গা দখল করে নেয়। এর আগের হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসের প্রবহমানতায় চলে আসা ‘ধরতি কি লাল’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’ কিম্বা মনোজ কুমারের সব দেশপ্রেমের ছবি থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র করে রোজা। ঋষিকুমার উঠে আসেন ভারতের রাজনীতির সেই থরহরি কম্পমান এক অনন্য প্রেক্ষিত থেকে, যেখানে সেই সময়ের জ্বলন্ত কাশ্মীরকে ধরতে চেষ্টা করেন মণিরত্নম। ঋষিকুমার হয়ে ওঠেন সেই নব্বইয়ের দশকের তরুণদের মনের খুব কাছের মানুষ। যে পতাকার মান-মর্যাদা রক্ষা করে। যার কাছে দেশের জন্য সব কিছুই তুচ্ছ। যে একই সাথে ভালোবাসে গ্রামকে, শহরকে। ভালোবাসে তার দেশকে। নিজের আদর্শকে।


কিন্তু ঠিক এর চোদ্দ বছর পরে ২০০৬ সালে চারজন তরুণ এসে পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়। ডিজে, করণ, আসলাম, আর সুখী। যাদের কাছে জীবনটাই ধরা আছে বিয়ারের বোতলে, উদ্দেশ্যহীনতায় আর বড় একান্ত অবসাদে। বাইরে থেকে উড়ে আসা ব্রিটিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা সু ম্যাকিনলি হঠাৎই আবিষ্কার করে এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং, শিবরাম রাজগুরু আরো অনেকে। যাদের কথা লিখে রেখে গেছেন তার ব্রিটিশ আমলের জেলার দাদু। সু এদের অভিনয় করতে উৎসাহিত করে তার তথ্যচিত্রে। আর ঠিক তখনি ঘটে যায় ম্যাজিক পরিবর্তন। ছেলেগুলোর মাঝে আস্তে আস্তে এসে বাসা বাঁধেন সেই কবেকার মরে যাওয়া শহীদরা। পরিবর্তন হয় তাদের মননের, জীবনের, দৃষ্টিভঙ্গীর। জীবনের চড়াই উৎরাইয়ে তারা প্রশ্ন করতে শেখে। এক মোক্ষম বাঁকে এসে তারা ঘুরে দাঁড়ায়। সিস্টেমের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। তাদের বিপ্লবের দাম মেটাতে হয় ছবির শেষে প্রান দিয়ে। ‘রঙ দে বসন্তির’ শেষে তাই লাশের পাহাড় টপকেও কোথাও যেন জীবন বিমুখতা আমাদের ঘিরে থাকে না। বরং তারুণ্যের দেশপ্রেমের টগবগে রক্তে রঙীন হয়ে ওঠে রাকেশ ওম প্রকাশ মেহরার ছবির প্রতিটা ফ্রেম। বিশ্বায়ণের ছোট্ট গ্রামে হাতে পপকর্ণের ঠোঙা নিয়ে বসা তারুণ্য প্রতি পদে রিলেট করলো সেই উদ্দাম জীবনকে যাদের আচার ব্যবহার থেকে তারা শত সহস্র যোজন দূরে থাকলেও তাকে পাওয়ার খোয়াব তারা দেখে চলে অবিরত।

খোয়াব তো দেখে সবাই। কিন্তু বাস্তবে রূপায়ণ করে কজন? ‘রঙ দে বসন্তির’ ঠিক দু বছর আগে সাদা পর্দায় নাসার বিজ্ঞানী মোহন ভার্গবকে দেশে ফিরে আসতে হয় নিজের ছোটবেলার সেই ধাই মা কাবেরী আম্মার কাছে। উদ্দেশ্য বুড়িকে নিজের কাছে নিয়ে রাখা। যত্ন করা। মায়ের আদরের মনকেমন মোহনের সারা শরীর জুড়ে। কিন্তু কাবেরী আম্মা তার সামনে স্বদেশের যে আঁচল বিছিয়ে দেন, গরীব ভারত মায়ের যে চিত্রলিপি ফুটে ওঠে মোহনের সামনে সেখান থেকে আর ফিরে যেতে পারেনা আমেরিকায়। ‘স্বদেশ’ কোথাও যেন দেশে ফিরে আসার ডাক পাঠায় তরুণ বিজ্ঞানীকে। আশুতোষ গোয়ারিকর তাই তাঁর জনপ্রিয় ছবি ‘লগানে’র সরাসরি দেশপ্রেমের থিমকে ঘুরিয়ে ধরেন দ্বিতীয় ছবি স্বদেশে। তরুণ বিজ্ঞানীর দেশে ফেরার গল্প  ইঙ্গিত পাঠায় জনপ্রিয় ছবির আঙ্গিকে। 


সেই রেখার ক্ষীণ সূত্র ধরে না হলেও এক কিশোরের স্বপ্নে ভর করে ২০১২ সালে মুক্তি পায় নাসার বিজ্ঞানী বেদব্রত পাইনের ছবি চিটাগং। ঝঙ্কু, মাষ্টারদাকে খুব কাছ থেকে দেখে। বাবার নিষেধ স্বত্ত্বেও সে নাম লেখায় মাষ্টারদার দলে আর ইতিহাস কাঁপানো চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের শরিক হয় সে। ছবিটা যদি এখানেই শেষ হত তাহলে আর পাঁচটা হিন্দি ছবির মধ্যে গুলিয়ে ফেলা যেত অনায়াসে। কিন্তু যে স্বপ্নের রক্তিম আলোয় বেদব্রত হাত ধরেন ঝঙ্কুর সেই আলো তাকে পৌঁছে দেয় তেভাগার আন্দোলনে। হাজার হাজার কৃষকদের মাঝে আমরা আবার ফিরে পাই সেলুলার জেল ফেরত স্বাধীন ভারতে পা রাখা তরুণ ঝঙ্কুকে। তারুণ্যের জয়গাথা গাওয়া হয় গোটা পর্দা জুড়ে। আর কোথাও যেন সাদা পর্দা আমাদের কাছে বার্তা পাঠাতে শুরু করে সময় এসেছে দিন বদলের।

 
  (সংবাদ প্রতিদিনে প্রকাশিত, মে, ২০১৩)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি