গয়নার বাক্স
পাঁচশো ভরির সোনা কোনদিন দেখিনি। সাতনলির হার আমাদের পূর্বপুরুষদের
ছিলো না। বড় খিলান ওয়ালা বাড়ি পায়নি আমার ঠাম্মা, মণি (পিসি), বড়মারা। ওপার
বাংলা থেকে এসে এপারে উঠতে হয়েছিল উদ্বাস্তু হয়ে। কিন্তু সঙ্গে করে যেটা
নিয়ে এসেছিল সেটা বড় কমন। বৈধব্য। সাদা থানে মুড়ে দুই অল্প বয়স্ক বিধবাকে
নিয়ে আমার পঞ্চাশ পেরোনো আর এক বিধবা ঠাকুমা সীমান্ত পেরোচ্ছিলনে ষাটের
দশকের শেষের দিকে। নিজের দেশের, যে দেশটাকে ঠাকুমা মনে করতেন তাঁর
শ্বশুরের ভিটে তাকে শেষবারের মতো বিদেয় জানিয়ে লক্ষ্মীর ঝাঁপি, আর একটা বড়
এ্যালুমনিয়ামের কৌটো হাতে করে দুই বিধবাকে নিয়ে ঠাকুমা পার হয়েছিলেন নিজের
দেশ থেকে পরের দেশে। বাড়ির যে কয়েকজন পুরুষ বেঁচে ছিলেন তাঁরা সবাই তখন
এদিকে। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করার খবর পেয়ে এক ছানি
কাটানোর রিলিফ ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে ঠাকুমা আর চোখ খোলেননি। বাংলার মাটি
বাংলার জল... নদীতে...ধানের ক্ষেতে...ফলসা গাছের হাওয়ায় পাক খেতে খেতে লাট
খাওয়ার আগেই ঠাকুমা টাটা বাই বাই করেছেন। আর নতুন বৌ আমার মায়ের হাতে তুলে
দিয়ে গেছেন দেশ থেকে আনা সেই বড় এ্যালুমিনিয়ামের কৌটোটা। আমি যতবারই
দেখেছি ততবারই কৌটোটা ফাঁকা। আর ওটাকে ঘিরে আমার বাবার, আমার কাকুর জমানো
ছিল অনেক গল্প। ওটাতে আমার ঠাকুমার গয়না থাকতো। সেই গয়নার চুরী
যাওয়ার...ধার শোধ করতে কোন এক অজ গাঁয়ের আমার দাদুর বন্ধক রাখার সব রোমাঞ্চকর গল্প বাবা, কাকার মুখে ঘুরতো। খুব ছোট্ট
বয়সে নবদ্বীপ থেকে বাবার হাত ধরে আমার ঠাকুমার খুলনার এক অখ্যাত গ্রাম
কোলাপোতায় শ্বশুরের বাড়ি চলে এসেছিলেন। এইসব অনেক কিছুর সাক্ষী ওই নক্সা কাটা
এ্যালুমনিয়ামের কৌটো। খালি কৌটো হাতে পেয়েও আমার মায়ের কোনদিন কোন অভিযোগ
ছিল না। ওটা তোলা ছিলো ঠাকুরের বাসনের সিন্ধুকে। এখনও আছে দিব্বি।
কিন্তু এটা বলার জন্যেই এই লেখার অবতারণা নয়। গয়নার বাক্স দেখতে দেখতে আমার খুব ঝাপসা মনে পড়ার ঠাকুমাকে, মণিকে কেমন যেন বারবার দেখে ফেলছিলাম। সাতমহলা মুর্শিদাবাদের বাড়ি ছেড়ে আমার অষ্টাদশি দিদাও কি সাদা পর্দার আড়াল থেকে দেখে চলছিল সমানে? এক বারো বছরের বিধবার গয়নার বাক্স আমাকে মনে করালো অনেক কিছু। মনে করালো এটাও সিনেমার গম্ভীর নিবিড় পাঠ থেকে সরে এসে আপাত জনপ্রিয় আঙ্গিকেও কত শক্ত কথাও এক নিমিষে বলে দিতে পারেন অপর্ণা সেন। তার প্রধান চরিত্র কেমন ভাবে ভয়ে ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে উচ্চারণ করে "তুমি না পুরুষ সিংহ''? বার বার নিষ্কর্মা, বহাল তবিয়তে থাকা জমিদার বাড়ির পড়ন্ত চিহ্ন গুলো ফুটে ওঠে দুই প্রজন্মের নারীর মুখোমুখি বসিবার অছিলায়। একজন মৃত। বারো বছরে বিধবা হয়ে যার চাওয়া পাওয়া বলতে শুধুই ওই পাঁচশো ভরির গয়নার বাক্স। যে গয়না দিতে তার কার্পণ্যের আর শেষ থাকে না। লিস্ট করে রাখা গয়নাতে ঢ্যাঁড়া দেন। আর অন্য দিকে তার নাতনি প্রতিম বাড়ির সবার চাইতে ছোট বউ।
একদিন ডাক সাইটে পিসিমা মারা যান। আর সাধের গয়নার বাক্স ছেড়ে নড়তে পারে না তাঁর অনেক কিছু না পাওয়া আত্মা। ছোট বউকে তিনি সরিয়ে ফেলতে বলেন তাঁর সেই সাধের গয়নার বাক্স। না হলে বাড়ির হা হাবাতে হাড়ে বজ্জাতে অকর্মণ্য পুরুষরা সব বিক্রি করে দেবে। গয়নার বাক্স সরিয়ে ফেলে বাড়ির সেই ছোট্ট কচি বউটা। আর তারপর থেকেই ঘুরতে শুরু করে গল্পের গতি ধারা। এক ভূত পূর্ব সময় সারা শরীরে না পাওয়ার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নতুন সময়ের কাছে। দুই মহিলার দুই বিপরীত মেরুর গল্প নিয়ে পথ চলতে চলতে পরিচালক মেশান একে অপরকে। একের না মেটা আশা যেন অন্যের ইচ্ছা ডানায় ভর করতে থাকে। বারো বছরে যে মেয়ে বিধবা হল। আঠারো বছরে যে মেয়ে শরীরের সাধ বুঝতে চাইলো, আর সারা জীবনের আলোচালের ভাতে হবিষ্যি করলো সেই মেয়ের কাছে দরজা খুলে দিল তার তোতলানো, অল্পতে ভয় পাওয়া বাড়ির সবচেয়ে কচি বউটি। বাড়ির পুরুষ সিংহদের সামনে তার বরকে দিয়ে একটা কাপড়ের দোকান খোলালো। পিসিমার গয়না বন্ধক পড়লো। আর ভূতের আঠারো ঘা পড়লেও যাকে কেউ হারাতে পারলো না। পিসিমা রাসমণির নামে দোকান হওয়ার পর, সেই প্রেত বিধবার চোখ ছলছল করে উঠলো। সারা কাপড়ের দোকান ঘুরে ঘুরে সাদা থানে মোড়া জীবনটা পড়ে দেখতে চাইলো বালুচরী, বেনারসি, ঢাকাই আরো কতকি! নানা মিষ্টি, মজার মুহূর্তে গাঁথা থাকলো গয়নার বাক্স।
মায়ের গল্প বলতে বসে মেয়েকেও কি বাদ দিলে চলে? না বাদ যায়নি। স্বাধীনতার ঠিক দুবছর পর নাতবৌয়ের বাড়িতে প্রবেশের থেকে যে গল্পের অবতারণা তার নিবিড় পাঠ বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে সত্তর দশকের প্রথম পর্যায়টুকু ছোঁয়। পিসিমার গয়না কাজে লাগে মুক্তিযুদ্ধের কোন একটা অংশের খরচ হিসেবে। প্রেত তাই এতেই সুখী হয়, "ফরিদপুরের বাড়িটা তো বাঁচলো"। এক মজার নক্সাতে বুনতে বুনতে কাহিনীর খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে, সমাজ ব্যাবস্থার সেই সেকেলে নিয়ম গুলোকে সযত্নে, চোখে আঙুল দিয়ে প্রশ্ন করতে করতে পরিচালক যখন হঠাতই মুক্তি যুদ্ধে আসেন, ছবির শেষ কুড়ি মিনিট তাই একটু শ্লথ হয়ে পড়ে। শেষের সিরিয়াসনেসটা তখন আর গায়ে মাখতে চায় না। ইচ্ছে করে না নাতবৌয়ের মেয়ের সাথে পিসিমার সময় কাটনো, হুঁকো বনাম সিগারেটের মেলবন্ধন দেখতে। ছবির গায়ে নক্সা যেমন চোখে পড়ে। বেমানান কিছু ডিটেল বড় চোখে লাগে। তার সাথে হঠাতই উড়ে এসে জুড়ে বসা কৌশিক সেনের চরিত্রও। কারণ তার অনেক আগেই নাত বৌ কঙ্কণা আমাদের পুরুষ সিংহদের চিনিয়ে দিয়েছে। বাড়ির ক্ষয়ে যাওয়া অন্দর মহলে শুরু হয়েছে বিপ্লব। তখন তার এক বাড়তি উঠতি প্রেমিক নাই বা থাকলো। সব সময় পরিচালকের নিজের কাছে নিজের জবাবদিহি নাই থাকলো। ভালোবাসার পরপম্পরায় ততক্ষণে কঙ্কণা আমাদের হৃদয়ে।
মাংসের গন্ধ শোঁকা বিধবা পিসিমা মনে করাচ্ছে আমার ছোটবেলাকে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখেফেলি আমার বিধবা মণি (পিসি) লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ খাচ্ছে বাটি থেকে। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত মণি কিছু বলতে পারে না। তার ছলছলে চোখটা আমার আজও চোখের সামনে ভাসে। অনেক রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম না আসার ফাঁকে মাকে যখন বলি। মা মুখে হাত চাপা দেয়। ফিসফিস করে বলে, "কাউকে বলিস না টুকনু।" আমি কাউকে বলিনি। এতোদিন। কিন্তু আমার মা তারপর থেকে একটা মাছের পিস বাজার থেকে বেশি আনতে দিত। সবার অলক্ষ্যে রাখা থাকতো রান্নাঘরে। মা আর মণিও তো ছিলো দুই বিপরীত প্রজন্মের। শুধু এই যা তাদের সাত মহলা ছিলো না। আর গয়নার বাক্সে ছিল না এক ছিঁটে ফোঁটাও গয়না। শুধু সেখানে রাখা ছিল ঠাম্মার দেশের মাটি।
কিন্তু এটা বলার জন্যেই এই লেখার অবতারণা নয়। গয়নার বাক্স দেখতে দেখতে আমার খুব ঝাপসা মনে পড়ার ঠাকুমাকে, মণিকে কেমন যেন বারবার দেখে ফেলছিলাম। সাতমহলা মুর্শিদাবাদের বাড়ি ছেড়ে আমার অষ্টাদশি দিদাও কি সাদা পর্দার আড়াল থেকে দেখে চলছিল সমানে? এক বারো বছরের বিধবার গয়নার বাক্স আমাকে মনে করালো অনেক কিছু। মনে করালো এটাও সিনেমার গম্ভীর নিবিড় পাঠ থেকে সরে এসে আপাত জনপ্রিয় আঙ্গিকেও কত শক্ত কথাও এক নিমিষে বলে দিতে পারেন অপর্ণা সেন। তার প্রধান চরিত্র কেমন ভাবে ভয়ে ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে উচ্চারণ করে "তুমি না পুরুষ সিংহ''? বার বার নিষ্কর্মা, বহাল তবিয়তে থাকা জমিদার বাড়ির পড়ন্ত চিহ্ন গুলো ফুটে ওঠে দুই প্রজন্মের নারীর মুখোমুখি বসিবার অছিলায়। একজন মৃত। বারো বছরে বিধবা হয়ে যার চাওয়া পাওয়া বলতে শুধুই ওই পাঁচশো ভরির গয়নার বাক্স। যে গয়না দিতে তার কার্পণ্যের আর শেষ থাকে না। লিস্ট করে রাখা গয়নাতে ঢ্যাঁড়া দেন। আর অন্য দিকে তার নাতনি প্রতিম বাড়ির সবার চাইতে ছোট বউ।
একদিন ডাক সাইটে পিসিমা মারা যান। আর সাধের গয়নার বাক্স ছেড়ে নড়তে পারে না তাঁর অনেক কিছু না পাওয়া আত্মা। ছোট বউকে তিনি সরিয়ে ফেলতে বলেন তাঁর সেই সাধের গয়নার বাক্স। না হলে বাড়ির হা হাবাতে হাড়ে বজ্জাতে অকর্মণ্য পুরুষরা সব বিক্রি করে দেবে। গয়নার বাক্স সরিয়ে ফেলে বাড়ির সেই ছোট্ট কচি বউটা। আর তারপর থেকেই ঘুরতে শুরু করে গল্পের গতি ধারা। এক ভূত পূর্ব সময় সারা শরীরে না পাওয়ার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নতুন সময়ের কাছে। দুই মহিলার দুই বিপরীত মেরুর গল্প নিয়ে পথ চলতে চলতে পরিচালক মেশান একে অপরকে। একের না মেটা আশা যেন অন্যের ইচ্ছা ডানায় ভর করতে থাকে। বারো বছরে যে মেয়ে বিধবা হল। আঠারো বছরে যে মেয়ে শরীরের সাধ বুঝতে চাইলো, আর সারা জীবনের আলোচালের ভাতে হবিষ্যি করলো সেই মেয়ের কাছে দরজা খুলে দিল তার তোতলানো, অল্পতে ভয় পাওয়া বাড়ির সবচেয়ে কচি বউটি। বাড়ির পুরুষ সিংহদের সামনে তার বরকে দিয়ে একটা কাপড়ের দোকান খোলালো। পিসিমার গয়না বন্ধক পড়লো। আর ভূতের আঠারো ঘা পড়লেও যাকে কেউ হারাতে পারলো না। পিসিমা রাসমণির নামে দোকান হওয়ার পর, সেই প্রেত বিধবার চোখ ছলছল করে উঠলো। সারা কাপড়ের দোকান ঘুরে ঘুরে সাদা থানে মোড়া জীবনটা পড়ে দেখতে চাইলো বালুচরী, বেনারসি, ঢাকাই আরো কতকি! নানা মিষ্টি, মজার মুহূর্তে গাঁথা থাকলো গয়নার বাক্স।
মায়ের গল্প বলতে বসে মেয়েকেও কি বাদ দিলে চলে? না বাদ যায়নি। স্বাধীনতার ঠিক দুবছর পর নাতবৌয়ের বাড়িতে প্রবেশের থেকে যে গল্পের অবতারণা তার নিবিড় পাঠ বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে সত্তর দশকের প্রথম পর্যায়টুকু ছোঁয়। পিসিমার গয়না কাজে লাগে মুক্তিযুদ্ধের কোন একটা অংশের খরচ হিসেবে। প্রেত তাই এতেই সুখী হয়, "ফরিদপুরের বাড়িটা তো বাঁচলো"। এক মজার নক্সাতে বুনতে বুনতে কাহিনীর খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে, সমাজ ব্যাবস্থার সেই সেকেলে নিয়ম গুলোকে সযত্নে, চোখে আঙুল দিয়ে প্রশ্ন করতে করতে পরিচালক যখন হঠাতই মুক্তি যুদ্ধে আসেন, ছবির শেষ কুড়ি মিনিট তাই একটু শ্লথ হয়ে পড়ে। শেষের সিরিয়াসনেসটা তখন আর গায়ে মাখতে চায় না। ইচ্ছে করে না নাতবৌয়ের মেয়ের সাথে পিসিমার সময় কাটনো, হুঁকো বনাম সিগারেটের মেলবন্ধন দেখতে। ছবির গায়ে নক্সা যেমন চোখে পড়ে। বেমানান কিছু ডিটেল বড় চোখে লাগে। তার সাথে হঠাতই উড়ে এসে জুড়ে বসা কৌশিক সেনের চরিত্রও। কারণ তার অনেক আগেই নাত বৌ কঙ্কণা আমাদের পুরুষ সিংহদের চিনিয়ে দিয়েছে। বাড়ির ক্ষয়ে যাওয়া অন্দর মহলে শুরু হয়েছে বিপ্লব। তখন তার এক বাড়তি উঠতি প্রেমিক নাই বা থাকলো। সব সময় পরিচালকের নিজের কাছে নিজের জবাবদিহি নাই থাকলো। ভালোবাসার পরপম্পরায় ততক্ষণে কঙ্কণা আমাদের হৃদয়ে।
মাংসের গন্ধ শোঁকা বিধবা পিসিমা মনে করাচ্ছে আমার ছোটবেলাকে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখেফেলি আমার বিধবা মণি (পিসি) লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ খাচ্ছে বাটি থেকে। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত মণি কিছু বলতে পারে না। তার ছলছলে চোখটা আমার আজও চোখের সামনে ভাসে। অনেক রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম না আসার ফাঁকে মাকে যখন বলি। মা মুখে হাত চাপা দেয়। ফিসফিস করে বলে, "কাউকে বলিস না টুকনু।" আমি কাউকে বলিনি। এতোদিন। কিন্তু আমার মা তারপর থেকে একটা মাছের পিস বাজার থেকে বেশি আনতে দিত। সবার অলক্ষ্যে রাখা থাকতো রান্নাঘরে। মা আর মণিও তো ছিলো দুই বিপরীত প্রজন্মের। শুধু এই যা তাদের সাত মহলা ছিলো না। আর গয়নার বাক্সে ছিল না এক ছিঁটে ফোঁটাও গয়না। শুধু সেখানে রাখা ছিল ঠাম্মার দেশের মাটি।
দারুন লাগলো।
উত্তরমুছুন