মেঘে ঢাকা তারা


এই ছবি ক্লাসিক নয়। এই ছবি বাংলা সিনেমার ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলা ছবির ভাঙা হাটে অনেকদিন পর বহু প্রচলিত ক্লিশে গুলোকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন কমলেশ্বর। ফিরিয়ে নিয়ে এলেন সিনেমা আর থিয়েটারকে পাশাপাশি রেখে। ফিরিয়ে নিয়ে এলেন অনেক দিন পরে স্থান এবং সময়কে ভেঙে দেওয়ার পিয়ানো সিকোয়েন্স। আখ্যান থেকে ভেঙে, গল্পকে মাঝপথে থমকে দাঁড় করিয়ে সীমান্তের কাঁটাতার ভেদ করে ছুটে এলো মানুষগুলো। ক্যামেরা গতিজাড্যের সমান্তরাল রৈখিক পথ ছেড়ে বড় বড় ক্লোজ আপে ভেঙে দিতে থাকলো স্থানকে, সাদা কালো ছবির বর্ণমালায়।

এই ছবি ঋত্ত্বিক ঘটকের জীবনী নয়। ছবির প্রথমেই পরিচালক সতর্ক করে দেন। ...এই মহান পরিচালকের জীবন এই ছবির অনুপ্রেরণা। তবু খটকা লাগে সময়কে, স্থানকে পরিস্থিতিকে যেভাবে উদ্ধৃতি দিয়ে, গ্রাফিক্সে, রেডিওর সংবাদ দিয়ে পরিবেশিত হয়। জীবন্ত জ্যান্ত করার অনুপ্রেরণা থাকে, ঠিক তেমন ভাবে থাকে না পাশের চরিত্রগুলোকে নির্মাণে। সেখানে ঐতিহাসিক ভাবে যে চরিত্র গুলো থাকার কথা ছিলো তারা মোটামুটি সবাই থাকেন, কিন্তু অন্য নামে, অন্য ব্যঞ্জনায়। প্রাণ পায় না তারা। শুধু তথ্যের আকর হিসেবে থেকে যায়। ছায়া ছায়া মানুষ গুলো সময়ের কথা বলে। আর খন্ডে খন্ডে গল্পমালা এগোতে থাকে সত্তর থেকে চল্লিশে...কখোনো "ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়" বলে গল্পের মোড় ফেরে বর্তমানে।

ছবির মুক্তির দিন অনেক রাতে এক ছাত্র এস এম এস করে জানায় “গোটা ছবিটা মনে হয় ক্লাসঘর স্যার”। আর একজন ছাত্র ফেসবুকে বসে জানায় “কথা রাখতে পারলাম না। আবার বাংলা খেয়েছি। নিজেকে ঠিক স্থির রাখতে পারছি না। ছবিটা কোন গোত্রের সে নিয়ে কিছু জানতে চাইবেন না স্যার। কিছুক্ষণ পরেই ডি-এ্যাকটিভেট করে দেবো এ্যাকাউন্ট। ছাতার মাথা চারদিকে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।” ওদের উত্তাপ আমার গায়ে এসে লাগে। ওদের মধ্যে যে নতুন প্রাণ সেটা দু-হাতে আঁজলা করে ভরে নিতে চাই। “আমি পুড়ছি ব্রহ্মান্ড পুড়ছে’’র চমক যেন দূরে কোথাও প্রবাহিত হতে থাকে। এক তরুণ ডাক্তার হাত ধরেন এক বয়স্ক প্রাজ্ঞবান পরিচালকের। কমলেশ্বর এগিয়ে যেতে থাকেন নীলকন্ঠ বাগচীর হাত ধরে। তাঁকে যেতে হবে অনেকটা পথ।

ছবিটা আমার ভালো লেগেছে না খারাপ লেগেছে। মন থেকে মানছি কি মানছি না। সেটা বড় একটা মনের মধ্যে বেজে ওঠে না। বরং আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি এই ছবির দুঃসাহসিকতায়। স্পর্ধায়। মূল ধারার প্রচলিত আঙিনায় নিদারুণ কিছু শর্ত মানে না এই ছবি। বাজার চলতি শর্তগুলো মাথায় রাখেন না পরিচালক। মানতে চান না হঠাতই সিনেমার ভাষা থেকে থিয়েটারের ভাষায় জাম্প করার ব্যাকরণগত বাধ্য বাধকতা। কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গান্তরে ছুটতে থাকা। কিম্বা নীতা বা সীতাকে পুণ নির্মাণের দৃশ্যগুলোর লোভ ছাড়তে না পারার ছেলেমানুষিকতা। ফলত দৃশ্যগুলো অবাক নিরক্ষরতার পরিচয় বহন করে। পরিচালকের প্রথম ছবিতে যে সদ্য হাতে খড়ির আনকোরা গন্ধ থাকে সেটা যেন কোথাও উঁকি মারে শব্দ আর দৃশ্যের ব্যঞ্জনায়। মনে হয় দৃশ্য, ইমেজ, সিম্বল নিয়ে এক তরুণ ছাত্র গবেষণা করছেন। কাঁটাছেঁড়া করছেন। বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন নিজের ছবির দিকে। কিন্তু প্রাণ দিতে পারছেন না। লোকটা জ্যান্ত হয়ে উঠছে না। ভুল ভ্রান্তি, গল্পের উন্মীলন, চিত্রনাট্যের চলন তার কাছে আর তত তীব্র হয়ে উঠছে না। বরং মুহূর্তে দিয়ে গড়ে উঠছে ছবির দৃশ্যবন্ধ। এই মুহূর্ত দিয়ে ছবি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে বিপদ সঙ্কেত গুলো থাকে সেগুলো পেরোতে পারেননা কমলেশ্বর। হোঁচট খেতে হয় তাকে। ছবির দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে।

বৃষ্টি নামে গোটা পর্দা জুড়ে। বৃষ্টি নামে হলে। নীলকন্ঠের সংসার ভাঙে। দুর্গা চলে যায়। “সেপারেশন এসেনসিয়াল” বলার পরে ছৌয়ের মুখোশ গুলো তান্ডব করে। কোথাও যেন কাকদ্বীপে জমি দখল করে নেয় কৃষকরা। সাঁওতাল মেয়েকে ধর্ষণ করে ফৌজ। চার দেওয়ালের হাসপাতালে ছোট্ট চৌখুপ্পির মধ্যে হাতড়াতে থাকে নীলকণ্ঠ। কিছুক্ষণ পরেই যে বঙ্গবালার সাথে এক অনন্ত পরিব্রাজনে বের হবে। উদ্বাস্তু তকমা সাঁটা নীলকন্ঠ খুঁজবে নিজের গ্রামটাকে। দেশটাকে। নগরটাকে। “এই সভ্যতায় কে উদ্বাস্তু নয়” বলে প্রশ্ন তুলবে। বলে উঠবে “রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্র দ্রোহিতা থাকবে। বেবাক ছেলে গুলোকে এইভাবে মেরে ফেলতে পারেননা আপনারা।”

বদল করতে এসে বার বার যে শিকড়ে ফিরতে চাইছে...গ্রামটাকে, দেশটাকে খুঁজতে চাইছে...সময়টাকে বুঝতে চাইছে নিজের মতো করে...উদ্বাস্তু তকমা নিয়ে জ্বলছে নিজের মধ্যে, বন্ধুদের মধ্যে। তার মন কি আদৌ ছুঁতে পারলেন পরিচালক? সহজে কি কোনো এক উদ্বাস্তু মানুষের মন ছোঁওয়া যায়? সেখানে তত্ত্ব, আর্কিটাইপাল মাদার ইমেজ, রাজনৈতিক চেতনার যতই যোগান থাক না কেনো। নদীর চর...হারানো গ্রাম...দেশের হাতছানি বড় মনকেমনের সুরে বাজতে থাকে ঋত্ব্বিকের সব ছবি জুড়ে। সেই মন কেমনটা এই ছবির খামতির বিষয়। যে মন কেমনের জন্য বারবার নীতার কাছে আমি ছুটে যাই...সীতার কোলে মাথা রাখি...তিতাসের বুকে অনন্তকাল বইতে থাকি দাঁড়। সেই মন কেমন নিয়ে কমলেশ্বরের মেঘে ঢাকা তারার কাছে ছুটে যাবো না কোনোদিন।

আমি জানি না কমলেশ্বর আপনি কোনো উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য কিনা। আমি জানি না এই দেশে জন্মেও এক উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য হওয়ার জন্য আপনাকে কোনোদিন জামা খুলে বন্ধুরা পিঠ দেখতে চেয়েছে কিনা। জানতে চেয়েছি কিনা সত্যিই সীমান্তের কাঁটাতারের দাগ আছে কিনা আপনার পিঠে। আপনার ঠাকুমা আপনাকে কি কোনোদিন না দেখা একটা ফলসা গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে? যদি সত্যি দিতো তাহলে আপনার নীলকন্ঠ বাগচী আজ ক্যামেরার লেন্সে মদ ঢালতো।

 তবুও বলি, আমি ভুলবো না কেউ একজন এই সময়ে স্পর্ধা রেখেছিলো থিয়েটার আর সিনেমাকে মিলিয়ে দেওয়ার। কোনো এক বিখ্যাত প্রযোজক সংস্থা তাদের বিক্রিত লভ্যাংশের কথা ভুলে গিয়ে ছুটেছিলো এন্টিএ্যাসটাবলিশমেন্টের দিকে। যদিও সেটা এখন পণ্যজাত। হ্যাঁ গেঞ্জিতে চে’র ছবির মতোই।

মন্তব্যসমূহ

  1. dear sir,
    apnar lekha ta pore valo laglo. sotti kotha bolte amar mone hyeche ei cinema ta ritwik ghatak ebong tar kaj er proti akta chotto surrealistic tribute. asa kori apni surrealism namok bisoy tar sathe porichito. sei dik dia jodi apni ei chobi tike jodi bichar koren tahole hyto apni chobi ta aktu onno rokom vabe critic krten..karon kichu jaigai ami apnar sathe sohomot hote parlam na.
    dhonnobad.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি