এক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি...


এক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি...


অনেক সকালে উঠে মা উনুন ধরিয়েছেন। অনেক সকালে আটা মাখা হচ্ছে। কুড়ি খানা রুটি একটু পরেই দাদা নিয়ে যাবে। পাড়ার মোড়ে গোরা কাকু দাঁড়িয়ে থাকবে। গোরা কাকুকে দিয়ে আসতে হবে রুটি। রুটি যাবে ব্রিগেডে। অনেকে আসবেন...তাঁরা সবাই গুড় দিয়ে রুটি খাবেন।
মায়ের কাছে ইনফরমেশান পেয়ে কলে মুখ ধুতে গেলাম। হাতে সাধনা মাজন। কলে অনেকের ভিড়। আজ রবিবার স্কুল ছুটি। বাবাও বাড়ি। পাতকোয়া অনেকদিন খারাপ তাই বাড়ির বাইরে আসা। বাসা বাড়ি। যেটুকু জল আছে বাবা মুখ ধোবে।
 অমরদা সব্জীর দোকান খুলেছে। ভিড় বেশি... বাবা ঘুম থেকে উঠে বাজার করছে। বাবা তাড়াতাড়ি স্নান করেছে। বাবা আজ ব্রিগেড যাবে।
 আমি যাবো বাবা।...
তুমি যখন বড় হবে তখন যেও কেমন।
সবাই যে যাচ্ছে...।
যাক। তোমাকে শীতের ছুটিতে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবো। সেই যে নতুন শাদা বাঘ গুলো এসেছে...।
আশির দশকের গোড়ার দিক। দিন-আনা দিন খাওয়া পরিবারের রোজনামচা গড়াতে থাকে।
এক মফস্বলের প্রাথমিক শিক্ষক সকাল থেকে প্রস্তুতি নেন ব্রিগেড যাওয়ার।
প্রস্তুতিটা অনেকক্ষণের। কারণ তার কিছুদিন আগে এই শিক্ষকের টিবি ধরা পড়েছে। তাঁর মা গত হয়েছেন। তাঁর বিধবা দিদিকে বেনামে ভর্তি করতে হয়েছে মাদার টেরেজ়ার নির্মল হৃদয়ে। শেষ মুহুর্তের খবরটুকু আসার অপেক্ষায়।
শিক্ষক ভাত খেলেন না। দুটো রুটি আর বাতাসা। ভাত খেলে আজকাল তাঁর কষ্ট হয়। গত দুমাস তাঁদের স্কুলে মাইনে হয়নি। গত দুমাস বাড়িতে ধারের খাতা চলছে। গত দু-মাস তিনি লজ্জায়...উতকন্ঠায়...ভয়ে...আরো কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছেন।
পাটভাঙ্গা ধুতি...পাঞ্জাবী...কাঁধের ওপর শাল নিলেন মাষ্টার মশাই। পাড়ার সবাই হেঁটে যাবে।
অনেকে চলেও গেছে...মাষ্টার পারবে না। শরীর দেবে না। তিনি যাবেন ট্রেনে...তারপর বাসে...তারপর হেঁটে...।
আজ ব্রিগেডে বলতে উঠবেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু
আজ বলবেন তাঁর সরকারের প্রথম সাফল্যের কথা।
শক্ত হাতে ধরা ছাতাটা। আমি পিছনে।
বাবা...সত্যি নিয়ে যাবে তো...চিড়িয়াখানা...শাদা বাঘ।
বাবা হাসেন...ঘাড় নাড়েন...।
আমি ছুটতে ছুটতে চলে যাই বিশাল শ্রীবাস্তবের বাড়ি। ওদের বাড়ি আজ টিভি আসবে। আমি এর আগে কোনোদিন টিভি দেখিনি। ওর বাবা বালী জুটমিলে কাজ করে। বিশাল আমার খুব ভালো বন্ধু।
অনেক রাতে বাবা বাড়ি ফেরেন। কাশির সাথে রক্ত। দাদা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে...। বাবার মাথায় অল্প অল্প ঘাম।
ডাক্তার কাকু আসেন।
রবি তুমি আজ একটু বাড়াবাড়ি করলে। আমি বারণ করেছিলাম। এই শরীরে...
বাবার মুখে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তির হাসি। ডাক্তার কাকুর হাত জড়িয়ে ধরে বাবা বললো...
কমরেড জ্যোতি বসু মঞ্চে উঠে কি বললেন জানো? পে কমিশনের রিপোর্টে আমাদের চাকরী সরকারের অন্তর্ভূক্তি হচ্ছে... মাইনে বাড়ছে... দিদিকে ভাবছি নিয়ে আসবো।
মণি নির্মল হৃদয় থেকে ফেরত আসেনি।
পরের পরের দিন খবর এসেছিল। বাবা আর দাদা সন্ধ্যেবেলায় ফিরে আসার পর গোটা বাড়িটা কেমন যেন আরো নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
বাবার মাইনে বাড়লো। দাদার ইংরাজী স্যার রাখা হল।
জ্যোতি বসু পরের বছর...তার পরের বছর...তার পরের বছর ব্রিগেডে মঞ্চে উঠলেন।
পাড়ার চেহারা পাল্টাতে থাকলো। রাত হলে মেদো মাতালের আখড়া উঠতে থাকলো...চোলাইয়ের ঠেক বন্ধ হলো। গোরা কাকুর দল একটা লাইব্রেরী খুললো...
পাড়ায় লাইব্রেরী...। বিভিন্ন দিবস পালন হতে আরম্ভ হলো...ওদের কাছেই শিখলাম...
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না...
তারপর অনেক দিন পর...বাবা মারা যাবার অনেক দিন পর...
আমি দেখলাম বাবার সেই সম্ভ্রমের নেতা...আদরণীয় নেতা...জননেতা... জ্যোতি বসুকে...খুব কাছ থেকে...এক টেলিভিশন চ্যানেলের সৌজন্যে...।
সে বছর তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ত্বের শেষ বছর।
স্টুডিওতে  এসেছেন সাক্ষাতকার দিতে। তাঁকে ল্যাপেল পরানো হচ্ছে...জামা ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে...আলো মাপা হচ্ছে...কাটার স্ট্যান্ড ঠিক করা হচ্ছে...পিসিআর থেকে ভেসে আসছে কমান্ড...
জিরো...ওয়ান...টু...থ্রি...একশান...
আমার চোখের সামনে সেদিনের সেই সকাল...উনুনের ধোঁওয়া...বাবার অশক্ত শরীর...আমার বালীর বাসা...গুড় রুটি...।
 
 
আর কিছুক্ষণ পরে পিস হেভেন এর ঠান্ডা ঘরে শায়িত থাকবেন ভারতের জননেতা জ্যোতি বসু...


শায়িত থাকবে এক ইতিহাস...একটা সময়...
যে পরিসমাপ্ত ইতিহাসের সাক্ষী আমি।

মন্তব্যসমূহ

  1. ওনার সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা অবশ্য একেবারেই এইরকম ব্যক্তিগত নয়। তবে আমার জীবনের অনেক ঘটনাচক্র এবং মানসিকতার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের পেছনে কোথাও বোধ হয় এই মানুষটি রয়ে গেছেন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি