পুস্তক সমালোচনা (Book review)

চিত্রসূত্র সংবাদ,২০০০, জানুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত


পাওয়া না পাওয়া


স্মৃতি কি লাটিমের মতো পাক খায় আমাদের মনে? অতল গহ্বরে! সত্তর পেরিয়ে আসা মানুষটির সবুজ ডালপালায় শিকড় বাকড়ের অন্তর্গত প্রবাহে তখন শুধুই একনিষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রেম ও স্মৃতির খেলা। তপন সিংহের (Tapan Sinha) মনে পড়ে শৈশবকে...জীবনকে...।


আর ঠিক তখনই আমরা তাঁর মুখোমুখি বসি।


শারীরিক আর মানসিক অবসাদের সময় হাতে উঠে আসে পেন। না, তখন আর ক্যামেরা লেখনী নয়। বরং দুই মলাটের মাঝখানে নিজেকে ফিরে পাওয়া। টুকরো টুকরো কোলাজের আকারে জমাটবদ্ধ হতে থাকে স্মৃতি চিন্তন। কাহিনী সরল রৈখিক যাত্রাপথে এক নিটোল আকার ধারণ করে। মাঝে মাঝে চিত্রনাট্য পাঠের প্রচ্ছন্ন আস্বাদ বহন করে আনে বইটি।



চিত্রপরিচালক এখন লেখকের ভূমিকায়। তাই হয়তো স্বীকারোক্তি করতে হয়, আমি লেখক নই...কুন্ঠিত কলমে শৈশবের কথা লিখতে বসলাম। কিন্তু ভূমিকাতে একথাও জানানো দরকার হয়ে পড়ে, শৈশব থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রকারের দীর্ঘ কর্ম জীবনে যে ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছি, এই বই মূলত তাঁদের নিয়ে লেখা। যদিও সেইসব ব্যক্তিত্বদের সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র তাঁরা নামের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। হয়তো সম্পূর্ণতার দায় লেখক নিজেই বহন করেননি। কিম্বা যা লেখকের মনে পড়ার অতীতে বিরাজ করেছে।



বিহার-বীরভূম-মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী গ্রাম যেখানে লেখকের বাল্যকাল কেটেছে তাদের নাম আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়। সেখানকার সেই ছোট্ট ছেলের মন কেমন করা পরিবেশ থেকে আমরা চলে আসি বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভাগলপুরে। এখানকার স্কুল জীবনের সতেজ অভিজ্ঞতায় মিশে থাকে এক চঞ্চল কিশোরের দিনলিপি। গান্ধীজী ও নেতাজীকে দেখার স্মরণীয় মুহূর্ত। তারই মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রথম ছবি দেখার রহস্যঘন আনন্দ। ডিকেন্সের এ টেল অব টু সিটিজ প্রথমে পাঠ, তারপর ছবির মাধ্যমে সেই সাহিত্য রসের আরেক ধরনের পাঠ গ্রহণ। ক্রমশ মনের জমি যেন প্রস্তুত হতে থাকে, ওই ছবি এবং উপন্যাস স্কুলজীবনে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয় আমার মনে। যেন অবচেতনে সৃষ্টি হল এক নতুন জগত।



টানা দশ বছর ভাগলপুরে থেকে এবার কলকাতায় ফেরার পালা।

চল্লিশের দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ...মহামারী...দুর্ভিক্ষে কলকাতা তখন মৃতের নগরী। এরই মধ্যে ছাত্র জীবন শেষ করে এক বৃষ্টি ঝরা বিকেলে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে প্রবেশ করলেন তপন সিংহ। মনে একটা প্রশ্ন ছিল। সেই উত্তরের অন্বেষণে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন এক ছবি থেকে অপর ছবিতে। নিউথিয়েটার্স থেকে ইংলন্ডের পাইনউড স্টুডিও। কিন্তু আক্ষেপ থাকে, সেই প্রশ্নের উত্তর আজও পাইনি।



প্রশ্নটি পাঠকের কাছে অজানা থেকে যায়। কিন্তু কেন? অনেক কিছুই তো জানা যায় না। পাঠকেরও দাবী থাকে সেই বনষ্পতির কাছে। যাঁর ছবি নির্মাণের অভিজ্ঞতা আরও বিস্তৃত আকারে লেখা যেত। বিশেষ করে যিনি বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক বিস্তীর্ণ সময়ের সাক্ষী। সেই সন্ধিক্ষণ গুলির অংশীদার, যেগুলি ছাড়া ভারতীয় চলচ্চিত্র তার আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করতে পারতো না।



নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে দু-বছরের শিক্ষানবীশ, প্রিয় পরিচালক বিমল রায়ের সহকারী হিসেবে কাজ, রেনোয়ার সান্নিধ্য, পৃথিবীর প্রথম ম্যাগনেটিক সাউন্ড রেকর্ডিং মেশিনে ইংলন্ডের চার্লস পুলটনের সাথে দি রিভার ছবির শুটিং-এ অংশগ্রহণ। তারই সাথে সাহিত্য- চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনো। এরপর জীবনের দ্বিতীয় পর্বে ইংলন্ড ফেরত তপন সিংহের সাথে আলাপ হবে আরও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের। নিজের ছবি নির্মাণও শুরু হবে। আর সেই অভিজ্ঞতার তাপ পুইয়ে নিয়ে চিত্রপরিচালক তপন সিংহের সাথে একটু একটু করে পরিচিত হব আমরা।


কয়েকটি ছোটখাটো ভূল সূত্র থেকে যায় বইটিতে। যেমন ১৯৪৮ সালে ক্যালকাটা মুভিটোন ফিল্ম ক্লাবকে তিনি ভারতবর্ষের প্রথম ফিল্ম ক্লাব বলতে চেয়েছেন। সেখানে কানন দেবীর খরচে মৃণাল সেনের উদ্যোগে আইজেনস্টাইন, পুডোভকিনের ছবি দেখতেন বেঙ্গল ফিল্ম ল্যাবরেটরীতে। কিন্তু এর আগেই ১৯৪৭ সালে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সূত্রপাত হয়। প্রথম দিকে সত্যজিত রায়ের বৈঠকখানায় ১৬ মিলিমিটারে ছবি দেখানো হতো। পরে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি এক বিশাল আকার ধারণ করে। তাহলে পরিচালকের কি এদের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না? কিন্তু সেটা কেমন করে হবে? পাঠকের কাছে বইটির এইসব তথ্য রহস্যের আকার ধারণ করে। ঠিক কোনটা মনে পড়ে আর পড়ে না তার সংঘাত বাধায়।


আমাদের সময় আর পরিসর দুটোরই বড় অভাব। তাই বিস্তৃত ব্যাখ্যানের তাগিদও নেই। পাঠকের ওপর ভার থাকলো সঙ্গতি-অসঙ্গতির কাটাকুটি খেলার। আর সেই ফাঁকে সময়টাকে ফিরে দেখার। মনোযোগী, চলচ্চিত্রানুরাগী পাঠক পেয়ে যেতে পারেন অনেক অজানা তথ্য। যেখানে বিখ্যাত মানুষের পাশে হঠাতই টাঙ্গাওলা নাথুরামের মুখ আঁকা হবে। উঠে আসবে ঝিন্দের বন্দী প্রসঙ্গ। শৈশবের স্মৃতি চকিতে মন ভাসাবে। ধরা দেবে ছবিতে। বাড়িতে ঠাকুর তৈরী করতে আসা গোপালদার মুখের গান পরিমার্জন করে হারমোনিয়াম ছবিতে প্রবেশাধিকার পাবে।



এক ধরনের অস্থিরতা সমস্ত বইটি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এই অস্থিরতা হয়তো সেই শিল্পীর যিনি এখোনো সতেজ ও সহজভাবে নির্মাণ করতে পারেন তাঁর ভাবনা। বলতে পারেন, শিল্প, সত্য ও সৌন্দর্যের সন্ধানে নিজের অজ্ঞাতে ও কিছুটা জেদের বশে একদিন যে পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম তার শেষ কোথায় আজও দেখা হয়নি...তবে দুঃখে সুখে এই পথ চলার আনন্দ আজও আমাকে ছেড়ে যায় নি। ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের আহ্নিক ও বার্ষিক গতির পথ পরিক্রমায় তিনি এখোনো খুঁজে বেড়ান তাঁর না পাওয়া উত্তরকে। আর সেখানেই বইটি অনন্য স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।


মনে পড়ে, তপন সিংহ, আনন্দ,১৯৯৫


যখন আমার এই বহু পুরোনো একটা লেখা আপ-লোড করছি তখনি টিভিতে খবর সম্প্রচারিত হচ্ছে তপন সিংহ আর আমাদের মধ্যে নেই। দু-তিনবার তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। সেই স্মৃতি আমার কাছে এক পরম পাওয়া। মনের মণিকোঠার সেই লুকোনো কথা না হয় আর কোনো একদিন লিখতে বসবো।




মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি