শরতের চিঠি

প্রিয় সাজিদুল
আকাশের মুখ বেশ গোমড়া দেখে আনন্দ হল। কয়েকদিন বৃষ্টি নেই, চারিদিক খটখটে শুকনো। একটু ঝিরিঝিরে বৃষ্টি হলে বেশ হয়। মনে মনে যখন ভাবছি ক্যামেরা নিয়ে বের হব ঠিক তখনই লকু হেমব্রম এসে খবর দিলো সিদ্ধেশ্বরী নদীর চরে অনেক কাশফুল ফুটে রয়েছে।
ভারী সুন্দর সে ফুল।

কাশ ফুল দেখলেই তার নাকি করম উতসবের কথা মনে পড়ে যায়।
 আর তোমার কী মনে পড়ে সাজিদুল?
পবিত্র রমজানে এবারেও কি শিমাই খেতে খেতে আমার কথা মনে পড়েছে?
কী করবো বলো? কী করে যাবো? আমি তখন বীরভূমে, অনেক দূরের এক গ্রামে, তোমার জন্য কাশফুল আর পদ্মের ছবি তুলছি।
বুঝেছি,  বেশ রাগ করে আছো আমার ওপরে।
অনেকদিন চিঠি লেখা হয়নি তোমায়।
অনেকদিন খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরিনা আমরা।
অনেকদিন করিম চাচার কাছে  দুষ্টু কুমীরের গল্প শোনা হয় না।
সত্যিই অনেকদিন আমি যাইনি সুন্দরবন, অনেকদিন পাখিরালার বাঁধের ওপর জিলিপি খেতে খেতে হাঁটা হয়না।
এবার শীতে যাবো সাজিদুল।
কথা দিলাম।
তিন সত্যি।

লকু হেমব্রম তোমার মতই ক্লাস সেভেনে পড়ে, দারুন ফুটবল খেলে, তুখোড় ধামসা বাজায় আর সুন্দর লাঠি নাচ করে। সে তোমার মতই দলের পান্ডা। আমাকে সারাদিন গ্রাম দেখায়, আর রাতে খাওয়ার পরে বাঁধের ওপর নিয়ে গিয়ে মাচায় বসায়। সামনে টিমটিম করে জ্বলে ছোট্ট একটা হ্যারিকেন।
 মাচা কি জানো সাজিদুল?
 বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরী একটা উঁচু ঘর। সেখানে গ্রামের অনেকে বসে গল্প করে, আড্ডা মারে, পড়াশুনো করে আর রাতের বেলায় অনেকে আবার ঘুমোয়।

ঠিক এই রকম মাচা আমি দেখেছিলাম বিহারের এক দূরের গ্রামে, সেই মাচার একটা সুন্দর মিষ্টি নাম আছে, “গাঁও কি দরওয়াজা”। যেখানে অনেক দূরের অতিথিরা এসে বিশ্রাম নেবে, ঘুমোবে।

ওই দেখো মাচার কথা বলতে ছটু যাদবের গ্রামের কথাই প্রথমে মনে পড়লো, আর চিলাপাতার জঙ্গলে হরি রাভার গ্রামেও যে ঠিক একই রকম ঘর দেখেছিলাম সেটা বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম। এই মাঁচা অবশ্য আরো অনেক উঁচু, ওরা সবাই বলে টঙ । হরি রাভা, আমলা টোটো, সুজন নাসরিন, এদের প্রত্যেকের গ্রামে একটা করে টঙ আছে।
এই মাচাতে ওরা কিন্তু আড্ডা মারতে যায় না, এখান থেকে ওরা হাতিদের ওপর নজর রাখে। হাতিরা জঙ্গল থেকে ক্ষেতের মধ্যে ঢুকলেই টিন পেটায়, চিতকার করে, আর হাতির দল ভয় পেয়ে, ক্ষেতের ক্ষতি না করে চম্পট দেয়।
কি মুখ চেপে হাসছো বুঝি?
তোমার কি সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো?
বুঝেছি, আমি কিন্তু সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
রাতে যখন করিম চাচা এসে আমাকে ডাকলো, বললো কেউ আজ ঘুমোবে না, সবাই জেগে গ্রাম পাহাড়া দেবে মশাল নিয়ে, আশে-পাশে “তিনি” ঘোরা ফেরা করছেন, আমার তো তখন ভয়ে দাঁত-কপাটি লাগার মতো অবস্থা।
 সে রাতে অবশ্য বাঘ আসেনি।
দূর থেকে গর্জন শুনেই মা বনবিবিকে মনে মনে বার সতেরো ডেকে ছিলাম আর ভয় কাটানোর জন্য তুমি আমাকে মধু আনতে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছিলে। বেশ মনে আছে এখোনো।
এখন সেই গল্প থাক বরং চলো লকুর সাথে গিয়ে একটু মেঠো ইঁদুরের মাংস খেয়ে আসি।

কী তোমার ঘেন্না করছে?
 না, না, ব্যাপারটা সে রকম একদমই না। খুব সুন্দর খেতে।
আজ আমি লকুদের অতিথি, তাই  এক বিরাট পিকনিকের আয়োজন হয়েছে। গোটা সতেরো ইঁদুর ধরা পড়েছে। পিকনিকের অসাধারণ বন্দোবস্ত দেখে আমি ফড়িং এর ছবি তুলতে গেলাম। লাল কাঁকড়া আমাকে দেখিয়েছিলে সাজিদুল, আমি তোমাকে লাল ফড়িং দিলাম। কি তোমার সামনে ফড়ফড় করে উড়ছে তো?

এদিকে সারাক্ষণ ফোন করছে  আমার অনেক ছোটবেলার বন্ধু হাবু,  বলছে আর কবে আসবি বীরভূম থেকে? এদিকে তো কুমোরটুলিতে ঠাকুর আনতে যেতে হবে।
 

লকুর মন খারাপ, আমি করম উতসবের আগেই বীরভূম থেকে চলে যাবো শুনে।সে যে কি সুন্দর করম পাতা মাথায় দিয়ে নাচবে তার আর ছবি তুলতে পারবো না ভেবে আমার মনও খুব খারাপ। আর এই সব মন কেমন করা মুহূর্তগুলো আমার ক্যামেরায় নিয়ে একদিন ফিরলাম বীরভূম থেকে।
যতই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কুমোরটুলির সরু গলি দিয়ে এগোতে থাকলাম ততই ক্যানিং এর কানাইকাকা, মইদুল, রোশনের চেনা গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। “হেঁই সামালো পিছকে...হেঁইয়ো...হেঁইয়ো...জোর সামালো টানকে হেঁইয়ো হেঁইয়ো...” বড় বড় বাঁশের মধ্যে মোটা দড়ির ওপর ঝুলে মা দুর্গা সপরিবারে চলেছেন নৌকার দিকে।
বুড়ো শীতলকাকু থাকেন ডায়মন্ডহারবারে, চল্লিশ বছর ধরে এই পুতুল ওঠানো নামানোর কাজ করছেন (এখানে কেউ ঠাকুর বলে না, চলতি কথা পুতুল)
মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বৃষ্টি প্যাচাল মারবে না, আপনারা ওঠেন, পুতুল ওঠান...।” হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “ দুগগে দুগগে...”।
 

মাঝ গঙ্গায় তখন আমরা। সত্যিই সাজিদুল এবার একটুও বৃষ্টি নেই, জোয়ারের টানে ভেসে চলেছে আমাদের নৌকাগুলো। আর আমার বিদ্যাধরীর কথা মনে পড়ছে...হরিণভাঙার কথা মনে পড়ছে...আর মন বলছে এবার শীতে আমাদের দেখা হবেই।
খুব ভালো থেকো আর মস্ত বড় একটা চিঠি লিখো।

 ইচ্ছামতীর শরত সংখ্যা, ২০১০, প্রকাশিত

মন্তব্যসমূহ

  1. tomar chithi pore pujo r amej elo bole..atodin pachilam na thk..1 kothay darun

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার ব্লগের সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয়। তবে খুব কমই পোস্ট বা কমেন্ট করেছি। শুধু রবি ঘোষের সম্বন্ধে লেখাটাতে পোস্ট করেছিলাম। আপনার স্বাধীনভাবে প্রকৃতি দর্শন ও বিশ্লেষণ করার পন্থাটা আমার খুব পছন্দ। প্রকৃতি ও সমাজের (সামাজিক জীবন) প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা অতি সরলভাবে আপনি প্রকাশ করেন ছবি ও লেখাতে। যেটা প্রত্যেক শিল্পীর কর্তব্য হলেও অনেকে সহজে পারেন না। আর সেখানেই আপনার সার্থকতা ও পাঠকের উত্তরন। আজ এটুকু থাক। পরে কথা হবে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি