পুজোর চিঠি

পুজোর চিঠি
সারা রাতের ট্রেনের ধকল ছিলো ঘুমও হয়নি ভালো করে ঝম ঝমে বৃষ্টির মধ্যে যখন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছিলাম তখন ভাবতেও পারিনি রাত দশটা পাঁচের দার্জিলিং মেলটা ধরতে পারবো শিয়ালদহ থেকে তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠে দেখি গোটা কামরা জলে থৈ থৈ জল পরিষ্কার করে, আমার জিনিসপত্র রেখে, সব দিক দেখে শুনে, ধীরে-সুস্থে বসতে বসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো তখোনো তোমার চিঠিটা আমার ব্যাগে সিরাজুল খোলা হয়নি নীল খামটাও
রফিকুল ক্যানিং লোকাল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে এসেছিলো ভেবেছিলো আমার ট্রেন হয়তো ছেড়ে গেছে হাঁপাচ্ছিলো রফিকুল ও এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে শুনলাম তোমাদের গ্রামে আবার নদীর জল ঢুকছে হু হু করে তোমার ছোট্ট বোনকে নিয়ে মা চলে গেছেন মামার বাড়ি,পবিত্র রমজানে আনন্দের ছিটেফোঁটাটুকু নেই রফিকুলের দেওয়া টুকরো টুকরো খবরে আমার মন যখন একটু একটু করে কষ্ট পাচ্ছে তখন দেখি ট্রেনের কামরার সহযাত্রীরা একটুখানি জল দেখেই কি হই-চই বাধিয়ে ফেলেছে আর আমার মনে পড়ছে তোমার গ্রামকে সুন্দরবনের সেই ছোট্ট গ্রাম পাখিরালার কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম সিরাজুল
সকাল ঠিক আটটার সময় দার্জিলিংমেল আমাদের নামিয়ে দিলো নিউ জলাপাইগুড়ি স্টেশনে সারা রাতের ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও হলো যখন দেখতে পেলাম ঝকঝকে শরতের রোদে ভেসে যাচ্ছে স্টেশন চত্ত্বর বেশ কিছু বিদেশী ট্যুরিস্ট নিজেদের মধ্যে হৈ-হৈ করছে আর ছোট ছোট জিপ থেকে চালকরা জোরে জোরে হাঁক দিচ্ছে "কালিম্পং, দার্জিলিং,ফুনসিলিং..." তোমার বয়সী একদল স্কুলের ছেলে মেয়ে কালিম্পঙের বাসটায় উঠলো আর ঠিক তখনি আমার গাড়ির চালক জয়কে দেখতে পেলাম হাসি-খুশি জয় সবসময় আমার সফর-সঙ্গী
আমরা যাবো শিলিগুড়ির খুব কাছেই সরস্বতীপুরে সেখানে কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের পাশেই থাকে মালতী নার্জিনারী ঠিক ধরেছো সিরাজুল, মালতী তোমার মতো ক্লাস সেভেনে পড়ে যাওয়ার পথে হঠাত গাড়ি থামালো জয় তাকিয়ে দেখি তিস্তার চর সেজে উঠেছে কাশফুলে মনে পড়ে গেলো পুজো্র আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি
কাঁঠালগুড়িতে গিয়ে মালতীর দেখা পেলাম না শুনলাম মামার বাড়ি গেছে অতদূর থেকে এসেছি বুঝতে পেরে শুক্লা ওরাঁও বললেন,"একটু বসুন, আমি আপনাদের গ্রামটা ঘুরে দেখাই" তিস্তার পাশে জঙ্গল আর চা বাগানে ঘেরা মেচ আর ওরাঁও জনজাতির গ্রাম শুক্লার সাথে গ্রাম ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সবাই চা-পাতা তোলার কাজে ব্যস্ত কেউ কেউ জঙ্গল থেকে বয়ে নিয়ে আসছেন শুকনো কাঠ
খুব তাড়াতাড়ি আমরা আবার চলা শুরু করলাম যেতে হবে অনেকটা পথ রাজাভাতখাওয়া ছাড়িয়ে আরও ঘন্টা দুয়েকের পথ সন্ধ্যা নামছে বড় রাস্তা থেকে জঙ্গলে ওঠার মুখে জয় আবার গাড়ি থামালো আমরা সবাই চুপ আকাশে নানা রকমের রঙ ছড়িয়ে সূর্যিমামা পাটে নামছেন এরপরে জঙ্গল, পথে পড়বে রায়ডাক নদী
সিরাজুল, তোমার গ্রামে যখন রাতে ছিলাম তখন মনে আছে বাজারের সেই অন্ধকার পথটা? তুমি আমাকে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলে অনেক রাতে ঘুম থেকে তুলে আমাকে শুনিয়েছিলে হাড় হিম করা বাঘের ডাক মাগো, সেদিন কি ভয় পেয়েছিলাম! মনে আছে সিরাজুল? আর সেই লস্কর মন্ডল, টাইগার রিজার্ভের বনরক্ষী যিনি আমাদের সেই রাতেই নিয়ে গিয়েছিলেন নৌকাতে আর সারা রাত আমরা ছোট ছোট খাঁড়ি ঘুরে বেড়ালাম বাঘের খোঁজে লস্করকাকু আলো নিয়ে খুঁজতে থাকলেন বাঘের পায়ের ছাপ আর বলতে থাকলেন সেই দুষ্টু কুমীরটার গল্প যে শুধু ওত পেতে থাকে কখন কার ছাগলটা, বাছুরটা তার নাগালে আসবে সত্যি সেই রাতের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না সিরাজুল
অনেক রাতে একশো বছরের পুরনো রায়ডাক বন বাংলোয় এসে যখন পৌঁছোলাম তখন চারিদিকে পটকা ফাটার শব্দ...টিন পেটানোর আওয়াজ... বুড়ো চৌকিদার এসে বললেন পাশের গ্রামে হাতি ঢুকেছে আজ বোধহয় একটা ধানও থাকবে না সারা রাত ধরে হাতি তাড়ালো গ্রামের মানুষ সকালে ঘুম ভাঙলো একটা চেনা মিষ্টি গন্ধে বারান্দায় এসে দেখলাম, সিঁড়ির কাছে ছোট্ট মাঠে ছড়িয়ে আছে শিউলি ফুল
পশ্চিম চ্যাংমারী গ্রামে থাকে ঊষা নার্জিনারী পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে কোনো বিদ্যুত নেই পাকা শৌচাগার নেই ঠিকমতো রাস্তা নেই সবার হাতে কাজ নেই খুব চেনা লাগছে কি সিরাজুল? এই গ্রামটাও কিন্তু তোমার গ্রামের মতোই তোমার গ্রামটা যেমন ঘিরে থাকে নদী, তোমার গ্রামে এখন যেমন নোনা জলে সব নষ্ট ঠিক তেমনই এখানে বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি নেই বছরে একবার এখানে ধান হয় তাও বৃষ্টির জলকে ভরসা করে এই গ্রামটাকেও ঘিরে থাকে জঙ্গল, পাহাড় আর ঘিরে থাকে ভয় কখন হাতি আসে তবুও ঊষা আর তার বন্ধুরা এখান থেকে বেশ কিছু দূরের স্কুলে গিয়ে পড়াশুনো করে চেষ্টা করে এই প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার তোমার চিঠিটা আমার সবটা পড়া হয়ে গেছে সিরাজুল একবার নয় অনেকবার ধান ক্ষেতের পাশে বসেই তোমাকে লিখছি আর কোথা থেকে একটা নীলকন্ঠ পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে ছবির মতো গ্রামটার দিকে
ঊষা এসে খবর দিলো নাচের দল রেডি কেতকী, আশা, রেবা আজ আর কাউকেই চিনতে পারছি না সবাই নিজেদের অর্থাত মেচ জনজাতির ট্রাডিশনাল পোষাকে সেজেগুজে এসেছে শুরু হল 'বাগারুম্বা'(মানে নাচ)

নাচ দেখে জঙ্গলের পথ ধরলাম আমরা বিশ্বেশ্বর শৈব্য বললেন,"হাতিপোতায় আজ হাট বসেছে স্যার, দেখতে যাবেন?" লোভ সামলাতে পারলাম না সিরাজুল প্রায় একঘন্টা হেঁটে হাতিপোতায় যখন পৌঁছোলাম তখন একটু একটু অন্ধকার হতে শুরু করেছে রিঙ্কুর সাথে পরিচয় হল রিঙ্কু হাটে বিক্রি করতে এসেছে কাঁচা সবজী ক্লাস ফোরে পড়ে বাড়ি ফিরে তেলের কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসবে সামনেই পরীক্ষা তার

যে ছবিগুলো তোমাকে পাঠালাম, যাদের কথা তোমাকে বললাম সবাই তারা পিছিয়ে পড়া গ্রামে থাকে হ্যাঁ ঠিক তোমার মতনই ওরা কষ্ট করে পড়ছে সিরাজুল আর আমি কি ভাবছি জানো? একদিন তুমি, রিঙ্কু, ঊষা, মালতী যখন অনেক বড় হবে- বলতে শিখবে নিজের গ্রামের কথা, নদীর কথা, সমস্যার কথা নিজেরাই এগিয়ে আসবে সামনের সারিতে...সেদিন সত্যি শরত তার অরুণ আলোর অঞ্জলীতে ভরিয়ে দেবে চারিদিক সেদিন পবিত্র ঈদে সবাই পাবে প্রাণের জোয়ার...বাগুরাম্বায় থাকবে মনের আনন্দ...আর ঠিক তখনই শুরু হবে সত্যিকারের উতসব যে উতসবে আমরা মেতে উঠবো সবাই
মন দিয়ে পড়াশুনো কোরো। মা আর বাবাকে আমার প্রণাম জানিও। আশা করছি হেমন্তের কোনো এক সকালে আবার তোমার সাথে দেখা হবে সিরাজুল। তখন আবার আমরা ছোট্ট নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়বো খাঁড়িতে, কাঁকড়া ধরতে। ভালো থেকো।

ইচ্ছামতীর পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত...


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি