আমরা জুড়ে যেতে পারি না?
লাইনটা সাপের মতো এঁকে বেঁকে গোর্কি
সদনকে ঘিরে ধরেছে। লাইনের একদম শেষের দিকে আছি আমি। টেনশান আছে মনে। ঠিক ভাবে
ঢুকতে পারবো তো হলে? অফিস থেকে আর একটু আগে ছুটি পেলে ভালো হতো। সময়টা এই শতকের
গোড়ার দিকের। আমরা প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি পরিচালকের প্রথম কাহিনীচিত্র
দেখবো। এই ছবি নিয়ে টুকরো টুকরো খবর ঘুরে বেড়িয়েছে ফিল্ম ক্লাব গুলোতে। ছবি
ভালোবাসা মানুষগুলোর ব্যাগে, কথায়, লেখনীতে। তখনও ছবিটা সেইভাবে দেখানো হয়নি নানা
জায়গায়। যতদূর মনে পড়ছে আইজেনস্টাইন সিনে ক্লাব আর গোর্কিসদনের ব্যবস্থাপনায় আমরা
দেখতে চলেছি তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। বাংলাদেশের মাঠ ঘাট, নদী, পালা পার্বণ
যখন আছড়ে পড়ছিল সাদা পর্দার গায়ে। মগ্ন হয়ে গিয়েছিল দর্শকেরা। মনে তখন প্রশ্ন
জাগতো এই ছবি এই বাংলার হল গুলোতে কেন চলবে না? কেন সবাই দেখার সুযোগ পাবে না?
তারও অনেক পরে পরিচয় হয়েছিল তারেক ভাইয়ের সাথে। ছবি দেখার সূত্র ধরেই। তিনি সেবার
দেখাতে ঝুলি ভর্তি করে নিয়ে এসেছিলেন ছবি। ‘মুক্তির গান’ দেখে নন্দন থেকে যখন
বেরোচ্ছি কথা বলার ভাষা ছিল না আমাদের কারও। ‘অন্তরযাত্রা’ এতো শুধু মা আর ছেলের
গল্প নয় দেশের কাছে ফিরে আসার এক অন্তরমুখী চেতনার টান। নন্দন চত্ত্বরে আরও
বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে কথায় আড্ডায় জানতে চেয়েছিলাম তারেক ভাইয়ের কাছে আমরা
জুড়ে যেতে পারি না আবার ছবি দিয়ে? খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন তারেক ভাই। জুড়েই তো
আছি কল্লোল। না হলে ‘মুক্তির গান’ দেখাই কী করে? আমার ‘অন্তরযাত্রা’? সত্যি হয়তো
তাই। কিন্তু সেতো মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে। আর সমগ্রের স্বার্থে যদি ভাবা যায়। এক
ভাষার স্বার্থে যদি ভাবা যায়। বাণিজ্যের আদান প্রদানের জন্য যদি ভাবা যায়? সেদিন
বেশীক্ষণ কথা এগোয়নি। সম্ভব ছিল না। তারপর আর দেখা হয়নি তারেক ভাইয়ের সাথে। এরও
অনেকদিন পরে ইউ ল্যাবের এ্যানিমেশান বিভাগের অধ্যাপক শিপু ভাইয়ের সাথে গিয়ে দেখা
করেছিলাম ক্যাথরিন মাসুদের সাথে। নিয়ে এসেছিলাম তাঁর শেষ ছবি রানওয়ে। যে বিপন্নতা
মানুষের আড়ালে আবডালে মাথা উচিয়ে বড় হচ্ছে সেই বিপন্নতার অংশীদার তো আমরা সবাই।
কাজেই ওই...আবার জুড়ে যাবার প্রশ্ন। অনেক বড় দর্শকের চাহিদা...। অনেকের কাছে
পৌঁছোনোর আবেদন। ‘চলচ্চিত্র যাত্রা’ বইটি পড়েও বেশ বোঝা যায় তারেক মাসুদও
চেয়েছিলেন সেই দর্শকদের পেতে। সেই হল গুলোতে ঢু মারতে যারা কোনদিন তথাকথিত পরীক্ষা
নিরীক্ষা মূলক ছবি দেখেননি বা প্রদর্শন করেননি। মুক্তির গান নিয়ে তার বিভিন্ন
জায়গায় ছুটে যাওয়া বা রানওয়ে দেখানোর জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা সেই সব কথারই সূত্র বহন
করে।
বেশ কয়েকবার ঢাকাতে যেতে হয়েছিল
কার্যসূত্রে। কাজের অবসরে কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে। নজরে
পড়ছিল অধিকাংশ ইংরাজী ছবির আধিপত্য। অবাক হয়েছিলাম যখন বসুন্ধারায় পোষ্টার দেখতে
পেলাম একটি তথ্যচিত্রের। ‘শুনতে কি পাও’? মনে হয় সেই বছরেই পুরষ্কার পেয়েছিল ছবিটি
মুম্বাই ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভালে। ঢাকার বন্ধুদের সাথে দেখতে গেলাম। আর
কি আশ্চর্যের সাথে আবিষ্কার করলাম ছবিটাতে সম্পাদনার কাজ করেছেন আমার কলকাতার
বন্ধু। ছবি দেখে বেরিয়েই তাকে পাঠালাম বসুন্ধরার ছবি। বিশাল পোষ্টার। ছবি দেখতে
আসা মানুষের ভিড়। কলকাতায় বসে তখন উত্তেজিত সে। কিন্তু এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। না
হলে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কী করে হতো? ‘পালঙ্ক’? ‘পদ্মা নদীর মাঝি’? ‘মনের মানুষ’?
‘শঙ্খচিল’? ‘ডুব’? আরও এমন কত কত? এই ধরনের আদান প্রদানগুলো যত বাড়বে তত মনের
জানলা গুলো খুলে যাবে নানা দিকে। বাণিজ্যের তরী গুলো ছুটবে সাঁই সাঁই করে। একই
সাথে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গে যদি বাংলা ছবি মুক্তি পায় তাহলে দুই দেশের চলচ্চিত্র
শিল্পে জোয়ার আসতে বাধ্য। সরকারী ফাইলে। নীতিমালায় কি আছে আমি জানি না। বাণিজ্যের
সেই পাওয়া না পাওয়ার জটিল সমীকরণেও যেতে মন চায় না। আপাত দেখায় যেটুকু ধরা পড়ে,
মনে হয়... সেটা বলতে চাই।
বাংলাদেশে কোন এক তরুণ পরিচালকের ছবি
নিয়ে যখন হইচই হয়। মনে হয় এটা কেন আমি এখানে বসে এক্ষুনি আমার হলে দেখতে পাবো না?
বা যখন বাংলাদেশের বন্ধুরা বলেন আপনাদের ওই ছবি দেখতে এখনও এক মাস বসে থাকতে হবে
তখন মন খারাপ হয়। আজিজ মার্কেটে বই ঘাটতে ঘাটতে মনে হতো যদি পাঠক সমাবেশ
কলেজস্ট্রিটে, গড়িয়াহাটে, যাদবপুরে স্টল দিতো। যদি রঙ এর একটা বড় শো রুম থাকতো
কলকাতায়। যদি চন্দননগরের জলভরা সন্দেশ ফাহমিদ ঢাকায় বসে খেতে পারতো। কিম্বা আমি
ময়মনসিংহের মন্ডা উত্তরপাড়ায়। কী এমন ক্ষতি হতো? যদি এমনটা হতো বন্ধুরা কবে নিয়ে
আসবে তার প্রতীক্ষা না করেই আমি শাহবাগের নানা রকমের ডিজাইনের গেঞ্জি কিনতে পারতাম
এখানে বসেই তাহলে কি মজাটাই না হতো?
তবে এর কিছু কিছু কলকাতা শহরে শুরু হয়েছে
সবেমাত্র। পাঠক সমাবেশ তাদের একটা স্টল করেছেন কলেজস্ট্রিটে। ধ্যানবিন্দু রাখছেন
বাংলাদেশের অনেক লিটল ম্যাগাজিন। লিখে দিলে মাস দুয়েকের মধ্যে এনে দেবেন বলছেন।
আজিজ মার্কেটের বিদিত রাখছেন এদিককার অনেক তরুণ লেখকের বই। আজ থেকে দু বছর আগে
বাংলাদেশের বই পেতে হলে হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন তারাই এনে দিতে পারতেন। তাও সময়
লাগতো অনেক। কিন্তু চিত্রটা পাল্টাতে শুরু করেছে। আমার আশা ছবির মানচিত্রও
পালটাবে। একই সাথে আমরা দুই বাংলার মানুষজন ছবির প্রথম দিনের প্রথম শোয়ের দুর্লভ
মুহূর্ত শেয়ার করবো নিশ্চই একদিন।
ছবি আমাদের জুড়ে দেবে দুই দেশকে...মানুষকে...সংস্কৃতিকে...ভাষাকে...
নিশ্চিত।
লেখাটি 'বাংলাদেশের খবর'-এ প্রকাশিত। ২১ এপ্রিল,২০১৮।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন