একা হয়ে যাওয়ার পঞ্চাশ বছর



“আমার চারপাশে ঘন অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি আলোকিত বৃত্তের মাঝখানে। পরিক্রমা করে চলেছি একটি উজ্জ্বলতম পটভূমি। আমি জানি, স্থির জানি, এই আলো, উজ্জ্বলতা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। সেই আলো যে কোন মুহূর্তে নিভে যেতে পারে। আমাকে নিক্ষেপ করতে পারে আরও গভীরে। গভীরতর অন্ধকারে। অথচ আমার চারপাশের এই ঘন অন্ধকারের ওপারেই আছে বিরাট এক আলোর জগৎ। সে আলো মেকী নয়। কৃত্রিম নয়। সেই আলোর জগৎ থেকেই আমার আসা। এসেছিলাম অনেক অন্ধকার পেরিয়ে। কী ভয়ঙ্কর সেই অন্ধকারের মূর্তি।” (আমার আমি/ উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়)
লিখেছিলেন আমাদের মহানায়ক তাঁর আত্মজীবনীর একদম গোড়ায়। কেন তিনি এমন লিখলেন? প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে এসে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয় ১৯৬৮ সালের একটি বিখ্যাত ছবির, বিখ্যাত গানের লাইনে। “বড় একা লাগে...এই আঁধারে...”। ক্লান্ত লাগে স্যাটা বোসকে চৌরঙ্গীর পটভূমিকায়। বড় আলো আঁধারি ঘিরে ধরে তার চারপাশকে। যে আলো আঁধারির অন্তরঙ্গতা বরাবরই ঘিরে থেকেছে আমাদের মহানায়ককে। অন্ধকারকে ভয় পায় না এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। কিন্তু এই অন্ধকার আসলে কোন এক মানুষের আস্তে আস্তে চারপাশ থেকে একা হয়ে যাওয়ার গল্প। আসলেই যে অন্ধকার এনে দেয় সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তী নায়ককে এক পাশে। কখনও আপন মনে। শ্যুটিং-এর মধ্যান্তরে। অথবা একা একা অনেক রাতে বাড়ি ফেরার সময়। কিন্তু যিনি মহানায়ক তিনি কী করে একা হয়ে যাবেন? চারপাশে এতো লোক। এতো আলো। খ্যাতির মধ্য গগনে যার সব সময়ে বিচরণ। স্টুডিওর ফ্লোর থেকে শুরু করে বাড়ির বৈঠক খানায় যাকে কোনদিন একা দেখা যায়নি। সবাই মিলে ভাগ করে না খেলে যাঁর দুপুরের খাওয়া হতো না। তিনি একলা? কিন্তু অবাক লাগে ‘আমার আমি’র প্রতিটা পাতায় কোন এক একা হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প শুনতে। বড় আদর করে যিনি তাঁর আত্মজীবনীতে শুনিয়েছেন তাঁর ঘর গেরস্থালির কথা। প্রিয়জনদের কথা। প্রেমের কথা। অন্দরের কথা। একজন সাধারণ কেরানী থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার গল্পের কথা। কিন্তু সে তো আলোচনার অন্য পরিসর। একটা মানুষের জীবনকে সাজিয়ে নেওয়ার নক্সী কাঁথা।
ঠিক এই মুহূর্তে যে সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি, নিরীক্ষণ করছি টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ার মোড়ের সেই সোজা হয়ে দাঁড়ানো স্ট্যাচুটাকে। শ্রদ্ধায় যার সামনে নত হয়ে দাঁড়াচ্ছি। আমাদের বাংলা সিনেমার সেই সোনালী যুগের ম্যাটিনি আইডলের চারটি ছবি ২০১৮ সালে পঞ্চাশ বছর পার করার সীমান্তে দাঁড়িয়ে। চৌরঙ্গী, তিন অধ্যায়, গড় নসিমপুর, কখনো মেঘ। চারটি ছবি চার মানুষের গল্প। চার মানুষের অন্য অভিব্যক্তির রঙে ছোপানো ক্যানভাস। কিন্তু নায়ক তো এক। তিনি উত্তমকুমার। যাঁর জীবনের শেষ থেকে শুরু প্রতিটা ঘটনায় মোড়া। টানটান চিত্রনাট্যের মতোই। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত যাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। যিনি একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক, সঙ্গীতকার এবং অবশ্যই পরিচালক কখনও বা লেখক। এমন এক মানুষের জীবনের এক কোন এক বিশেষ বছরের ইতিহাসের পাতা খুলতে গেলে এসে পড়ে তার সাথে জড়িয়ে থাকা আরও নানান সময়ের ঘটনা। টুকরো স্মৃতির আলেখ্য। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখা মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গী। এইসব উপাদান নিয়ে থাকলো আমাদের প্রিয় মানুষটাকে আর একবার ফিরে দেখা। বিশেষ বছরের নিরিখে।
১৯৬৮ সালের আগের বছরটা, মানে ১৯৬৭ সাল নায়কের কেটেছে নানা রকমের অভিজ্ঞতায়। এ্যান্টনি ফিরিঙ্গী সুপার ডুপার হিট। সত্যজিতের চিড়িয়াখানা ও এ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর জন্য শ্রেষ্ঠ নায়ক হিসেবে ভারত সরকারের তখনকার সর্বোচ্চ সম্মান ভরত পুরষ্কার পাওয়া। একমাত্র তিনিই এই সম্মান পেয়েছিলেন। এর পরে কাউকে এই পুরষ্কার দেওয়া হয়নি। গৃহদাহ ছবির জন্য বি এফ জে এর বর্ষসেরা নায়ক। উত্তমকুমার আত্মজীবনীতে লিখছেন, “বছর আরম্ভের প্রথম দিনের আলো দেখে বুঝতে পারিনি আমার জীবনে কী বার্তা বহন করে নিয়ে এলো নতুন বছরটা। আমি মনে মনে প্রস্তুত। উত্থান হলে উচ্ছ্বসিত হবার কারণ থাকবে না। পতন এলে নিজেকে নিঃশেষ করে দেবো না। প্রতীক্ষায় রইলাম আমার দর্শকদের শেষ বিচারের আশায়।” কে এমন লিখলেন তিনি? যে বছর তাঁকে উজাড় করে দিল সন্মান, পুরষ্কার, সাফল্য সেই বছরেই ছোটি সি মুলাকাতের শুভমুক্তির দিন হল হার্ট এ্যাটাক। এবারেরটা বেশ চিন্তায় ফেললো ডাক্তারদের। কিন্তু হৃদয়ে এই যে রক্তক্ষরণ সেতো আর এমনি হয়নি। কিছুক্ষণের জন্য এই যে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া তারও তো একটা কার্যকারণ সূত্র ছিল। সবাই জানতো, যে পরিমান খাটনি যাচ্ছে নায়কের একটি ছবি শেষ করতে তারজন্য তাঁকে না চরম মূল্য দিতে হয়। শুধু আর্থিক নয় শারিরীকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ছোটি সি মুলাকাত শেষ করতে গিয়ে। আর সেটাও তো ছিল সেই ১৯৬৭ সালেই।




নায়কের নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নের প্রজেক্ট কিভাবে নষ্ট করেছিল ঘরের শত্রু বিভীষণেরা তার বিস্তারিত কথা লিখে গেছেন তরুণ কুমার ‘আমার দাদা উত্তমকুমার’ বইটিতে। এখনও সেই বিশ্বাস ভঙ্গের গল্প স্টুডিও পাড়ায় ঘোরা ফেরা করে। পুরনো দিনের কোন কোন মানুষ এখনও দুঃখ করে শোনান একটা ছবি করার জন্য কিভাবে দেউলিয়ার মতো হয়ে গিয়েছিলেন মহানায়ক। কিভাবে বিশ্বাসঘাতকদের চক্রব্যুহের মাঝে তাঁকে একা লড়তে হয়েছিল। জীবনের সেই চরম সঙ্কটে সত্যিই কি একা হয়ে যেতে হয়নি তাঁকে? মুখ আর মুখোশের আড়ালে যে মানুষ গুলো তারা কি সত্যিই তাঁকে একা করে দেয়নি? ভীষণ কষ্টে তলিয়ে যেতে হয়নি কি তাঁকে? কিন্তু তিনি উত্তমকুমার। তিনি জানেন কেমন ভাবে একা পার হতে হয় রাস্তা। হেঁটে যেতে হয় অনন্ত পথ। না হলে এক ছা পোষা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের কেন মনে সাধ জাগবে একদিন সে নামকরা অভিনেতা হবে? বাবার সাথে গিয়ে অবাক হয়ে দেখবে হলিউডের সব নায়ককে মেট্রো সিনেমার পর্দায়। যে পর্দায় ছবি চালানোর কাজে নিযুক্ত সেই হলে তার বাবাই। ব্রিটিশ আমলের সিনিয়র প্রজেক্টশানিস্ট বাবা বুঝতে পারেননি সেদিন  যাকে হাত ধরে ছবি দেখতে তিনি নিয়ে আসছেন একদিন এই হলে শুধু মাত্র ইংরাজী ছবি চলার নিয়মকে গুলি করে তাঁর ছেলের ছবি চলবে দিনের পর দিন। সেই তন্ময় হয়ে সিনেমা দেখা ছেলের সব কিছুই একদিন স্টাইল হয়ে উঠবে। আইকন হয়ে যাবে বাঙালীর। তাঁর কোর্ট পরা, ঠোঁটের কোনে ঝোলানো সিগারেট, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো, পিয়ানোয় সুর তোলা দেখতে ভেঙে পড়বে সমগ্র বাঙালী। হাউজফুল লিখে লোকজন ভিড় করে থাকবে হলের সামনে। আর সাক্ষী হয়ে জ্বলজ্বল করবে নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।


কিন্তু এতোটাও সহজ ছিল না ব্যাপারটা। এর আগে জীবনের শুরুতে যার প্রথম সাতটি ছবি ফ্লপ। স্টুডিও পাড়াতে যাকে নায়ক হিসেবে নিলে মুখ ফেরাচ্ছিল ড্রিস্টিবিউটার, এক্সিবিটর সবাই। পাশ দিয়ে যেতে গেলে শুনতে হতো, “ওই যে ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল এসেছে।” তিনি একটা মাত্র ছবির অসাফল্যে হার মানবেন না তা বুঝতে পেরেছিল ইন্ডাস্ট্রি। কারণ এক মহানায়কের গল্প তখন সবার মুখে মুখে। সবাই জানে এই সাফল্য কেউ তাঁকে হাতে তুলে দেয়নি। চরম আঘাত, অপমান, লাঞ্ছনার পথ পেরিয়ে ভবানী পুরের অরুণ হয়েছিল সারা ভারতের উত্তমকুমার। 


উত্তমকুমারের স্টুডিওর প্রথম দিকের অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন তাঁর বড় আদরের ভাই বুড়ো অর্থাৎ তরুণ কুমার। এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয়। খুব দুরু দুরু বুকে উত্তমকুমার পা রাখলেন স্টুডিও ফ্লোরে। পরিচালক শট বুঝিয়ে দিলেন। চারপাশ থেকে আলো জ্বলে উঠলো। এই প্রথম নবাগত অভিনেতা দেখলেন তার সামনের অভিনেত্রীর মুখ। সেই সময়কার বিখ্যাত প্রভা দেবী। পাশের ভিড় থেকে কে যেন বলে উঠলো, “এ কলির ভীমকে কোত্থেকে আনলেন? পায়ে শেকল বেঁধে রাখুন। নইলে যে ঝড় উঠলে উড়ে যাবে” তখন উত্তমকুমার সত্যিই রোগা ছিলেন। প্রচন্ড অপমানিত হলেন ফ্লোরের মধ্যে শ্যুটিং দেখতে আসা, অন্যলোকের তাঁবেদার কিছু মানুষের কাছে। তবুও গায়ে মাখলেন না কিছু। পরিচালক স্টার্ট ক্যামেরা বলার সাথে সাথেই এক কদম এগিয়ে গেলেন অভিনেত্রীর দিকে। কিন্তু পরিচালকের এ্যাকশান বলার আগেই প্রভা দেবী নায়কের হাতটা আচমকা ধরে ফেললেন। “আরে এই ছেলে আমার ডাক্তারী পরীক্ষা করবে কী? ওর নিজেরই তো হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।” চারপাশ থেকে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। পরিচালক সেদিন আর শটটা নিলেন না। ভাই তারও অনেক দিন পর স্মৃতিচারণায় লিখলো, “সেদিনের সেই অপমানের খবরটা দাদা আমাকেও জানায়নি। পুষে রেখে দিয়েছিল আপন মনের গভীর গোপনে। এটাই ছিল দাদার স্বভাব। যে মানুষটার মন আর পাঁচজনের দুঃখে কেঁদে উঠতো। অন্যের চোখের জল মোছানোর জন্য যে মানুষটা বারে বারে ঝাঁপিয়ে পড়তো নানান বিপদে সঙ্কটে। সেই দাদা কিন্তু কোন ঘটনায় বা কারও আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে উঠলেও চট করে মনের আগল খুলে ধরতো না।” সবটাই থেকে যেত মনে মনে। সব অপমান, সব ঈর্শা, সব হিংসার জবাব দিয়েছিলেন তিনি শাদা পর্দায়। তাঁর অভিনয়ে। তাঁর সৃষ্টিতে। যা দেখার জন্য আট থেকে আশির ভিড় উপচে পড়তো। যিনি ধরে রেখেছিলেন একটা সময়কে। বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিকে। 





আসলে এতো শক্ত মনের কোমল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে তাকে গড়ে দিয়েছিল তার শৈশব থেকে বড় হয়ে ওঠার রাস্তা গুলো। কে না জানে সলতে পাকানোরও তো একটা গল্প থাকে। ঠিক তেমনি এই মানুষটার ছোটবেলা কেটেছে এক অন্য ছন্দে। সেখানে লুনার ক্লাব যেমন মন্বন্তরে খিচুড়ী বিলি করেছে। তেমনি নেতাজীর ভাবনায় অনুপ্রানিত হয়ে মিছিল করেছে রাস্তায়। গোরা সৈন্যদের মার উপেক্ষা করে একটা মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। রয়েছে ব্রিটিশ তাড়ানোর সংকল্প। তার সাথে নাটক চলছে নিয়মিত। কচি সংসদ, গুরু দক্ষিণা, ডাকঘর। উৎসাহ দেখা যাচ্ছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের। তারও নিয়মিত তালিম চলছে। আর এই গান শিখতে যাবার সময়েই জীবনের প্রথম প্রেমটাও ঘটিয়ে ফেলছেন নায়ক গৌরী দেবীর সঙ্গে। সেটাও উত্তমকুমারের জীবনে এক রূপকথার মতো। বড় লোকের বাড়ির মেয়ের সাথে প্রেম বলে কথা। যাকে পাহারা দিয়ে স্কুলে দিয়ে যায় প্রহরী। সেই প্রহরীকে কিভাবে চোখে ধুলো দিয়ে প্রেম করতেন মহানায়ক তার সুন্দর বিবরণী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা মানুষের স্মৃতি কথায়। যেমন আছে এক দিন তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার গল্পও। যদিও তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন কোথাও যাননি তিনি। এ বাড়ি আর ও বাড়ির ব্যবধান তাঁর কাছে অনন্তের ছিল না। কতটা সংসারী ছিলেন আর কিভাবে সবাইকে আপনার করে নিয়েছিলেন তার দৃষ্টান্ত আছে প্রচুর। শুধু বাংলা সিনেমা শিল্প নয়, তার সাথে জড়িত মানুষরা যাতে ভালো থাকে। তাদের যাতে কোন রকমের অসুবিধে না হয় তার দিকে তাঁর ছিল সজাগ দৃষ্টি। চেষ্টা করেছিলেন রুপালী পর্দার সেই ক্যামেরার পেছনের মানুষ গুলোর মুখে হাসি ফোটাতে। তাদের চিকিৎসার যেন ব্যবস্থা হয়। তারা যেন তাদের প্রাপ্য মজুরী পায়। কিন্তু এতো সব করেও তাঁকে আঘাত সইতে হয়েছে বারবার। ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে সংগঠন। ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু মুখে তিনি কোনদিন কিছু প্রকাশ করেননি। খুব হইহই করা মানুষটা আস্তে আস্তে নিজের চারপাশে নিজেই কেমন যেন এক মন কেমনের পাঁচিল তুলে নিয়েছে। যে পাঁচিল ভেদ করা অসাধ্য। যার মধ্যে একমাত্র নায়কের আছে প্রবেশের অনুমতি। তাঁর সব থেকেও এক একাকিত্ত্বের রাজত্ত্ব।


এ্যান্টনি ফিরিঙ্গির প্রায় এক বছর পর মুক্তি পেয়েছিল চৌরঙ্গী। এই দীর্ঘ সময় লাগার একটাই কারণ ছিল, নায়কের অসুস্থতা। ছোটি সি মুলাকাতের এক বড় ধাক্কা সামলানোর অভিজ্ঞতা। গড় নসিমপুর, কখনো মেঘ, চৌরঙ্গীর মতো ছবি গুলোর কাজ শুরু হয়েছিল নায়ক সুস্থ হয়ে ওঠার পর। চৌরঙ্গীর সঙ্গে একই সপ্তাহে রিলিজ করেছিল তিন অধ্যায় ছবিটিও। একদিকে যখন চৌরঙ্গী হাউজফুল যাচ্ছে শ্রী, পূরবী, উজ্জ্বলা, উত্তরায়। অন্যদিকে তেমনই উত্তম সুপ্রিয়ার জুটি দর্শক মাতাচ্ছে তিন অধ্যায় ছবিতে রূপবানী, ভারতী, অরুনায়। আজ ভাবতে অবাক লাগে এমনও সময় গেছে যখন মহানায়কের ছবি রিলিজ করছে বছরের প্রতিটি মাসে। কি অমানসিক পরিশ্রম আর নিষ্ঠা না থাকলে এই জায়গায় মানুষ নিজেকে নিয়ে যেতে পারে। চৌরঙ্গী নিয়ে অনেক ছোট ছোট গল্প শোনা যায়। এবার সেগুলো একটু বলি। শঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাসের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন অমল সরকার। প্রথমে ঠিক ছিল অগ্রগামী পরিচালনা করবে চৌরঙ্গী। কিন্তু পরে পরে পরিচালনা করেন পিনাকী মুখার্জী। এই ছবি তৈরীর সময় ছবির শ্যুটিং শিডিউল থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন উত্তমকুমার স্বয়ং। কারণ ছবিটি বেশী ব্যয় বহুল হয়ে পড়লে যদি প্রযোজকরা পিছিয়ে আসেন। অথচ নায়কের প্রচন্ড পছন্দের গল্প। এদিকে প্লট অনুযায়ী পুরোটাই হোটেল কেন্দ্রিক। এর সেট যদি স্টুডিওতে নির্মাণ করতে হয় তাহলে যে পরিমান খরচ হবে সেই পরিমান বাজেট প্রযোজকদের ছিল না। ঠিক করা হল রিয়েল লোকেশানে ছবিটির প্রায় আশি শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হবে। এরজন্য ব্যবহার করা হল গ্র্যাণ্ড হোটেলকে। শীতের মরসুমে বড় দিনে এমনিতেই গ্র্যান্ড হোটেল খুব সুন্দর করে সেজে ওঠে তাই আলাদা করে তাকে সাজানোর দরকার পড়বে না। শুধু তাই নয় যাবতীয় চরিত্রাভিনেতা যেমন ভানু, শুভেন্দু, জহরদের মেক-আপ করিয়ে একটি ঘরে বসিয়ে রাখা হল উত্তমকুমারের প্ল্যান ও পরামর্শ অনুযায়ী যাতে তাদের ডাকলেই এবং হোটেলের বিভিন্ন জোন খালি হলেই শ্যুট করা যায়। অনেকটা ঝুকি নিয়েছিলেন নিজের দিক থেকেই নায়ক। সবে সুস্থ হয়ে উঠছেন তখন একটু একটু করে। ময়রা স্ট্রিট থেকে হোটেল এইভাবে যাতায়াত না করে নিজেই থাকতে শুরু করলেন শ্যুটিং এর জন্য হোটেলে একটি শ্যুট বুক করে। যতদিন না চৌরঙ্গীর শ্যুটিং শেষ হল ততদিন রয়ে গেলেন সেখানেই। নিজেই সব কিছুর তদারকি করলেন। এখন ফিরে তাকালে মনে হয় ছবিটি আদর্শ টিম ওয়ার্কের নিদর্শন হয়ে আছে বাংলা ছবির ইতিহাসে। অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের সুরে। মিন্টু ঘোষের লেখনীতে মান্নাদের বড় একা লাগে তখনও ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আজও। মনে রেখে যাওয়ার মতো কাজ করেছিলেন সুপ্রিয়া দেবী, অঞ্জনা ভৌমিক, দীপ্তি রায় থেকে শুরু করে উৎপল দত্ত, জহর রায় প্রমুখরা। মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে দেখানো হয় ছবিটা এখনও। অনেক চ্যানেলে। ইউ টিউবে। এক একা মানুষের একাকিত্ত্ব দর্শক নায়কের অনুভূতিতে মাতোয়ারা হতে চায়।


সিনেমাকে অনেকে বলেন স্মৃতির সফর। সেই কবেকার শহর, গ্রাম, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় স্টার এক লহমায় যেন চোখের সামনে এসে পড়ে। ঠিক তেমনই বারবার যেন প্রিয় ছবি গুলোর সফরে বেড়িয়ে পড়তে চায় মন। যে প্রিয় ছবিগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। যিনি চলে যাবার পর অনেকদিন লেগেছিল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে সেই ক্ষতির দাম পূরণ করতে। এক স্মৃতিচারণায় আর এক বিখ্যাত অভিনেতা, চৌরঙ্গীতে নায়কের সহকর্মী শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “বাংলা চলচ্চিত্রকে যিনি ত্রিশ বছর প্রায় একার কাঁধে টেনে নিয়ে গেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর আমরা বুঝতে পেরেছিলাম তিনি বাংলা সিনেমার কতখানি জায়গা জুড়ে আছেন। তিনি মারা যাবার আগেও তাঁর পাঁচশো মাইলের মধ্যে কেউ ছিলেন না। তিনি মারা যাবার পরও তাঁর পাঁচশো মাইলের মধ্যে কোন অভিনেতাকে নজরে পড়ে না। এটা বোঝা যায় যখন উনি মারা যাবার পর সারা বাংলা ভেঙে পড়েছিল। বাঁধভাঙা ভালোবাসারই প্লাবন। আসলে চলচ্চিত্র জগৎ যেখানটায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে তা হচ্ছে তার অর্থনৈতিক দিকটা। সেখানেই একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখা দিল উত্তমকুমার মারা যাবার পর। ওঁর মারা যাবার পর দেড়-দুবছর স্টুডিওতে কোন ছবি হতো না। স্টুডিওতে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ...একজন অভিনেতা মারা যাবার পর এইরকম ইমপ্যাক্ট আগে কখনও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। এখন মারা যাবার এত বছর পরেও যেভাবে ওঁর জন্মদিন পালন করা হয়। এবং মৃত্যুদিন ২৪ জুলাই শুধু নয় পুরো জুলাই মাস ধরে টিভির সব চ্যানেলে শুধু ওনার ছবি দেখানো হয়, পৃথিবীর চলচ্চিত্র ইতিহাসে কোন অভিনেতাকে নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এটাই বোধ হয় অমরত্ত্ব।” সেই অমরত্ত্বের আস্বাদ ছড়িয়ে আছে স্টুডিও পাড়ায়। ছড়িয়ে আছে নানা গল্পে, স্মৃতিচারণায়। দর্শকের মনে। একটা মানুষের অনুপস্থিতিতে, স্টুডিও গুলো একা হয়ে যাওয়ার পঞ্চাশ বছর পরেও।

সূত্র


আমার আমি-উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়। আমার দাদা উত্তমকুমার- তরুণকুমার। উত্তমকুমার সংখ্যা, তেহাই। সম্পাদক- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য। 

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'রোজকার অনন্যা' পত্রিকায়। জানুয়ারী, ২০১৮।

 

মন্তব্যসমূহ

  1. নামহীনমে ২৫, ২০২৩

    আরো বিস্তারিত জানতে চাই।আমার কাছে মহানায়ক উত্তমকুমার এক আকাশ নয় ,মহাকাশ। যাঁর সিনেমা দেখে অনিদ্রায় ভোগা মানুষ ঔষধের মত রোজ রাতে সেবন করে সুখে নিদ্রা যায়।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি