একাত্তরের দিন গুলি



কোন এক পড়ন্ত বিকেলে আমরা ঢাকার রাস্তায় কণিকা নামের একটা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে। আসলে আমরা খুঁজছিলাম একটা ফেলে আসা সময়কে। একটা পরিবারকে। যে বাড়িটা আসলে ব্লাইন্ড লেনের এক্কেবারে শেষ সীমায়। যে বাড়ির গলি আঁধার রাতে ভারী হয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারী বুটের আওয়াজে। যে বাড়িতে এক মা অপেক্ষা করে গেছেন ছেলের জন্যে। স্বামীর জন্যে। কিন্তু তাঁরা আর কেউ ফিরে আসেননি কোন দিন। দোতলায় উঠতে ঢুকেই একটা প্রশস্ত ঘর। একটা খাট। রেফ্রিজারেটার। বইয়ের আলমারী। গানের ক্যাসেট। দেওয়াল জুড়ে মিষ্টি হাসির রুমী। তার জামা কাপড়। তার প্রাইজ পাওয়া নানা স্মারক। ব্যাটমিন্টনের ব্যাট। প্রথম উপহার পাওয়া বই। মাকে জন্মদিনে দেওয়া শুভেচ্ছা কার্ড। যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে প্রথম লেখা চিঠি। চারিদিকে এক পরিবারের স্বচ্ছল খুঁটিনাটি। বাইরে ঝিম ধরা এক টানা বৃষ্টি। আর ভেতরে চোখ ভারী হয়ে আসা কষ্ট। যেন এখনও এই বাড়ির এই আসবাব, এই স্মারক, এই সময় অপেক্ষা করছে গোটা পরিবার ফিরে আসার। এক মা অসুস্থ শরীরে লিখে ফেলছেন যুদ্ধের দিনলিপি। নিজের ছেলেকে দেশের জন্য কুরবানী দেওয়ার ইতিহাস। ওই তো টেবিলের ওপর পড়ে আছে নীল খামে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছানি। সেদিন কি আনন্দ এই ঘর গুলোয়। বাবার শুধু একটা কথায় থমকে গিয়েছিল ছেলে। এই সময়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া কি উচিত? যায়নি রুমী। মা কিছু বলতে পারেননি। এক অজানা আশঙ্কায় মনে ঢেউ উঠেছে। নিজে হাতে করে যেন তুলে দিয়ে এসেছেন ছেলেকে শত্রু পক্ষের মৃত্যু শিবিরে। ততদিনে এসে গেছে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা নানা ব্রিজ আর রাস্তার নক্সা। যে গুলো পাকিস্তানী মিলিটারীরা দখল করলেই যথাযথ ব্যবস্থা নেবে মুক্তিযোদ্ধারা। এদিকে ত্রিপুরার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ঘুরে আসা হয়ে গেছে। অবরুদ্ধ ঢাকার হ্যারিকেনের আলোতে মা চেয়ে আছেন ছেলের দিকে। এই ক’মাসে কত বড় হয়ে গেছিস রে তুই। তিন দিনের অভুক্ত ছেলে বন্ধুদের সাথে তখন খাচ্ছে। এদিকে দরজায় মিলিটারী। রুমী সেই যে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। অনেকের মতো বসন্তের পলাশ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে। আর তার অসুস্থ মা একটা বই বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছিলেন সদ্য জন্ম নেওয়া একটা দেশের কথা শোনাতে। যে দেশ জন্ম নিয়েছিল একটা ভাষার জন্য। শহীদ জননীর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ শুধু বাংলায় নয় বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে দুর্লভ। শুধু আজকের এই ডামাডোলের প্রেক্ষাপটে আমরা বাঙালীরা সেটা মনে রাখলেই এই ভালোবাসার মাসে তার ভালোলাগার সার্থকতা থাকবে। মাতৃভাষাকে তখন আর দুরছাই মনে হবে না।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি