বাংলা ছবিতে যানের মোটিফ


‘যান’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে কী ধরনের দৃশ্য ভাবনার সূচনা হয়? সেই দৃশ্যভাবনা আমাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বাস্তবিক জীবনের কোন কোন অনুষঙ্গকে কিভাবে বহন করে আনে? আমাদের স্মৃতি...সত্ত্বা...ভবিষ্যৎ কিভাবে প্রচ্ছন্ন বা প্রকট থাকে একটা শব্দের মধ্যে?ওপরের ছবিটি অযান্ত্রিকের।ঋত্বিক ঘটকের এই ছবিতে মূখ্য চরিত্রে এক গাড়ি। তার নাম জগদ্দল। যদিও এই ছবিটি নিয়ে আমার আলোচনা করার সুযোগ এবং সময় কম। কারণ আমার পূর্বোক্ত বক্তা অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এই ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এক অন্য দৃষ্টিভঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। যা এই সেমিনারে ইতিমধ্যেই আলোচিত। আমরা বরং এই সময়ের একটু কাছাকাছি ঘোরাফেরা করি। সঞ্জয়দা যেমন ষাট সত্তরের দশকের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তার থেকে আমরা একটু সরে আসি। আরও এক দশক এগিয়ে যাই। চলচ্চিত্রের সাথে একটু একটু করে টেলিভিশন...আমাদের দেখা...দৃশ্য জগৎ...তার কল্পনা একটু একটু করে বিস্তারিত হোক। শিকড়ে ফিরে আসার অবকাশটাও থেকে যাক কথার পিঠে কথা আর আলোচনার যুক্তিতে। 

যদি এইভাবে ভাবতে চাই তাহলে দেখবো খুব সহজেই যান এই শব্দের সাথে জড়িয়ে থাকা অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক স্মৃতিচারণা, অনেক দৃশ্যকল্প হয়তো এক জায়গায় জড়ো করতে পারছি। আশি ও নব্বইয়ের দশকের গোটা পরিধি জুড়ে যাদের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন কেটেছে তাদের সাথে কোথাও যেন মিশে গেছে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এক অবাক করা দৃশ্যকল্পের মাধ্যম। বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মতো টেলিভিশনের উপস্থিতি তখন বাঙালী মধ্যবিত্ত সংসারে ক্রমে প্রধান এবং অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছে। ওই চৌকো বাক্সটা আমাদের অবাক করে শিখিয়ে যাচ্ছে চারপাশের না দেখা অনেক ঘটনা। গল্প। বুনে চলেছে স্বপ্নের জাল। কখন কোনটা করলে কি সুবিধে পাওয়া যাবে তার হিসেব-নিকেষ। কাজেই নমস্কার করে “আজকের বিশেষ বিশেষ খবর”...যেমন পড়ছেন ছন্দা সেন ঠিক তেমনি দেখতে পাচ্ছি একটা গাড়ির বিজ্ঞাপণে কিভাবে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে দেশকে, সমকালকে। ভালোবাসার আবহে গাড়ি বিক্রির দৃশ্যকল্প কোথাও যেন এক ‘নতুন ভারত’কে...তার নাগরিকদের চিনিয়ে দিচ্ছে।


আমরা সেই সময়ের অধিবাসী, যে সময়ে বাড়িতে টেলিভিশন এলে পাড়ায় আলোড়ন পড়ে যেত। একটি পাড়াতে একটি ফোন থাকাই লোকজন যথেষ্ট মনে করতো। বাতাসে এ্যান্টেনা ঘুরে গেলে তাকে ঠিক করে দিয়ে আসতে হতো। যাদের কাছে ভারতীয় তথা বাংলা ছবির বিপুল এবং বিশাল ভান্ডার খুলে দিয়েছিল দূরদর্শন। মনে মনে কোথাও স্বপ্ন দেখিয়েছিল জীবিকা হিসেবে তাকে গ্রহণ করার।

একটা মাধ্যম আমাদের দৃশ্যকল্প গুলোকে যেমন সারবেঁধে সাদা-কালোয় এবং পরে রঙীন হয়ে বাঁধতে শুরু করলো তেমনি আমাদের চিন্তা জগতে দৃশ্যভাবনায় এলো পরিবর্তনের ছোঁওয়া। আমাদের চাওয়া ও পাওয়া গুলো পট পরিবর্তন করতে শুরু করলো। দূরকে নিকট যেমন আমরা করলাম নিকট আমাদের থেকে যেন আরও অনেক দূরে চলে গেল। বোকা বাক্স নাম দিয়ে তাতেই আমরা মজে থাকলাম। প্রাথমিক স্তরে খুব ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলার মতো টেলিভিশন এই কীর্তিটা চালিয়ে গেলেও তখনও সিনেমা হল গুলি ছিল তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে স্ব-মহিমায়। সলতে পাকানোর কাজটাও তো ওখান থেকেই শুরু। সেই ফেলে আসা শক্ত ভিত্তি ভূমিকে অস্বীকার করবো কী করে? কারণ ওখান থেকেই তো জন্ম নিচ্ছে এক চিত্রভাষার। যে ভাষা একশো বছরও অতিক্রম করে আমাদের মধ্যে টিকে থাকবে। কিন্তু সেই একশো বছরের চিত্রায়ণের গতিপথে যাত্রা করার আগে ঠিক টেলিভিশনের যুগে বড় হওয়া এবং তাকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এক পরিচালকের প্রথম ছবির একটা গানের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আমরা চলে যাবো। ফিরে আসবো প্রশ্ন উত্তরে। দৃশ্যের সম্ভাব্যতায়। তার চিহ্ন গুলোকে প্রশ্ন করতে করতে।  
 

 বিরসার প্রথম ছবি জিরো থ্রি থ্রি তে যেভাবে কলকাতা শহর, তার চরিত্র, তার নিজস্বী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেটা এক শাহুরিক দিক চক্রকে সূচিত করলেও ছবির নিজস্বতা অন্য অনেক কিছুর মতোই নতুন দশকের গোড়ার দিকের প্রবীন ও নবীনদের অনেক গুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করে গেল। কিন্তু এখন তো বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার সময়। এর বহু আগের তো একটা প্রেক্ষাপট আর ইতিহাস আছে। সেই দিকে ফেরা যাক।

শুরুর কথা...


১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড কাফেতে লুমিয়ের ভাইয়েরা যে কয়েক টুকরো চলন্ত ছবি দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য ছিল একটি ট্রেনের স্টেশনে প্রবেশের মুহূর্ত। শতাব্দীর সেই বিষ্ময়কর আবিষ্কারে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট ছিল। শোনা যায় চলচ্চিত্রের সেই প্রথম দর্শকরা ভয় পেয়ে একে অন্যের ঘাড়ে পড়ে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে ছুটন্ত ট্রেনটি হয়তো বা শাদা পর্দার ভেতর থেকে তাদের ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়বে। 

এক বছরও লাগেনি লুমিয়েরদের ছবি ব্রিটিশ শাসনে থাকা ভারতে এসে পৌঁছোতে। তখনকার বোম্বের ওয়াটসন হোটেলে (৭ জুলাই, ১৮৯৬) সাহেব বাবুদের দেখানোর পরেই দেশের সাধারণ মানুষদের দেখানোর জন্য অন্যত্র শস্তার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। ধরে নেওয়া যেতে পারে এখানেই ভারতের উত্তর প্রজন্মে যাঁরা ছবি নির্মাণের সাথে যুক্ত হবেন তাঁরা খুব মন দিয়ে এবং কৌতূহলের সাথে ছবি দেখেছিলেন। দাদা সাহেব ফালকে, হীরালাল সেনের ওপরে প্রামান্য লেখাগুলো তারই ইঙ্গিত বহন করে। দাদা সাহেব ফালকে যেমন নিজ উদ্যোগে ছবি নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনি হীরালাল সেন স্থাপন করেছিলেন তাঁর রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানী। এই রয়াল বায়োস্কোপ শুধু থিয়েটারের অংশ বিশেষ তাদের ক্যামেরা বন্দি করলো না। বরং তারা আরও একধাপ এগিয়ে ঢুকে পড়লো বাঙালীর অন্দরে। হীরালাল সেন জবাকুসুম তেলের বিজ্ঞাপণ নির্মাণ করেছিলেন। দুঃখের বিষয় দাদা সাহেব ফালকের বেশ কয়েকটি ছবি এখনও জীবন্ত থাকলেও হীরালাল সেনের কোনো ছবিই আমাদের কাছে নেই। তাঁর মারা যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে তা নষ্ট হয়। তারও অনেক পরে যখন ভারতের মধ্যে কলকাতায় ম্যাডানরা স্থাপন করলেন প্রথম সিনেমা হল এ্যালিফিনস্টোন পিকচার প্যালেস (১৯০৭) তখন সেখানে প্রদর্শিত নির্বাক বাংলা ছবির কোনো নমুনা আমরা পাই না।  জন্মলগ্নের সূচনা অর্থাৎ ময়দানে তাঁবুর মধ্যে প্রদর্শনী থেকে সিনেমা হলে প্রদর্শনের এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা ছবি কেমন ছিল, কী তার চিত্রভাষা তা আমাদের কাছে প্রায় অধরা। মাত্র একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক ছবি জামাইবাবু (১৯৩১) আমরা দেখতে পাই। ‘জামাইবাবু’ ছবিটি দেখায় কলকাতা শহরকে। এখানকার এক শ্রেনীর বিশেষ মানুষদের। তাদের জীবনযাত্রাকে। চলমান ঘটনা যা শহরের বুকে আঁকড়ে থাকে তা জামাইবাবুর গল্পের হাসির উপাদান। শহর আর গ্রামের প্রভেদ এখানে শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের ইমেজকে চিহ্নিত করে। ‘গ্রামের অশিক্ষিত’ জামাইয়ের সাথে ‘শহরের শিক্ষিত’ জামাইয়ের তাই প্রতিতুলনা চলে আসে। তার সাথেই চলে আসে শহর। আর সেই সময়ের যানের ব্যবহার। চরিত্রের সাথে তার অন্য রকমের নিবিড় যোগাযোগের সূত্রটি।

নতুন চিত্রভাষার সন্ধানে...  

চলচ্চিত্রের যান্ত্রিক নির্ভরতা এবং তার আখ্যানে যানের মোটিফ বরাবরই প্রচন্ড আকর্ষিত করেছে চিত্রনাট্যকারকে। নির্মাতাকে। চলচ্চিত্রের ভাষাকে। মধ্য পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের ধারায় যে নতুন প্রবাহ শুরু হয়েছিল পথের পাঁচালীকে কেন্দ্র করে তার সুদূরপ্রসারী জয়যাত্রা সম্ভব হতো না যদি না চিত্রভাষার আমূল পরিবর্তন আনতেন কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র কর্মী। তবে সেটা তো একদিনে আসেনি। আসলে শুরুটা করেছিলেন বেশ কয়েকজন মিলে। একসাথে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক নতুন চিত্রভাষার সন্ধানে। নতুন পথের খোঁজে। অন্য কোথাও চলার তাগিদে। তারই পূর্ণতা যেন পায় পথের পাঁচালীতে। পরপর চারটে ঘটনা এই তরুণদের এক অন্য পথে চালিত করার প্রেরণা জুগিয়েছিল। 

এক- ১৯৪৭। দেশ স্বাধীন। দেশভাগ। দাঙ্গা। অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার। ওই একই বছরে স্থাপিত হল ভারতের মধ্যে প্রথম ফিল্ম ক্লাব। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। উদ্দেশ্য চলচ্চিত্রকে শিল্পের মর্যাদায় উত্তীর্ণ করা। তার চর্চা করা। ছবি দেখা, ছবি নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি ও তার নির্মাণ।


দুই- ১৯৪৯। ‘দি রিভার’ ছবিটি শ্যুটিং করার উদ্দেশ্য নিয়ে ফরাসী পরিচালক জঁ রেনোয়ার ভারতে আসা। খুব উল্লেখযোগ্য যে সেই সময়ের তথাকথিত টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি এই পরিচালক সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিল। অনেকে তাঁর সম্পর্কে জানতেন না। এই রেনোয়ার সাথে কাজ করছিলেন সেই সময়ের একঝাঁক শিক্ষিত যুবক। যাঁরা পরবর্তী কালে শুধু ছবি নির্মাণ করবেন তাই নয়...দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।


তিন- ১৯৫০। সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হল ‘চলচ্চিত্র-প্রথম পর্যায়’ নামের এক সংকলন গ্রন্থ। সম্পাদক মন্ডলীতে ছিলেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির কর্মকর্তারা। সম্পাদক মন্ডলীতে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, কবি নরেশ গুহ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সুভাষ সেন, চিদানন্দ দাশগুপ্ত।


চার- ১৯৫২। কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। 

কোথাও প্রচলিত ভাবনাগুলোর ক্ষেত্রে একটা প্রচন্ড ঝড় উঠলো। ঠিক এই সময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অবস্থা সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় একটা বড় প্রবন্ধ লিখলেন স্টেটসম্যান পত্রিকায়। ‘হোয়াট ইজ রং উইথ দ্য ইন্ডিয়ান ফিল্মস’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “গড়পড়তা মার্কিন ফিল্ম যে মডেল হিসেবে খারাপ, সেটা বোঝা দরকার। কথাটি এইজন্য বলছি যে ওতে যে জীবন বিন্যাস দেখানো হয়, আমাদের জীবন বিন্যাসের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র মিল নেই। ...সুতরাং ওই চাকচিক্য নয়, ভারতীয় সিনেমার আজ যা চাই তা হল আরও কল্পনা শক্তি, আরও সততা এবং এই মাধ্যমের যা যা সীমাবদ্ধতা তার যথার্থ উপলব্ধি।...সর্বোপরি আমাদের সিনেমায় যা চাই তা হল একটা নিজস্ব শৈলী, একটা বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গী, একটা নিজস্ব রূপ। যাতে কিনা দেখবামাত্র একেবারে নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, এটা ভারতীয় সিনেমাই বটে।” (সত্যজিৎ রায়, অপুর পাঁচালী, দেশ (শারদীয়), ১৪০০ বঙ্গাব্দ, পৃ-১১০-১১১)

সত্যজিতের এই প্রবন্ধের মধ্যেই পরবর্তীকালে রেনোয়ার কথার যেন এক সুপরিচিত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। “হলিউডের প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের দেশী রুচি কখনও যদি গড়ে তুলতে পারেন, আপনারা তাহলে একদিন মহৎ ফিল্মের জন্ম দিতে পারবেন।” (সত্যজিৎ রায়, কলকাতায় রেনোয়া, চলচ্চিত্র-প্রথম পর্যায়, সিগনেট প্রেস, পৃষ্ঠা-৪৬) রেনোয়ার সাথে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কখনও ছবির লোকেশানে, কখনও শ্যুটিং-এর সময়। তিনি অপুর পাঁচালীতে লিখছেন, “মাঠ-ময়দান, মানুষজন, পাকাবাড়ি, কুঁড়েঘর, কচুরিপানায় ভর্তি ডোবার ধারে কলাগাছের ঝাড়-এসব দৃশ্য এত খুঁটিয়ে তিনি দেখতেন যে, আমার তাক লেগে যেত। ...তাঁর এই প্রতিক্রিয়া দেখে আমার চোখও খুলে যাচ্ছিল। ছবি তোলার ভাবনাটা যে তিনি আমার মাথায় প্রথম ঢুকিয়ে দেন, তাও স্বীকার করবো।”


শুধু ছবি দেখা চলছিল না। তার সাথে নিপুণভাবে চলছিল চারপাশ ‘দেখা’র চর্চাও। একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট এরপরে যখন হাতে পাবেন একটা উপন্যাস যেখানে তাঁকে ছোটদের সংস্করণের জন্য ছবি আঁকতে হবে তখন তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়বেন অপুকে, দুর্গাকে, ইন্দিরঠাকুরণকে, বাবা হরিহরকে...মা সবর্জয়াকে...আর অনেকের অদেখা এক ট্রেনকে। যে ট্রেন ছুটেছিল শাদা পর্দায় সেই আঠারোশ পঁচানব্বই সালে। যে ছবি তাঁদের অনেক বন্ধুর প্রিয় ছিল সেই বাইসাইকেল থিভসও তো এক যানকে ঘিরেই। ইতালীর নব বাস্তববাদ এসে যেন পুরাতন চিন্তার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিল। প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব দেখে এসে ঋত্বিক ঘটক ‘পরিচয়’ পত্রিকাতে (১৩৫৮, চৈত্র সংখ্যা) লিখলেন, “এই উৎসবের আগে এবং পরে –দুটোর মধ্যে যেন একটা বিরাট পার্থক্য বর্তমান। অনেকগুলো চলতি ধারণা ছিল এদেশে, যেগুলো অগ্রসর দেশ গুলোতে রূপকথা বলে গৃহীত হলেও আমাদের অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে শোনানো হত। ...এই সমস্ত মিথ্যার ঊর্ণাতন্ত প্রথম দরজা খোলার হাওয়াতেই উড়ে গেছে। আজকের বলিষ্ঠ জীবনের ধারা চলে এসেছে ইতালীতে, রাশিয়ায়, চেকোশ্লোভাকিয়ায়। এসব দেশের ছবি কোনদিনই দেখানো হতো নাই বলা চলে। আজ আমরা সাধারণ দর্শকরা প্রথম দেখার সুযোগ পেলাম। ...কলকাতার দর্শকের কাছে এই উৎসব শিক্ষার একটি উৎস হিসাবে দেখা দিয়েছে। আমরা আগে যেমনটি ছিলাম তেমনটি আর থাকতেই পারি না।”


সত্যি, আমরা আগে যেমটা ছিলাম তেমনটা আর থাকতে পারলাম না। চারপাশের ছবি আমাদের নিয়ে গেল এক অন্য ভাষার খোঁজে। এক অন্য চিত্রকল্পের আঙিনায়। ভাষাটাও পাল্টাতে থাকলো। সেই চিত্রভাষার হাত ধরে কখনও গল্পের পটভূমি জুড়ে থাকলো ‘যান’। কখনও তা প্রচ্ছায়ার মতো থেকে এগিয়ে নিয়ে গেলো আখ্যানকে। কেউ আবার সেই যানের ওপর সওয়ারী হলেন। তাকে কেন্দ্র করেই যেন স্টুডিওর গন্ডি ছাড়লো বাংলা ছবি। কখনও প্রত্যন্ত গ্রাম, নদীর চর, পাহাড়, সমতলে কখনও বা সারা ভারতে ছুটে চললো তার ক্যামেরা। বাস্তবতার জীয়ন কাঠি লাগলো তার সর্বাঙ্গে। কাশ ফুলের মধ্যে দিয়ে দুইভাই বোন আর এক ট্রেনের চলন দেখলো বিশ্বের লোকজন অবাক বিস্ময়ে। ভারতীয় ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আলাদা করে গুরুত্ত্ব পেতে শুরু করলো। এক নতুন জয়যাত্রা সূচিত হল তার।



কিন্তু ছবির এই পরিসরে যানের ব্যবহার অসংখ্যবার...অনেক উপায়ে সজ্জিত হয়েছে। ১৯৫৫ সাল থেকে ২০১৬ এই বিস্তৃত সময় জুড়ে আমরা বরং দেখে নেওয়ার চেষ্টা করবো গল্পের বুননে, ছবির আবহে, চরিত্রের অনুষঙ্গে যান কিভাবে একাত্ম হয়ে পড়ছে। চিত্রনাট্যকারকে, পরিচালককে হাতছানি দিচ্ছে এক অন্য পরিমন্ডলে ছবি শুরু করার। তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আমরা যেমন আলোচনা করবো সেইসব ছবি নিয়ে যেগুলো আমাদের কাছে ধ্রুপদী শিল্পের মতো অক্ষয় অমর হয়ে আছে তেমনই আমরা ফিরে দেখার চেষ্টা করবো জনপ্রিয় আঙ্গিকের পটভূমিটিকেও। তার শর্তপূরণের চাহিদা গুলোকেও। 

কৃতজ্ঞতা
গুগুল ইমেজ
ইউ টিউব

 বাংলা ছবিতে যানের মোটিফ নিয়ে এক বিস্তারিত আলোচনা চলেছিল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। সেমিনারে কোনো লেখা সাধারণত পাঠ করার অভ্যাস আমার নেই। মূলত যে প্রাধান্য জায়গা গুলি আলোচনার মধ্যে আসবে তা পয়েন্ট করে লিখে নিয়েছিলাম। ছবি দেখা। আলোচনা। বক্তব্য। প্রশ্ন-উত্তরে সাজানো ছিল সময়টা। এখানে তার শুধু টুকরো অংশ থাকলো।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি